শরণার্থী থেকে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট!
তখন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ লাটভিয়া। পালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ছোট্ট ফ্রেইবারগার। ৫০ বছর দেশের মাটির স্পর্শ পাননি তিনি। আর যখন নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবেই তাঁকে বরণ করে নেয় দেশের জনগণ। সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে ভাইরা-ভাইক ফ্রেইবারগার সে সময়ের জীবনের নানা মুহূর্ত।
ফ্রেইবারগা বলেন, ‘আমার মা-বাবা কখনোই ভুলে যেতে দেননি যে আমি একজন লাটভিয়ান।’
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বাল্টিক রাষ্ট্রে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নাৎসি জার্মানি ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন। বাল্টিক রাষ্ট্র বলতে উত্তর ইউরোপে বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত রাষ্ট্রগুলোকে বোঝায়। এস্তোনিয়া, লাটভিয়া ও লিথুয়ানিয়া—এ তিনটি দেশকে বলা হয় বাল্টিক রাষ্ট্র।
ফ্রেইবারগার মনে আছে, ১৯৪৪ সালের সে উত্তপ্ত সময়ের কথা। শুরু হয় বাঁচা-মরার লড়াই। ওই সময় সাত বছর বয়সী ছোট্ট ফ্রেইবারগাকে নিয়ে তাঁর পরিবার প্রথমে বিধ্বস্ত জার্মানির উদ্দেশে রওনা দেয়। এরপর তাঁরা ফরাসি অধ্যুষিত দেশ মরক্কোতে যান। পরে থিতু হন কানাডায়। এভাবেই চলতে থাকে ফ্রেইবারগার জীবন।
এরপর ৫০ বছরেরও বেশি সময় কেটে যায়, লাটভিয়ার দেখা মেলে না ফ্রেইবারগার। শেষমেশ ১৯৯৮ সালে নিজ দেশে ফেরেন তিনি। আর মাত্র আট মাসের মাথায় হয়ে যান মাতৃভূমির প্রেসিডেন্ট।
১৯৪৫ সালে নববর্ষের রাতে পরিবারসহ দেশ ছেড়েছিল ফ্রেইবারগার পরিবার। ওই সময়ের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘আমরা পালানোর জন্য একটি জাহাজে উঠেছিলাম। জাহাজটি ছিল সেনাবাহিনী এবং অস্ত্রের পরিবহন জাহাজ। ধরা পড়লে অবশ্যই অনেক বড় ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তবে ওই জাহাজে যথেষ্ট সংখ্যক বেসামরিক মানুষ নেওয়া হয়েছিল, যারা নিজেরাও যেকোনো মূল্যে কমিউনিজম থেকে মুক্তি পেতে চাইত। সেখানে জাহাজের ডেকে বিভিন্ন সময় লাটভিয়ানরা জড়ো হতেন আর লাটভিয়ান গান গাইতেন।’
একসময় জার্মানিতে শরণার্থী শিবিরে পৌঁছায় ফ্রেইবারগার পরিবার। সেখানকার পরিস্থিতি ছিল খুব করুণ। এর মধ্যেই ফ্রেইবারগার ১০ মাস বয়সী ছোট বোন মারা যায় নিউমোনিয়ায়। বছর পেরোতেই ফ্রেইবারগার মা একটি ছেলেসন্তানের জন্ম দেন।
ওই সময়ের একটি করুণ স্মৃতি মনে করে ফ্রেইবারগা বলেন, ‘১৮ বছর বয়সী একজন তরুণী আমার মায়ের সঙ্গে এক কক্ষেই ছিলেন। সেখানে একটি মেয়েসন্তানের জন্ম দেন ওই তরুণী। কিন্তু সে সন্তানকে কিছুতেই গ্রহণ করতে চাইছিলেন না তিনি। নিজের সন্তানকে কোনো নামও দিতে চাননি তরুণীটি। কারণ, রাশিয়ার সেনাদের গণধর্ষণের ফলে জন্ম নেয় ওই সন্তান।’
ফ্রেইবারগা বলেন, “যখনই নার্সরা ওই শিশুকে তার মায়ের কাছে এনে রাখছিলেন, ওই তরুণী দেয়ালের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিতেন আর কাঁদতেন। তিনি তাঁর সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে চাইতেন না। নার্সরা ওই শিশুটির একটি নাম দিয়েছিলেন—‘মারা’। যেটি ছিল আমার ছোট বোনের নাম।”
‘আমি ভাবতাম অনেক বেশি কিছুই হয়ে যাচ্ছে। একটি ছোট্ট শিশু ‘মারা’, যে জন্ম নিয়েছে, বাঁচতে চাইছে, কিন্তু এই পৃথিবী তাকে চায় না। আর আমার ছোট বোন ‘মারা’, যাকে আমরা সবাই চাইতাম, কিন্তু পাইনি। বুঝতে পারলাম, জীবন অনেক অদ্ভুত,’ যোগ করেন ফ্রেইবারগা।
১১ বছর বয়সে ফ্রেইবারগা মরক্কোর ক্যাসাব্লাঙ্কায় চলে যান। এর কিছুদিনের মধ্যেই পরিবারসহ কানাডায় যান তিনি। সেখানে ১৬ বছর বয়সে একটি ব্যাংকে চাকরি পান ফ্রেইবারগা। সে সঙ্গে রাত্রিকালীন স্কুলে যেতেন তিনি। পরে টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। সেখানে তিনি পরিচিত হন আরেক লাটভিয়ান ইম্যান্টস ফ্রেইবার্গসের সঙ্গে, যাঁকে পরে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন ফ্রেইবারগা।
টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়তেন ফ্রেইবারগা। পরে ১৯৬৫ সালে পিএচডি ডিগ্রি লাভ করেন তিনি।
ফ্রেইবারগা কানাডার মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩৩ বছর অধ্যাপনা করেছেন। তিনি মোট পাঁচটি ভাষায় পারদর্শী ছিলেন। সে সঙ্গে লিখেছেন ১০টি বই।
১৯৯৮ সালে ৬০ বছর বয়সে ইমেরিটাস প্রফেসর নির্বাচিত হন ফ্রেইবারগা এবং পরে অবসর নেওয়ার চিন্তা করেন।
কিন্তু এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন বেজে ওঠে ফ্রেইবারগার ফোন। ওপাশ থেকে লাটভিয়ার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাঁকে লাটভিয়ার নতুন একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান করার কথা জানান।
ফ্রেইবারগাকে জানানো হয়, তাঁরা এমন একজনকে চান, যাঁর বিভিন্ন ভাষায় দখল আছে এবং যিনি পশ্চিমা মনোভাব বোঝেন। এ ছাড়া যাঁর লাটভিয়ার সংস্কৃতি সম্পর্কেও বেশ ভালো বোঝাপড়া আছে।
এরপর খুব দ্রুতই লাটভিয়ার রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন ফ্রেইবারগা। পরে লাটভিয়ার প্রেসিডেন্সিয়াল দৌড়ে অংশ নেন তিনি। এর মাত্র আট মাসের মাথায় লাটভিয়ার প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ফ্রেইবারগা।
ফ্রেইবারগা বলেন, ‘আমি এমন একজন মানুষ, যার নিজের কাজটা করে যাওয়া ছাড়া অর্থ-সম্পদের প্রতি কোনো বাসনা নেই।’
ফ্রেইবারগা আরো বলেন, ‘এর মধ্যেই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেখতে পাই, অনেক বিষয় নিয়ে আমার সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি হলো, আমি পশ্চিমে অনেক বিলাসবহুল জীবনযাপন করেছি, যেটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম, যদি আপনি গণমাধ্যমকে বিশ্বাস করতে না পারেন, তো সরাসরি মানুষের কাছে গিয়ে কথা বলুন।’
২০০৪ সালে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয় লাটভিয়া।
পরে দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ২০০৭ সালে শেষ হয় তাঁর মেয়াদ। পরে তিনি ক্লাব ডি মাদ্রিদ নামে একটি সংগঠনের সহপ্রতিষ্ঠাতা হন। ক্লাব ডি মাদ্রিদ সাবেক নেতাদের নিয়ে গঠিত একটি সংগঠন।
নারী ক্ষমতায়নেও বিশেষ নজর রয়েছে ফ্রেইবারগার। ফ্রেইবারগা অবশ্য জানেন, যুদ্ধে জয়ী হওয়া এখনো অনেক দূরের পথ।