আয়লানের শেষ চিৎকার, ‘বাবা মরে যেও না’
তুরস্কের সাগরে তীব্র স্রোতের মধ্যে যখন আয়লানের বাবা তাকে বাঁচাতে চেষ্টা করছিল, তখন ছোট্ট শিশুটি চিৎকার করে বলছিল, ‘বাবা মরে যেও না।’
জীবনের শেষ কয়েকটি ক্ষণে ছোট্ট আয়লানের এমন আর্তির কথা উঠে এসেছে আইলানের ফুফু ফাতিমা কুর্দির কথায়।
যুক্তরাজ্যের দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফাতিমা জানান, নৌকাটি ডুবে যাওয়ার সময় আবদুল্লাহ (আয়লানের বাবা) পাগলের মতো তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সে সফল হয়নি। সাগরের স্রোতে একের পর এক সবাইকে তুরস্কের ইজিয়ান সাগরে ডুবতে দেখেন তিনি।
ছোট্ট আয়লানের ফুফু ফাতিমা থাকে কানাডায়। কয়েক বছর ধরে সেখানেই বাস করছেন তিনি। মর্মান্তিক এ ঘটনার পর ছুটে তুরস্ক আসেন ফাতিমা। সেখানেই ভাইয়ের কাছ থেকে এসব শুনেছেন বলে দাবি করেন তিনি।
নৌকাডুবির ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফাতিমা বলেন, ‘যখন সাগরের ঢেউ আমাদের ছোট্ট নৌকাটিকে ক্রমাগত আছাড় মারছিল, তখন আবদুল্লাহর দুই বাহুতে ছিল তাঁর দুই ছেলে। একসময়ে উত্তাল সাগরের কাছে হার মেনে নৌকাটি উল্টে যায়। এরপর ঢেউয়ের সঙ্গে নৌকার কাছ থেকে দূরে সরে যায় অনেকেই। আমি দেখছিলাম, যতক্ষণ পারা যায়, ততক্ষণই দুই ছেলেকে পানির ওপরে ঠেলে ভাসিয়ে রাখছিল আবদুল্লাহ। আর আয়লান তখন চিৎকার করে বারবার বলছিল, বাবা, মরে যেও না।”
দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে আয়লানের বাবা-মাকে ইউরোপে আসতে টাকা জোগান দেওয়া জন্য বারবার নিজেকে দায়ী করছিলেন ফাতিমা।
মর্মান্তিক ওই মুহূর্তের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ফাতিমা বলেন, ‘একপর্যায়ে আবদুল্লাহ যখন বুঝতে পারে যে তার বড় ছেলে গালিপ আর জীবিত নেই, তখন তাকে ছেড়ে দিয়ে আয়লানকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। একপর্যায়ে আয়লানও নিস্তেজ হয়ে পড়লে তাকেও সমুদ্রের কাছেই সপে দেয় আবদুল্লাহ। এরপর সাগরে তার স্ত্রীর নাম ধরে চিৎকার করতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে রেহামের (আয়লানের মা) মরদেহও পানিতে ভাসছিল।’
ফাতিমা আরো জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ার কোবানি শহরে তাঁর ভাই আবদুল্লাহ বাড়ি গোলার আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিলেন। এরপর এ বছরের শুরু থেকেই পরিবারসহ কানাডায় অভিবাসী হতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সব জানানোর পরও পরিবারটিকে ভিসা দেয়নি কানাডা দূতাবাস।’
কাঁদতে কাঁদতে ফাতিমা প্রতিবেদককে জানান, সপ্তাহ দুই আগে টেলিফোনে কথা বলার সময় ফুফুর কাছে একটি বাইসাইকেলের জন্য আবদার করেছিল আয়লানের বড় ভাই গালিপ।
গত বুধবার উবু হয়ে তুরস্কের সৈকতে পড়ে থাকা উজ্জ্বল লাল টি-শার্ট আর নীল প্যান্ট পরা আয়লানের নিথর দেহের ছবি প্রকাশিত হওয়ার পর তা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। আয়লানের প্রাণহীন দেহ ইউরোপসহ সমগ্র বিশ্বে গভীর আবেগের জন্ম দিয়েছে। সারা বিশ্বের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অসংখ্যবার ছবিটি দেখেছে মানুষ।
সবারই অভিমত, এ একটি ছবিই বলে দিচ্ছে ইউরোপজুড়ে অভিবাসন সংকট কতটা চরমে পৌঁছেছে। বিশ্বজুড়ে মানুষের বেদনার কারণ হয়েছে প্রাণহীন এই শিশু। নিজের প্রাণ দিয়ে হলেও শিশুটি বিশ্ববাসীকে অভিবাসীদের সত্যিকার অবস্থা এবং তাদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের সম্পাদকীয়র শিরোনামটি ছিল : ‘জীবন দিয়ে কঠোর ইউরোপীয়দের ভবিষ্যৎ বুঝিয়ে গেছে ছোট্ট আয়লান।’
আয়লানের ছবি প্রকাশের পর হাঙ্গেরিতে আটক প্রায় চার হাজার অভিবাসীকে অস্ট্রিয়া ও জার্মানিতে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শনিবার সকালে সিরিয়া, সোমালিয়া ও আফগানিস্তানের এসব অভিবাসীকে সীমান্তের ওপারে স্বাগত জানান অস্ট্রিয়ার নাগরিকরা।