বিষাদ বয়ে আনা ছুটি, দ্বীপরাষ্ট্রে নিভল জীবন
হাঁফ ছেড়ে বাঁচতে ছুটি কাটাতে শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন তাঁদের অনেকেই। নিয়মমাফিক জীবনের বাইরে সাগরের কাছাকাছি থাকতে দ্বীপদেশে পাড়ি জমান তাঁরা। কিন্তু কে জানত, ওটাই ছিল শেষ যাত্রা। কে জানত, ভারত মহাসাগরের ওই দ্বীপেই নিভে যাবে তাঁদের জীবনপ্রদীপ।
গত রোববার শ্রীলঙ্কার একাধিক গির্জা ও হোটেলে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। ওই হামলায় এখন পর্যন্ত ৩১০ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে ৩৫ জন বিদেশি বলে জানা গেছে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিহত ২৮ জনকে নিয়ে প্রতিবেদন করেছে। সেখানে দেখা যায়, বিদেশিদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পর্যটক। কেবল বেড়ানোর আনন্দ নিতে শ্রীলঙ্কায় যান তাঁরা।
নেই ছোট্ট জায়ান
শ্রীলঙ্কায় বোমা হামলায় নিহতদের মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিমের নাতি শিশু শেখ জায়ান চৌধুরী।
জায়ান চৌধুরী শেখ সেলিমের মেয়ে শেখ আমেনা সুলতানা সোনিয়ার ছেলে। ওই ঘটনায় আহত হয়েছেন জায়ানের বাবা মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্স।
সংসদ সদস্য শেখ সেলিম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই। সেলিমের মেয়ে শেখ সোনিয়া তাঁর স্বামী মশিউল হক চৌধুরী প্রিন্স ও দুই ছেলেকে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে যান। তাঁরা উঠেছিলেন কলম্বোর একটি পাঁচতারকা হোটেলে। বোমা হামলার সময় হোটেলের নিচতলার রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন মশিউল হক চৌধুরী ও তাঁর ছেলে জায়ান চৌধুরী। অন্যদিকে বড় ছেলে জোহানকে নিয়ে শেখ আমেনা ছিলেন হোটেলের ছয়তলার একটি কক্ষে। ফলে হামলা থেকে বেঁচে গেছেন তাঁরা।
পরিবারের কেউ রইল না
ভ্রমণপিয়াসু ছিলেন ব্রিটিশ নাগরিক আনিতা নিকলসন। স্বামী বেন নিকলসনও আনিতার এ বিষয়টিতে আগ্রহ দেখাতেন সব সময়। আর এ জন্যই ছুটি পেয়ে ছেলে অ্যালেক্স ও মেয়ে অ্যানাবেলকে রঙিন জীবনের স্বাদ দিতে ভ্রমণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কাকেই।
হামলার সময় পরিবারের চারজনই ছিলেন সাংরি-লা হোটেলে। ভাগ্যের জোরে বেন বেঁচে গেলেও ঘটনাস্থলেই নিহত হন তাঁর স্ত্রী ও দুই সন্তান।
এক বিবৃতিতে বেন নিকলসন বলেন, ‘হামলার সঙ্গে সঙ্গে কোনো যন্ত্রণা ছাড়া তিনজনই নিহত হয়।’
বেন আরো বলেন, ‘আমার স্ত্রী ও সন্তানদের হারিয়ে আমি অনেক কষ্টে রয়েছি। আনিতা অনেক চমৎকার একজন স্ত্রী এবং আমার চমৎকার দুই সন্তানের জন্য বুদ্ধিমতী, স্নেহশীল ও অনুপ্রেরণাদায়ক একজন মা ছিল।’
বোমা হামলায় এ তিনজন ছাড়াও আট ব্রিটিশ নাগরিক নিহত হয়েছেন বলে জানান শ্রীলঙ্কায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার।
খালি হলো ডেনিশ ধনকুবেরের ঘর
শ্রীলঙ্কায় বেড়াতে গিয়ে বোমা হামলায় নিহত হন ডেনমার্কের ধনকুবের অ্যান্ডার্স হোল পওলসনের তিন সন্তান। দ্বীপদেশে নেমে ছবিও দিয়েছিল সামাজিক মাধ্যমে। তবে আনন্দ নিয়ে দেশে ফিরতে পারেনি তারা।
পওলসন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পোশাকের ব্র্যান্ড ‘বেস্টসেলার’-এর স্বত্বাধিকারী।
পওলসনের প্রতিষ্ঠান বেস্ট সেলারের এক মুখপাত্র বলেন, ‘দুর্ভাগ্যের সঙ্গে জানানো যাচ্ছে যে, মিস্টার পওলসনের সন্তানরা নিহত হয়েছেন। আমরা পরিবারটির গোপনীয়তার প্রতি আপনাদের সম্মান প্রত্যাশা করছি। এ ব্যাপারে আমাদের আর কোনো বক্তব্য নেই।’
ভোটের কাজ শেষ, তাই ছুটি নিয়ে শ্রীলঙ্কা
গত ১৮ এপ্রিল ভারতের লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় দফার কাজকর্ম শেষ করে কিছুদিন ছুটি পেয়েছিলেন ভারতের জনতা দল পার্টির (জেডিপি) চার কর্মী। ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়।
সকাল ৮টার দিকে তাঁরা নাশতা করতে গিয়েছিলেন সাংরি-লা হোটেলে। এরপরই নৃশংস বোমা হামলার শিকার হন তাঁরা।
নিহত চার জেডিপি কর্মী হলেন কে জি হানুমানথারায়াপ্পা, এম রাঙ্গাপ্পা, কে এম লাক্সমিনারায়ণ ও লাক্সমানা গোওদা রমেশ। তাঁরা সবাই বেঙ্গালুরুর বাসিন্দা।
একই হামলায় নিহত হন রোজিনা কাদের (৫৮) নামের এক ভারতীয় নারী। কেরালার বাসিন্দা হলেও স্বামীসহ থাকতেন দুবাইতে। আর তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রে। আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করতে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে গিয়েছিলেন রোজিনা। হামলার কিছু পরেই দুবাই ফেরার ফ্লাইট ছিল তাঁর। কিন্তু সামান্য ব্যবধানে নৃশংস হামলার ভেতরে প্রাণ হারান তিনিও।
হামলায় ভারতের আটজন নিহত হয়েছেন।
বাবাকে শেষ গুড মর্নিং
সেদিন ভোরে খুব সকালে হোয়াটসঅ্যাপে বাবাকে ‘গুড মর্নিং’ জানিয়েছিলেন তুরস্কের প্রকৌশলী সেল্কুন নারিসি। সেটাই ছিল বাবার সঙ্গে তাঁর শেষ কথা।
কাজের খাতিরে ২০১৭ সালেই শ্রীলঙ্কায় আসেন সেল্কুন নারিসি। সেদিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসে কাজে গিয়েছিলেন তিনি।
সেল্কুন নারিসির বাবা মেমহেট নারিসি স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “সেদিন ভোর ৫টায় সে আমাকে ‘গুড মর্নিং’ লিখে হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজ পাঠায়।’ নারিসি জানান, সেটিই ছিল ছেলের সঙ্গে তাঁর শেষ কথা। বোমা হামলার হাত থেকে বেঁচে ফিরতে পারেননি তিনিও।
হামলায় ইগিত আলি ক্যাভাস নামের আরো একজন তুরস্কের প্রকৌশলী নিহত হন। তাঁর বাবা জানান, ইস্তাম্বুল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক পাস করেছিলেন ক্যাভাস, দুটি ভাষায় কথা বলতেও জানতেন তিনি।
হামলার সময় এ দুই প্রকৌশলী কোন জায়গায় অবস্থান করছিলেন, তা জানা যায়নি।
‘হঠাৎ জোরে শব্দ, দেখি মেয়ে মেঝেতে’
ব্যবসার কাজে ২০১৪ সালেই পরিবারসহ শ্রীলঙ্কায় থাকা শুরু করেন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক সুরিয়ারাচি। স্বামী সুদেশ কলনি ও মেয়ে আলেক্সান্দ্রিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ইস্টার সানডে উপলক্ষে নাগম্বির সেন্ট সিবাস্টিয়ান চার্চে গিয়েছিলেন তিনি। সুদেশ কলনি সাময়িক কাজে চার্চ থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই হঠাৎ বোমা বিস্ফোরণের শব্দ শোনেন। আর এরপরই মেয়েকে পড়ে থাকতে দেখেন চার্চের মেঝেতে। তাঁর কিছু দূরেই পড়ে ছিলেন তাঁর স্ত্রী।
সুদেশ বলেন, ‘হঠাৎ অনেক জোরে একটি শব্দ শুনি…এরপর দেখি, আমার মেয়ে মেঝেতে পড়ে আছে, আর তারপর আমার স্ত্রীকেও দেখি সেখানে।’
এ কেমন মধুচন্দ্রিমা!
মাত্র এক সপ্তাহও হয়নি বিয়ে করেছিলেন পর্তুগিজ নাগরিক লুই লুকাস। স্ত্রীসহ মধুচন্দ্রিমায় শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন তিনি। হামলার সময় কিংবুরি হোটেলে ছিলেন তাঁরা। ওই হামলায় তাঁর স্ত্রী বেঁচে ফিরলেও মারা যান লুকাস।
কাপড় সরালে দেখেন স্ত্রীর মুখ!
ছুটিতে তিন সন্তান ও স্বামী লুইসকে সঙ্গে নিয়ে শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিলেন মনিক অ্যালেন। হামলায় সময় সিনামন হোটেলে ছিলেন তাঁরা। এক ছেলেকে নিয়ে হোটেলের নিচে নাশতা করতে বেরিয়েছিলেন অ্যালেন। আর পরিবারের বাকিরা ছিলেন হোটেল রুমে।
নাশতা করতে একটি টেবিলে পাশাপাশিই বসেছিলেন মা ও ছেলে। কিছুক্ষণ পরেই হয় বোমা হামলা। কিছুক্ষণ অজ্ঞান থাকার পরই চোখ খুলে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায় ছেলে।
অ্যালেনার স্বামী লুইস বলেন, ‘বিস্ফোরণের সময় আমার স্ত্রী ও ছেলে পাশাপাশি বসেছিল, কয়েক মিনিটের জন্য অজ্ঞান থাকার জন্য আমার ছেলে তাঁর মাকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতে পায়।’
লুইস তাঁর ছেলেকে হাসপাতালে আহত অবস্থায় খুঁজে পান। আর এরপই স্ত্রীর খোঁজ করেন তিনি। স্ত্রীকে ঢেকে দেওয়ার কাপড় সরাতে গিয়ে তিনি বারবার ভাবছিলেন, তাঁ স্ত্রী যেন না হয়।
লুইস বলেন, ‘তাঁরা নিহতদের কাপড় সরাচ্ছিলেন। আমি প্রার্থনা করছিলাম, যেন এগুলোর মধ্যে মনিক না থাকে। আর এরপরই কাপড় সরালে দেখা যায় আমার স্ত্রী মনিককে।’
ওয়াশিংটনের সিডওয়েল ফ্রেন্ডস স্কুলে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী কিয়েরান শাফ্রিৎস ডি জয়েসা স্কুলের ছুটিতে বেড়াতে যায় শ্রীলঙ্কায়। বোমা হামলায় নিহত যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের মধ্যে ছিল কিয়েরানও।