ব্রিটেনে পাওয়া ‘প্রাচীনতম’ কোরআন নিয়ে নতুন বিতর্ক
এ বছরের জুলাই মাসে ব্রিটেনের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে সন্ধান পাওয়া যায় হাতে লেখা প্রাচীন কোরআন শরিফের কিছু পৃষ্ঠা। এর পর থেকে শুরু হয় হৈ চৈ। বলা হচ্ছিল, এগুলো সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীনতম কোরআনের অংশ। গবেষকরা ধারণা করছিলেন, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর জীবদ্দশাতেই সম্ভবত এগুলো লেখা হয়েছিল।
তবে নতুন এক গবেষণা আবিষ্কৃত পৃষ্ঠাগুলো নিয়ে হৈ চৈয়ের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। শুরু হয়েছে নতুন বিতর্ক।
যে চামড়ায় (পার্চমেন্ট কাগজ) পবিত্র কোরআনের আয়াতগুলো লেখা ছিল, সম্প্রতি সেই কাগজের কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন গবেষক। তাঁরা দেখতে পান, কাগজটির বয়স ৫৮৬ থেকে ৬৪৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে। অন্যদিকে মহানবী (স.)-এর জন্ম হয়েছিল ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে। আর তাঁর ৪০ বছর বয়সে নবুয়ত লাভ করেন তিনি। অর্থাৎ ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী ওই বয়সেই তাঁর ওপর কোরআন নাজিল হয়।
অর্থাৎ মহানবীর নবুয়তপ্রাপ্তি তো বটেই, তাঁর জন্মের আগে তৈরি করা হয়ে থাকতে পারে পার্চমেন্ট কাগজটি।
আজ শনিবার ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দি ইনডিপেনডেন্ট-এর এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা বিশ্বাস করেন, ৬১০ খ্রিস্টাব্দে হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর ওপর পবিত্র কুরআন নাজিল হতে শুরু করে এবং তাঁর মৃত্যুর বছর পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। ৬৫০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত এসব আয়াতগুলো কোথাও লিখে সংরক্ষণ করা হতো না। এগুলো মহাবীর কাছ থেকে যারা শুনতেন তারাই মুখস্থ করে রাখতেন। এভাবেই এই পবিত্র গ্রন্থের আয়াতগুলো মানুষের স্মৃতিতে সংরক্ষিত থাকত। এরপর খণ্ড খণ্ডভাবে পামগাছের পাতা বা উটের কাঁধের অংশের চামড়ায় লিখে সংরক্ষণ করা শুরু হতে থাকে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কোরআন বিশেষজ্ঞ ড. কিথ স্মল দ্য টাইমসকে বলেন, ‘এটা পবিত্র কোরআনের জন্মের ভিত্তি সম্পর্কে আরো একটা ধারণা দেয়। এর অর্থ মহানবী (স.) ও তাঁর অনুসারীরা এমন সব বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন যা আগে থেকেই পৃথিবীতে ছিল। এবং সেই সব বাণীকে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক ও ধর্মতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে দিয়েছেন। মুহাম্মদ (স.) স্বর্গ থেকে কোনো ঐশ্বরিক বাণী না পেয়েই তাঁরা এটা করেছেন।’
নতুন এই গবেষণার তথ্য যদি সত্যি বলে প্রমাণিত হয় তাহলে ইসলামের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে এবং প্রথাগত বিশ্বাস চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
তবে এই গবেষণার ফলাফলেরও বিরোধিতা করছেন বিভিন্ন পণ্ডিতরা। তাঁরা কার্বন ডেটিং পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়েই নানা প্রশ্ন তুলছেন। উদ্ধার হওয়া কোরআনের পাতাগুলোর বানানরীতি, ব্যাকরণ ও শব্দ প্রকরণ দেখে কিছু গবেষক বলছেন, সপ্তম শতকের দ্বিতীয় ধাপে এটি লেখা হয়ে থাকতে পারে। ফলে এটি কোরআন শরিফের জন্মের ঐহিত্যবাহী ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে।
ইসলামিক স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ড. মুস্তাফা সালাহ দি ইনডিপেনডেন্টকে বলেন, ‘আপনি যদি এটার দিকে লক্ষ করেন, তবে দেখবেন, এটা সপ্তম শতকের আরবি ভাষাতত্ত্বের নিয়মাবলি দিয়ে লেখা।’
এ ছাড়া কয়েকজন পণ্ডিত বলছেন, পার্চমেন্টের কার্বন ডেটিং করা হয়েছে। কিন্তু যে কালি দিয়ে পবিত্র কোরআনের ওই বাণীগুলো লেখা হয়েছে, তার তো কোনো পরীক্ষা করা হয়নি।
এ বিষয়ে আল ফারুক ইসলামিক হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ড. আব্বাস তাশখন্দী বলেন, তখনকার দিনে পার্চমেন্ট ধুয়ে ব্যবহার করা হতো। অর্থাৎ পার্চমেন্টে যদি এমন কোনো তথ্য লেখা হতো, যা আরো অন্য জায়গায় সংরক্ষিত আছে তাহলে ওই পার্চমেন্ট ধুয়ে আবার নতুন করে লেখা হতো। তাই পার্চমেন্টটি পুরোনো হতে পারে তবে লেখাটি নতুন হতে পারে।
সুন্নি পণ্ডিতদের মতে, হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর পর তৃতীয় খলিফা হজরত ওসমান (রা.)-এর শাসনামলে পবিত্র কোরআনকে গ্রন্থিত করা হয়। অর্থাৎ ৬৪৪ থেকে ৬৫৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কোরআনের বাণীগুলো একসঙ্গে সন্নিবেশ করা হয়।
বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির ক্রিস্টিয়ানিটি অ্যান্ড ইসলাম বিভাগের অধ্যাপক ডেভিড থমাস বলেন, সম্ভবত কোরআন লেখার জন্য অনেক আগে থেকেই পশু জবাই করে এই পার্চমেন্টটি প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। এরপর কোরআন নাজিল হওয়ার পর ওই পার্চমেন্টে তা লেখা হয়।
এদিকে আগামী মাসে তিন সপ্তাহের জন্য জনসাধারণের জন্য প্রদর্শিত হবে বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে পাওয়া পবিত্র কোরআনের পাতাগুলো।
হিজাজি অক্ষরে হাতে লেখা কোরআনের ওই অংশ ১৯২০ সাল থেকে বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতে ছিল। লাইব্রেরির পুরোনো গ্রন্থের সেকশনের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিভিন্ন পুরোনো গ্রন্থ ও দলিলের অংশে এটি সংরক্ষিত ছিল। গত ১০০ বছরে এটি কারো নজরে আসেনি। গত জুলাই মাসে এক পিএইচডি শিক্ষার্থী হঠাৎ করেই কোরআনের এই পাতাগুলো খুঁজে পেলে এ নিয়ে বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।