মুসলিম ফিরেছেন কিন্তু মরদেহ হয়ে
প্রতিদিনের মতো কার্যালয়ে বসে কাজ করছিলেন মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের ফাস্ট সেক্রেটারি (শ্রম) মুসাররাত জেবিন। যেসব শ্রমিকের কোনো কাগজপত্র নেই তাঁদের ‘ট্র্যাভেল পাস’ দিচ্ছিলেন। এ সময় জেবিন দেখেন এক লোক আসছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। জেবিনের কাছে এসেই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘একটা ট্র্যাভেল পাসের ব্যবস্থা করে দিন, আমি দেশে চলে যাব।’
মুসাররাত জেবিন তাঁর নাম জানতে চান। লোকটি জানান, মুসলিম উদ্দিন, বাড়ি কক্সবাজার। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র না থাকায় প্রথমে মুসলিমকে রোহিঙ্গা বলে সন্দেহ করেন জেবিন। পরে শরীরের এ অবস্থা দেখে জেবিন নিজে কক্সবাজারে খোঁজ নেন। নিশ্চিত হন মুসলিমের বাড়ি কক্সবাজারেই; তিনি বাংলাদেশি। ‘ট্র্যাভেল পাস’ মিললেও অসুস্থ শরীরের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না মুসলিমের। জেবিন নিজেই মুসলিমকে স্থানীয় আম্পাং হাসপাতাল নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন।
গত ২৭ নভেম্বর বেলা ১১টায় হাসপাতালে মারা যান মুসলিম। দেশে ফেরার জন্য মুখিয়ে ছিলেন। ২৮ নভেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি-০৮৭ ফ্লাইটে করে দেশে ফিরেছে মুসলিমের মরদেহ।
এরপরই সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে জানা যায় মুসলিম উদ্দিনের যাবতীয় তথ্য। বৈধ পথে নয়, অধিক উপার্জনের আশায়, স্বজনদের সুখে রাখার জন্য অবৈধ পথে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে দেশ ত্যাগ করেন মুসলিম।
এর আগে শেষ সম্বল মাঠের ধানিজমি বিক্রি করে দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা স্থানীয় দালালের হাতে তুলে দেন মুসলিম। লক্ষ্য একটাই, যে কোনো মূল্যে পৌঁছাতে হবে মালয়েশিয়া। অবশেষে দালালের অমানুষিক শারীরিক অত্যাচার, আটদিন অনাহারে থেকে কঠিন সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে গত ফেব্রুয়ারি মাসে মালয়েশিয়া পৌঁছান মুসলিম উদ্দিন।
মুসলিম উদ্দিনকে মানবপাচারকারীরা পেনাংয়ের এক জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে পালিয়ে যায়। অপরিচিত স্থান, বৈধ কাগজপত্র না থাকায় ও ভাষা না জানায় মুসলিম উদ্দিনকে পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে থাকতে হতো।
বৈধ কাগজপত্র ছাড়া নিজ দেশেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। পাওয়া যাচ্ছে না কাজও। এভাবে অর্ধাহারে, অনাহারে কেটে যায় আট মাস।
অনাহার আর পুলিশের আতঙ্কে মুসলিম অসুস্থ হয়ে যান। তাঁর একটি ‘পা’ অবশ হয়ে যেতে থাকে। এক পায়ে হাঁটাও অসম্ভব হয়ে পড়ে মুসলিমের জন্য। বিপদ দেখে প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাহায্য চান মুসলিম। পাসপোর্ট না থাকায় প্রবাসীরা মুসলিমকে কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ দূতাবাসে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পরে এক প্রবাসীর সহযোগিতায় পেনাং থেকে প্রায় সাড়ে ৪০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে গত ২৪ নভেম্বর সকালে দূতাবাসে পৌঁছান মুসলিম।
সেখানেই মুসলিম উদ্দিনের দেখা পান বাংলাদেশের দূতাবাসের কর্মকর্তা জেবিন। হাসপাতালে ভর্তি করার পর চিকিৎসকরা জানান, মুসলিমের একটি পা অবশ্যই কেটে ফেলতে হবে। মুসলিমের পরিবারকে ফোনে বিস্তারিত জানালে পরিবারের সম্মতিতে মুসাররাত জেবিন মুসলিমের চিকিৎসা ভার নেন। কিন্তু অস্ত্রোপচার করে একটি পা কেটে দেওয়ার পরেও মুসলিমকে বাঁচানো যায়নি।
হাসপাতালে মুসলিমের চিকিৎসার খরচ পড়ে চার হাজার রিঙ্গিত। বাংলাদেশের দূতাবাসের সহযোগিতায় কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তা মওকুফ করে দেন।
দূতাবাসের কর্মকর্তা মুসাররাত জেবিন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘অবৈধভাবে আসা অনেকেই মালয়েশিয়ায় আছে। অবৈধভাবে এলে মানুষকে তাহলে মুসলিম উদ্দিনের মতো খেসারত দিতে হবে। এভাবে এক মুসলিম উদ্দিন না হাজার মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দূতাবাসকে একজন নয়, হাজার মানুষের সমস্যা দেখতে হয়।’ অবৈধভাবে মালয়েশিয়া না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন তিনি।