ইসলামিক স্টেটে ১০ দিন
পশ্চিমা বিশ্বের ধারণার চেয়েও বেশি শক্তিশালী এবং বেশি ভয়ঙ্কর ইসলামিক স্টেট (আইএস)। প্রথম পশ্চিমা সাংবাদিক হিসেবে আইএস নিয়ন্ত্রিত সিরিয়া ও ইরাক ঘুরে এসে এমন সতর্কবার্তাই দিয়েছেন জার্মান সাংবাদিক ইয়োগেন টডেনহুফার (৭৪)।
আইএস নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘসময় আলোচনার পর তাদের কর্মকাণ্ড দেখার অনুমতি পান এই প্রখ্যাত জার্মান সাংবাদিক ও প্রকাশক। পরে তুরস্ক হয়ে আইএসের নিয়ন্ত্রণে থাকা সবচেয়ে বড় শহর মসুলে যান তিনি।
সেখান থেকে ফিরে জার্মান ভাষার পত্রিকা টেয়া টিজেডকে আইএসের অধীনে কাটানো দিনগুলোর বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
টেয়া টিজেডের সঙ্গে আলাপচারিতায় ইয়োগেন জানান, গত আগস্ট মাসে আইএসের হাতে শিরশ্চ্ছেদ হওয়া মার্কিন সাংবাদিক জেমস ফলেরের মতো বেনগাজির সেই একই হোটেলে ছিলেন তিনি।
যাওয়ার আগে জেমস ফলের শিরশ্চ্ছেদ করার ভিডিওটি দেখেছিলেন বলে জানান ইয়োগেন। তিনি বলেন, ‘আমি অবশ্যই ওই ভয়াবহ ভিডিওটি দেখেছিলাম। সেই কারণেই যখন আমি আইএস নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করছিলাম, তখন আমার মাথায় প্রধান চিন্তা ছিল যে কীভাবে যেন একই ভাগ্য আমাকেও বরণ করতে না হয়।’
পুরো ১০ দিন আইএস নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে কাটিয়ে আসার পর ইয়োগেনের কাছে যে বিষয়টি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়েছে সেটি হলো, পশ্চিমা বিশ্ব যেটুকু ভাবে তার চাইতেও আইএস অনেক বেশি শক্তিশালী। ইয়োগেন টডেনহুফার বলেন, ‘এখন আইএসের পরিধি যুক্তরাজ্যের চাইতেও বেশি। আইএসের মতো এত আনন্দ আর উদ্দীপনায় ভরপুর যুদ্ধক্ষেত্র আমি কখনো দেখিনি।’
ইয়োগেন বলেন, ‘প্রতিদিনই বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে শতাধিক মানুষ স্বেচ্ছায় এখানে যুদ্ধে যোগ দিতে আসছে। আমার জন্য পুরো বিষয়টা দুর্বোধ্য।’
আইএস যোদ্ধাদের বাসস্থানের ভেতরে গেছেন বলে দাবি করেন এই জার্মান সাংবাদিক। নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এমন কিছু ছবিও তিনি পোস্ট করেছেন তিনি। যেখানে দেখা গেছে আইএস যোদ্ধারা জার্মানির হেকলার ও কোচ এমজি-থ্রি মেশিনগান হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এ বিষয়ে ইয়োগেন বলেন, ‘একদিন এই জার্মান মেশিনগানই হয়তো আমাদের (জার্মানি) দিকে তাক করা হবে।’
মসুলের বোমা বিধ্বস্ত ঘরবাড়িগুলোই আইএস যোদ্ধাদের ব্যারাক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুরো মসুলজুড়ে এ ধরনের ব্যারাকের সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। এগুলো পুরো শহরজুড়ে এমনভাবে ছড়িয়ে আছে যে, এদের ধ্বংস করতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে পুরো মসুলই ধ্বংস করে দিতে হবে।
সব দেখে-শুনে ইয়োগেনের মনে হয়েছে, পশ্চিমা বিশ্বের হস্তক্ষেপ বা যুদ্ধ বিমান থেকে হামলা চালিয়ে আইএসকে হারানো যাবে না। যদিও কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র সফল বিমান হামলার দাবি করেছে। তবু ইয়োগান বলেন, ‘একজন সাধারণ মানুষকে আঘাতকারী প্রতিটি বোমার সঙ্গে সঙ্গে আইএস জঙ্গির সংখ্যাও বাড়বে।’
মসুল থেকে ফিরে আসার দুইদিন পর গত সপ্তাহে জার্মানির একটি টেলিভিশনকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ইয়োগেন জানান, একটি কার্যকরী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আইএস যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। আইএসের আছে সমাজকল্যাণ বিষয়ক বিভাগ, আছে শিক্ষাব্যবস্থা। এমনকি আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েদের শিক্ষার বিষয়টি নিয়েও তাদের পরিকল্পনা রয়েছে।
তবে এসব কিছুর মধ্যে সবচেয়ে যে বিষয়টি ইয়োগনারকে উদ্বিগ্ন করেছে সেটি হলো, আইএস যোদ্ধারা বিশ্বাস করে যে, যেসব ধর্ম গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে তাদের অবশ্যই মরতে হবে।
আইএস যোদ্ধাদের এটা বিশ্বাস করানো হয় যে, তারা একদিন গোটা বিশ্ব জয় করবে। এবং যারা আইএসের দেওয়া পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যায় বিশ্বাস করে না, তাদের হত্যা করতে হবে। তবে শুধু কোরআনে বর্ণিত দুটি ধর্মের মানুষকে হত্যা থেকে বিরত থাকবে আইএস, এ দুটি ধর্ম হলো ইহুদী ও খ্রিস্টান।
ইয়োগেন বলেন, ‘মানব ইতিহাসে এটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় ধর্ম নির্মূলকারী কৌশল।’
ইয়োগেনের এসব অভিজ্ঞতা প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
আইএস অধ্যুষিত অঞ্চলে ১০ দিন কাটিয়ে আসার অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘টেন ডে’জ ইন ইসলামিক স্টেট’ নামে একটি বই লেখার পরিকল্পনা করছেন ইয়োগেন টডেনহুফার। তিনি জানান, সব সময়ই দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে সংবাদ পরিবেশন করতে পছন্দ করেন তিনি। জীবনে ৫০ বছর বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সাংবাদিকতা করেছেন তিনি। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার পাশাপাশি আল কায়েদা নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেন তিনি। এ ছাড়া আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সাক্ষাৎকার যেমন নিয়েছেন তেমনি নিয়েছেন তালেবান নেতাদেরও।
ইয়োগেনের মতে, সহাবস্থানের জন্য আইএস শিগগিরই পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দেবে। তবে একমাত্র ইরাকের উদারপন্থী সুন্নিরাই এটিকে বন্ধ করতে পারে বলে মনে করেন তিনি। ইয়োগেন আরো বলেন, ‘আপনি যদি প্রতিপক্ষকে হারাতে চান তাহলে অবশ্যই তাকে পুরোপুরি জানতে হবে।’