ক্লাস বর্জন করে বিক্ষোভে হংকংয়ের স্কুল-বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা
ক্লাস বর্জন করে আজ সোমবার চীনশাসিত হংকংয়ে চলমান সরকারবিরোধী গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনে যোগ দিয়েছে প্রচুর সংখ্যক স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে হংকং।
তিন মাসের বেশি সময় ধরে চলমান আন্দোলনে থেকে থেকে পুলিশের সঙ্গে ভয়াবহ সংঘর্ষে জড়াচ্ছে আন্দোলনকারীরা। ব্যারিকেড পোড়ানো থেকে শুরু করে পুলিশকে লক্ষ্য করে পেট্রল বোমা ছুড়েছে বিক্ষোভকারীরা। পুলিশও জলকামান, কাঁদানে গ্যাস ও লাঠিচার্জ করে পাল্টা জবাব দিয়েছে। পুলিশের হাতে নিয়মিত আটকও হচ্ছে আন্দোলনকারীরা।
সবচেয়ে বেশিবার সংঘর্ষ হয়েছে হংকংয়ের এমটিআর সাবওয়ে এলাকায়। সোমবার ওই এলাকায় দাঙ্গা পুলিশকে টহল দিতে দেখা গেছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
হংকং শহরের বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর একটি হলো চায়নিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং। ক্লাস বয়কট করে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে একটি মঞ্চ নির্মাণ করে সেখান থেকে প্রতিবাদমূলক বক্তব্য দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। মঞ্চকে ঘিরে অবস্থান করছে শত শত শিক্ষার্থী।
চ্যান নামের ১৯ বছর বয়সী এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমি শুধু এটাই জানাতে এসেছি যে গ্রীষ্মের ছুটি শেষ হওয়ার পরও আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাইনি। হংকংয়ের জন্য আমাদের লড়াই করে যেতে হবে।’
‘এই আন্দোলন আমাকে সমাজকে নিয়ে আরো ভাবতে শিখিয়েছে। অবহেলিতদের প্রতি যত্নশীল হতে শিখিয়েছে,’ যোগ করেন চ্যান।
কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু ছবিতে শহরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বাইরে ব্যানার হাতে শিক্ষার্থীদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এদিকে টাইফুনের হুঁশিয়ারি থাকায় বন্ধ রয়েছে হংকংয়ের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো। গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষ হয়েছে আজ সোমবার।
এ বিষয়ে হংকং সরকারের প্রধান সচিব ম্যাথু চিয়াং সাংবাদিকদের বলেছেন, স্কুল বিক্ষোভের জায়গা নয়।
তবে বিক্ষোভকারীরা হরতালের ডাক দিলেও বেশিরভাগ হংকংবাসী প্রাত্যহিক জীবনযাপনে ব্যস্ত রয়েছেন। বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত এই অর্থনৈতিক অঞ্চলজুড়ে দোকানপাট খোলা রয়েছে। চলছে ট্রেন। অফিসে যেতে দেখা যায় কর্মজীবীদের।
জুনের মাঝামাঝি শুরু হওয়া এই আন্দোলন তিন সপ্তাহ ধরে হংকংয়ের বিমানবন্দরকে টার্গেট করে এগোচ্ছে। বিমানবন্দরসংলগ্ন টুং চাং শহরটির রাস্তার সব বাতির খুঁটি ও সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলা হয়েছে। প্রতিবারের বিক্ষোভেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে আন্দোলনকারীরা। পুলিশের হাতে নিয়মিত আটকও হচ্ছে তারা।
বহুবার বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকে টার্মিনাল ব্লক থেকে শুরু করে ফ্লাইট বিলম্বের কারণ হয়েছে কালো পোশাকের আন্দোলনকারীরা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২০ বছর বয়সী এক যুবক গতকাল রোববার রয়টার্সকে বলছিলেন, ‘যদি আমরা বিমানবন্দর অচল করে দিতে পারি, তাহলে হংকংয়ের খবরটি বেশি সংখ্যক বিদেশির নজরে আসবে।’
চীন নিয়ন্ত্রিত হংকংয়ে বিমানবন্দর ও এর সংযোগ সড়কগুলোয় অবরোধ সত্ত্বেও থেমে নেই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটির উড়োজাহাজের ওঠানামা। কিছুটা বিলম্বে হলেও উড়োজাহাজ উড্ডয়ন ও অবতরণ করছে। গতকাল রোববার হংকং বিমানবন্দরে জড়ো হন গণতন্ত্রপন্থী হাজারো নগরবাসী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের নজরে আসতে বেশ কিছুদিন ধরে বিমানবন্দর অবরোধ করে আসছে আন্দোলনকারীরা।
উড়োজাহাজের ওঠানামা থাকলেও আন্দোলনের মুখে বিমানবন্দর অভিমুখী ট্রেন ও বাস সার্ভিস বন্ধ হয়ে যায়। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বিক্ষোভের কারণে গতকাল ২৫টি ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে।
গতকাল রোববার সারা দিন ব্যাগপত্র হাতে নিয়ে হেঁটে বহু যাত্রীকে বিমানবন্দরে ঢুকতে ও বের হতে দেখা গেছে। দিনে বিক্ষোভ থাকলে রাতের সময়টাতে উড়োজাহাজের উড্ডয়ন ও অবতরণ সংখ্যা বেশি হচ্ছে।
গতকাল রোববার সন্ধ্যায় আন্দোলনকারীরা বিমানবন্দর এলাকা থেকে সরে গেলেও টুং চাং শহরের রাজপথগুলো থেকে সরেনি তারা। আজ সোমবার দিনব্যাপী হংকংজুড়ে হরতালের ডাক দিয়েছে আন্দোলনকারীরা।
চীনের প্রতি ক্ষোভ
গতকাল রোববার বিমানবন্দর এলাকা ছেড়ে সরে যাওয়ার পর তুং চুং ডিস্ট্রিক্টের নিকটবর্তী এমটিআর সাবওয়ে স্টেশনের সিসিটিভি ও বাতিসহ বেশকিছু অবকাঠামো ভাঙচুর করে কিছু বিক্ষোভকারী। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নেয়। এ সময় কয়েকজন বিক্ষোভকারীকে আটকও করে পুলিশ।
বিক্ষোভকারীদের সবচেয়ে অপছন্দের ব্যক্তি হলেন হংকং সরকারের প্রধান ক্যারি ল্যাম। ল্যাম সরকার চীনের কথায় ওঠে-বসে—এমনটাই মনে করে বিক্ষোভকারীরা। সোমবার নিজের ফেসবুক পেজে ল্যাম জানান, ‘হিংসাত্মক দুষ্কৃতকারীরা’ ১০টি সাবওয়ে স্টেশনের ক্ষতিসাধন করেছে।
‘এক দেশ, দুই নীতি’ চুক্তির আওতা চলে আসা হংকংয়ের স্বাধীনতা হুমকির মুখে ফেলছে চীন—এমন শঙ্কা থেকে গত জুনের মাঝামাঝি তুঙ্গে ওঠে সরকারবিরোধী আন্দোলন। নাগরিকদের প্রতিবাদ করার অধিকার এবং একটি স্বাধীন বিচারিক ব্যবস্থার দাবিও এ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত। গত শনিবার পুলিশ বনাম বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ ভয়াবহ রূপ নেয়।
হংকং সরকারের নিরাপত্তা সচিব জন লি গণমাধ্যমকে জানান, শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১০০ পেট্রল বোমা ছুড়েছে বিক্ষোভকারীরা। এ ছাড়া একটি এমটিআর স্টেশন থেকে দুটি পেট্রল বোমাসহ ১৩ বছরের এক কিশোরকে আটক করা হয়েছে বলে জানান জন লি।
বিতর্কিত একটি প্রত্যর্পণ বিলকে ঘিরে হংকংয়ে দানা বাঁধে সরকারবিরোধী আন্দোলন। ওই প্রত্যর্পণ বিলে হংকং থেকে যেকোনো অভিযুক্ত সন্দেহভাজনকে চীনের আদালতে বিচারের জন্য পাঠানোর ব্যবস্থা রাখা হয়। একদিকে হংকংকে স্বায়ত্তশাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে অন্যদিকে এমন বিল পাস করানোর অপচেষ্টাকে হংকংয়ের ওপর কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত চীনা সরকারের আরো বেশি দমন-পীড়নের হাতিয়ার মনে করে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে হংকংবাসী। তীব্র আন্দোলনের মুখে বিলটি সাময়িকভাবে স্থগিত করে হংকং সরকার।
বৃহত্তর পরিসরে গণতন্ত্র দাবি করে ১৩ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে চলছে হংকংয়ের এই আন্দোলন। চলতি বছরের ১ অক্টোবর চীন গণপ্রজাতন্ত্রের ৭০তম বার্ষিকী উদযাপনের আগেই হংকংয়ের এই আন্দোলন থামাতে চায় চীন সরকার।
অবশ্য চীন বরাবরই হংকং বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার কথা অস্বীকার করে আসছে। এ ছাড়া চলমান বিক্ষোভে বিদেশি মদদের অভিযোগও তুলেছে চীন। হংকং-সংক্রান্ত ইস্যুকে অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে দাবি করে চীন।
এ ছাড়া এক দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো অর্থনৈতিক মন্দার মুখে পড়া হংকংয়ের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে কারণ হিসেবে বিক্ষোভকে দায়ী করে চীন।
এ অবস্থায় অনেকেই আশঙ্কা করছেন, বিক্ষোভকারী ও পুলিশের মধ্যে চলমান সংঘাতপূর্ণ অবস্থানের কোনো সুরাহা না হলে হংকংয়ে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারে অঞ্চলটির প্রশাসন। তবে জরুরি অবস্থা জারি হলে গণগ্রেপ্তার, নিষেধাজ্ঞা ও কারফিউ জারির মতো ক্ষমতা আরো বাড়বে হংকং প্রশাসনের—এমনটা আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
হংকংয়ের প্রশাসনিক প্রধান ক্যারি ল্যাম জানিয়েছেন, এ অঞ্চলের চলমান অশান্তির ইতি টানতে যত ধরনের আইনি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, নেবে তাঁর সরকার।