‘ভারতের কন্যা’ দেখে ব্রিটেনের কন্যার কাতরতা
একজন পুরুষ ধর্ষণ করে কীভাবে বলেন, যা হয়েছে নারীটির ভুলের কারণেই হয়েছে। বিবিসির আলোচিত প্রামাণ্যচিত্র, ‘ইন্ডিয়াস ডটার (ভারতের কন্যা)’ দেখার পর যুক্তরাজ্যে যৌন নিগ্রহের শিকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ লেখিকা পাবান আমারা এই মন্তব্য করেছেন। সম্প্রতি দি ইনডিপেনডেন্টে এক নিবন্ধে তিনি এই প্রামাণ্যচিত্র ও ভারতে ধর্ষণের পরিবেশ নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
পাবান বলেন, গত রোববার আমি বিবিসির প্রামাণ্যচিত্র ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ দেখার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ২৫ মিনিট পর এটি বন্ধ করে দিই। আমার জন্য এটি ছিল খুবই যন্ত্রণাদায়ক এবং এটি আমার নিজের দুঃসহ অভিজ্ঞতাকেই মনে করিয়ে দেয়।’
২৩ বছর বয়সী এক মেডিকেল ছাত্রীর (পরে নাম দেওয়া হয় নির্ভয়া) গণধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ নামের তথ্যচিত্র। ঘণ্টাব্যাপী তথ্যচিত্রটির ২৪ মিনিট ১০ সেকেন্ডে ধর্ষণকারীদের একজনকে ধর্ষণের কারণে নারীর কী কী শারীরিক ক্ষতি হয় তা পড়ে শোনানো হয়। ওই সময় ধর্ষক ছিল প্রতিক্রিয়াহীন।
পাবান বলেন, তিনি তথ্যচিত্রে ধর্ষণের শিকার নারীর পরিবার, বন্ধু, আসামিপক্ষের আইনজীবী এবং ধর্ষকদের সাক্ষাৎকারের অংশটুকু দেখেছেন।
যৌন নিগ্রহের শিকার হওয়া নিজের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে পাবান বলেন, ‘ভারতে নয়, কয়েক বছর আগে আমি লন্ডনে যৌন নিগ্রহের শিকার হই। আদালতে আমার শারীরিক ক্ষতির ব্যাপারে ওই ব্যক্তির কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। ওই সময় তার কোনো উত্তর ছিল না। আরো ছিল না কোনো দুঃখপ্রকাশ, ক্ষমাপ্রার্থনা, অনুশোচনা বা কোনো উল্লাস। এর কোনো ব্যাখ্যাও ছিল না।’
পাবানের মতে, ‘কোনো কিছু না বলার অনুভূতি কতটা ভয়ঙ্কর হয়, তা বর্ণনাতীত। এটি কোনো আঘাত বা ক্ষত অথবা অশ্রুর চেয়েও বেশি আঘাত দেয়। ধর্ষণের শিকার নারীকে সারা জীবন এটি বয়ে বেড়াতে হয়, এখান থেকে পালানোর কোনো পথ নেই। তুমি কিছুই করতে পারবে না, তুমি এটি বিশ্লেষণ করতে পারবে না অথবা এটি থেকে সরেও যেতে পারবে না। এটি শুধু শূন্যস্থান এবং তুমি কখনোই জানতে পারবে না কেন এ ঘটনা ঘটল।’
দিল্লিতে মেডিকেল ছাত্রীর ছয় ধর্ষণকারীর একজন মুকেশ সিং তথ্যচিত্রের সাক্ষাৎকারে তাঁদের কাজের পেছনের কোনো ব্যাখ্যা দেননি। পাবান বলেন, ‘মুকেশ বলেনি কেন তারা নির্ভয়ার অঙ্গে গভীর ক্ষত করেছে, মেরেছে, মাথায় আঘাত করেছে, যার কারণে একসময় তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এটি মনে করিয়ে দেয় একজন ধর্ষক নারীর অঙ্গ, চামড়া, রক্ত, হাড় নিতে পারে এবং এরপরও তার কাছ থেকে কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে না। এখনো অনেকে যুক্তি দিয়ে ধর্ষণের জন্য নারীকেই দায়ী করে।’
ধর্ষকদের আইনজীবী এম এল শর্মা বলেছেন, ‘নর্দমায় একটি ফুল ফেলে দিলে তা নষ্ট হবেই।’ এই কথায় ধর্ষণের শিকার নারীকেই কি দায়ী করা হয় না?
ভারতের জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, সেখানে প্রতিদিন গড়ে ৯২ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। দেশটির ৪১ শতাংশ নারী তাদের স্বামীর দ্বারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন। প্রতি ঘণ্টায় যৌতুকের কারণে একজন নারীর মৃত্যু হয়। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রায় ৩০ লাখ নারী নিখোঁজ হয়েছে। মেয়েশিশুর ভ্রূণ হত্যার সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এই সংখ্যা নেহাত কম নয়। আর জন্ম নেওয়ার পরও অনেক মেয়েশিশুকে হত্যা করা হয়।
২০১১ সালে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের বিশ্বব্যাপী করা একটি জরিপে নারীদের জন্য বিপজ্জনক রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের অবস্থান চতুর্থ।
এবার ভারত ও যুক্তরাজ্যের যৌন সহিংসতার পরিসংখ্যানের তুলনা করা যাক। ভারতের পুলিশের তথ্যমতে, প্রতি ২০ মিনিটে সেখানে একজন নারীর ধর্ষণের শিকার হওয়ার খবর পাওয়া যায়। অপরদিকে যুক্তরাজ্যের পুলিশ বলছে, ব্রিটেনে প্রতি ৪০ মিনিটে একটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভারতের আদালতে ২৪.২ শতাংশ ধর্ষণের মামলায় সাজা হয়। যুক্তরাজ্যে এই হার ৭ শতাংশ।
২০০৫ সাল থেকে ভারতের হাসপাতাল, আদালত ও পুলিশ স্টেশন ধর্ষণের শিকার নারীকে বিনামূল্যে সেবা দিচ্ছে। কিন্তু যুক্তরাজ্যে এই চিত্র আলাদা। সেখানে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ১৫৬টি এনএইচ ট্রাস্ট রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতে প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে যেখানে বাস সার্ভিস, একটি হাসপাতাল নেই সেখানে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিতে যেতে হয়, এই সেবাও ব্যয়বহুল।
ভারতের কয়েকটি শহরে ধর্ষণের শিকার নারীদের সহায়তা দেওয়ার জন্য সেন্টার রয়েছে কিন্তু অর্থাভাবে এগুলোর দৈন্যদশা।
তথ্যচিত্রে দেওয়া সাক্ষৎকারে মুকেশ সিং বলেছেন, ‘তুমি এক হাতে তালি বাজাতে পারবে না.... একটি ভদ্র মেয়ে রাতে কখনো ঘুরে বেড়াবে না, ভুল কাজ করবে না, খারাপ পোশাক পরবে না।’ দিল্লি কারাগারে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া এক ধর্ষকের মুখ থেকে এই কথা বেরিয়েছে।
মুকেশ সিংয়ের কথার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ একমত। ২০০৫ সালে অ্যামিনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এক হাজার প্রাপ্তবয়স্ক ব্রিটিশের ওপর ধর্ষণ বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জরিপ চালায়। এর ফলাফলে দেখা গেছে, ২৬ শতাংশ বিশ্বাস করে খোলামেলা পোশাক পরার কারণে ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আর জরিপে অংশ নেওয়াদের এক-তৃতীয়াংশ মনে করে, ছলনাময়ী অথবা মদ্যপায়ী নারী ধর্ষণের শিকার হওয়ার জন্য নিজেই দায়ী।
পাবান বলেন, “মুকেশ সিং যখন একজন ‘ভদ্র মেয়ে’ সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির কথা জানাচ্ছিলেন, তখন আমি তথ্যচিত্র দেখায় কিছুক্ষণ বিরতি নিই। আমার নিজের পরিবার উত্তর ভারতের একটি গ্রামে বসবাস করে। সেখানে একটি ভদ্র মেয়ে বলতে শান্ত, অন্যের নিয়ন্ত্রণে থাকা মেয়েদের বোঝায়। কারণ, ভারতীয় সংস্কৃতি অনুযায়ী মেয়েরা বাবা-মায়ের পছন্দের পুরুষকে বিয়ে করে এবং বাকি জীবন তার সঙ্গে রাত্রিযাপন করে, স্বামীর ইচ্ছায় গর্ভধারণ করে এবং সমাজ তার কাছ থেকে ছেলেসন্তান আশা করে। সুতরাং এখানে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে মুকেশ সিং চেয়েছিল ধর্ষণের সময় জ্যোতি সিং পাণ্ডের ‘চুপ থেকে ধর্ষণ হতে দেওয়া উচিত ছিল, ধর্ষণে বাধা দেওয়া উচিত হয়নি।’ তাঁর সংস্কৃতি তাকে যা শিখিয়েছে, তিনি তাই বলেছেন। ধর্ষণের হিন্দি ‘ইজ্জত লুটনা’—যার অর্থ ‘সম্মান হরণ করা।’ ভারতে একজন নারী ধর্ষণের কথা প্রকাশ করা ভালোভাবে দেখা হয় না। সমাজে তাঁকে হেয় করা হয়।”
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মারিয়া মিশ্রা এই তথ্যচিত্রের কয়েকটি দিক চিহ্ণিত করেছেন। ২০১২ সালের আগে এখানে একটি বিশ্বাস কাজ করত, ধর্ষণের শিকার নারীর বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই শ্রেয়। তা না হলে তাকে চলন্ত লাশ হয়ে বেঁচে থাকতে হয়। এই কারণে ধর্ষণের খবর খুব কমই প্রকাশ পেত। কিন্তু দিল্লিতে ওই নারীকে ধর্ষণের পর হত্যার খবর সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। শহরের হাজারো নারী নির্যাতনের অভিযোগ করে। এক বছরের মধ্যে ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ তিনগুণ বেড়ে যায়। ২০১১-১২ সালে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা হয়েছিল এক হাজার ৪৩৩টি। ২০১২-১৩ সালে এই সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চার হাজার ১৭৪।
পাবান বলেন, “কয়েক প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই নেতিবাচক মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে ভারতবাসী পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা ধর্ষণের শিকার ওই নারীর নাম দিয়েছে ‘নির্ভয়া’। ধর্ষণের পর আশঙ্কাজনক অবস্থায় সাফদারজং হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই তারা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে, তিনি তার সম্মান হারাননি। হাসপাতালের গেটের বাইরে জনগণ একটি ‘সংহতি কর্নার’ তৈরি করে। আমি কয়েক মাস আগে সেখানে গিয়েছিলাম। এখনো সেখানে ফুল দেওয়া হয়, মোমবাতি জ্বালানো হয়। দিল্লি পুলিশ নারীদের জন্য হেল্পলাইন চালু করেছে। প্রথম ছয় সপ্তাহেই দুই হাজার কল আসে। এখানে নারীদের জন্য আরো টয়লেট, সারা দিল্লিতে পরিবহন সেবা ও সড়ক বাতি ব্যবস্থার উন্নতি করতে পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।”
২০১২ সালের ডিসেম্বরে চলন্ত বাসে ধর্ষণের শিকার হন মেডিকেল শিক্ষার্থী নির্ভয়া। ধর্ষণের পর নির্ভয়া ও তাঁর বন্ধুকে বাস থেকে ফেলে দেওয়া হয়। এ ঘটনায় ভারতসহ বিশ্বজুড়ে তোলপাড় হয়।এ ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত চারজনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। তাদের একজন বাসচালক মুকেশ সিংয়ের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয় ‘ইন্ডিয়াস ডটার’ নামের প্রামাণ্যচিত্রে। এতে ধর্ষণে বাধা দেওয়া ও অপরাধের জন্য ওই মেডিকেল ছাত্রীকেই দায়ী করে মুকেশ সিং। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর জের ধরেই প্রামাণ্যচিত্রটির প্রচার বন্ধ করে ভারত সরকার।