রোহিঙ্গা সংকটের দায় নিরাপত্তা পরিষদ এড়াতে পারে না : বাংলাদেশ
স্বেচ্ছায়, নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবাসন এবং এই সহিংসতার জন্য দোষীদের বিচার করার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধান নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ দায় এড়াতে পারে না।
সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ‘সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা’ শীর্ষক উচ্চ পর্যায়ের এক উন্মুক্ত আলোচনায় এ কথা বলেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন।
শুক্রবার জাতিসংঘে বাংলাদেশ দূতাবাসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, রোহিঙ্গা সংকটে সৃষ্ট যৌন সহিংসতার মতো অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার যে সংস্কৃতি বিশ্ব অবলোকন করে যাচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, ‘এসব অপরাধের সমাপ্তি ঘটানো না গেলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না।’
‘আর এই অপরাধগুলোর দায় নির্ধারণ ও বিচার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই কেবল রোহিঙ্গাদের আস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব, যা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনে উৎসাহিত করবে, কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি বাস্তবায়িত হয়নি।’
রাষ্ট্রদূত মাসুদ নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি প্রশ্ন রাখেন, “আপনারা কি প্রত্যাশা করেন এই রোহিঙ্গারা, বিশেষ করে অবর্ণনীয় যৌন সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা নারী ও মেয়েরা ‘তাদের ওপর আর কোনো সহিংসতা হবে না’ এ রকম স্পষ্ট নিশ্চয়তা ছাড়া স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফিরে যাবে?”
শুধু যুদ্ধের অস্ত্র ও কৌশল হিসেবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যে অবর্ণনীয় যৌন সহিংসতা ও নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, সেই ভয়াল স্মৃতির কথা তুলে ধরেন স্থায়ী প্রতিনিধি।
এ প্রসঙ্গে মাসুদ বিন মোমেন আরো বলেন, ‘সেই একই অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে রোহিঙ্গা সংকটের ক্ষেত্রে।’ ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’-এর হিসাব অনুযায়ী, সহিংস যৌন নির্যাতনের ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ২০১৮ সালে প্রায় চার হাজার শিশু ভূমিষ্ঠ হয়েছে, তাদের গ্রহণ করতে মা পর্যন্ত অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। এসব শিশুকে স্বীকৃতি, ক্ষতিপূরণ এবং নিজ দেশ মিয়ানমারে ভালো ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আমলে নিতে হবে।
যৌন নির্যাতন ও এর অপব্যবহার রোধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্স নীতির কথা উল্লেখ করে স্থায়ী প্রতিনিধি বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে বাংলাদেশ ‘যৌন নির্যাতন ও এর অপব্যবহার’ রোধে সচেতনতা সৃষ্টিসহ বাংলাদেশের সব শান্তিরক্ষীর জন্য পদায়নপূর্বক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।
“বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী, কর্মক্ষেত্রে নারীদের যৌন সহিংসতা ও বৈষম্যের অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে এর বিচার ও প্রতিকারে আমরা নীতিমালা বাস্তবায়ন করেছি। ‘ইউএন উইমেন’-এর সহযোগিতায় আমাদের সরকার ‘নারী, শান্তি ও নিরাপত্তা’ বিষয়ে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে যাচ্ছে,” যোগ করেন স্থায়ী প্রতিনিধি।
এ ছাড়া রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেন বাংলাদেশে যৌন নির্যাতন ও সহিংসতা রোধে আইন, নীতিমালা ও তদন্ত ব্যবস্থা শক্তিশালী করা, নির্যাতনের শিকার নারীকে সুরক্ষাদানের পাশাপাশি তার প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং পুনর্বাসনসহ স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ে সক্ষমতা বিনির্মাণ করার সরকারি পদক্ষেপগুলোর কথা উল্লেখ করেন।
উন্মুক্ত আলোচনায় আরো বক্তব্য দেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ, জাতিসংঘ মহাসচিবের যৌন সহিংসতা রোধবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি প্রমিলা প্যাটেন, ২০১৮ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. ডেনিস মুখউইজি ও নাদিয়া মুরাদ এবং ব্যারিস্টার অমল ক্লুনে।
দায়বদ্ধতা নিরূপণের গুরুত্ব এবং সহিংসতার শিকার নারীদের সুরক্ষাসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে সংঘাতময় পরিস্থিতিতে যৌন সহিংসতা রোধের ওপর এই উন্মুক্ত আলোচনায় আলোকপাত করা হয়।
নিরাপত্তা পরিষদের চলতি এপ্রিল মাসের সভাপতি জার্মানি এই উচ্চ পর্যায়ের উন্মুক্ত আলোচনার আয়োজন করে।