পর্বতেই চিরঘুমে ‘পর্বতের রাজা’
‘পর্বতের রাজা’ ছিল তাঁর ডাকনাম। হবেই বা না কেন? সাতটি মহাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ যে ছিল তাঁর পায়ের তলায়। ২০০৬ সালে বিশ্বরেকর্ড গড়ে মাত্র ১৭২ দিনে এশিয়ার এভারেস্ট, আফ্রিকার কিলিমনজারো, ইউরোপের এলব্রুস, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় পর্বত ডেনালি আর আকোংকাগুয়া, অস্ট্রেলিয়ার কসকিউসকো এবং অ্যান্টার্কটিকার ভিনসন পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছিলেন তিনি।
ছোটবেলা থেকেই যে পর্বতই ছিল তাঁর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু, ভালোবাসার জায়গা-শেষে সেই পর্বতের কোলে মাথা রেখেই চিরঘুমে চলে গেলেন ভারতের অধিবাসী 'পর্বতের রাজা'-খ্যাত মাল্লি মাস্তান বাবু।
২৪ মার্চ আর্জেন্টিনা ও চিলির সীমানায় অবস্থিত সাড়ে ছয় হাজার মিটার উচ্চতার ‘সেরো ত্রেস ক্রুসেস’ শৃঙ্গজয়ে বের হন তিনি। এর পর থেকে তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায় অভিযানে গিয়েছিলেন বাবু।
আজ সকালে চিলির নিরাপত্তা বাহিনী উদ্ধারকর্মীদের সূত্রে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশটির সংবাদমাধ্যমকে জানায়, হারিয়ে যাওয়া পর্বতারোহী মাল্লি মাস্তান বাবুর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।এনডিটিভিকে তাঁর মৃত্যুর খবরটি নিশ্চিত করেছেন বাবুর বন্ধু, ভারতের আরেক বিখ্যাত পর্বতারোহী সত্যম ভীমারাসেত্তি। তিনি জানিয়েছেন, ওই অঞ্চলে কয়েকদিন ধরে চলা প্রবল বৃষ্টির কারণে উদ্ধারকাজে সমস্যা হচ্ছিল। দুর্যোগ কাটায় গতকাল শুক্রবার হেলিকপ্টারে করে পর্বতের বুকে তাঁর খোঁজে অভিযান চালানো হয়। শেষ পর্যন্ত আজ শনিবার তাঁর মৃতদেহের সন্ধান মেলে।
টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, আজ শনিবার দুপুরে সন্ধান মেলে মাল্লি মাস্তান বাবুর। পর্বতে একখণ্ড পাথর আঁকড়ে তিনি সটান শুয়ে ছিলেন।
মাস্তান বাবু নিখোঁজ হওয়ার পর টুইটার ও ফেসবুকে তাঁর ভক্তরা ‘রেসকিউ মল্লি মাস্তান বাবু’ নামে পেজ তৈরি করেন। সেখানেও শনিবার তাঁর মৃত্যুর খবরটি জানানো হয়। এ ছাড়া তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় ভারতসহ অনেক দেশের মানুষ হ্যাশট্যাগে তাঁর নাম লিখে পোস্ট করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সৈয়দ আকবর উদ্দিনও তাঁর মৃত্যুতে টুইট করে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দুর্গম পর্বত অভিযানে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছিলেন এই পর্বত অভিযাত্রী। কলম্বিয়ার সিয়েরা নেভেদার ক্রিস্টোবাল শৃঙ্গে প্রথম অভিযানের জন্য তাঁর নাম পর্বতারোহীদের মধ্যে কিংবদন্তিতুল্য বলে জানিয়েছে এনডিটিভি। স্থানীয় বাসিন্দারা এই অভিযানের সময় তাঁকে বারবার নিষেধ করেছিলেন। কিন্তু অসম সাহসী মাল্লি সব বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে জয়ী হয়েছিলেন। শেষ অভিযানেও আর্জেন্টিনা ও চিলির ১৪টি শৃঙ্গজয়ের লক্ষ্য স্থির করেছিলেন তিনি। প্রতিটি শৃঙ্গই ছয় হাজার মিটারের বেশি উচ্চতার। ২০১২ সালের অক্টোবর মাস থেকে এই অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তিনি।
মল্লি মাস্তান বাবুর জন্ম, বেড়ে ওঠা ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশের নেলোরে। তাঁর ঘরের জানালা থেকেই দেখা যেত প্রদেশটির বিখ্যাত কাপ্পাকোন্ডা আর কান্দেরমারাই পর্বত। ছোট থেকেই পর্বত তাঁকে ডাকত বোধহয়। আর তাই মাত্র ১১ বছর বয়সেই বাড়ির কাছের প্রায় চার হাজার ফুটের আর্মাকোন্ডা পর্বতশৃঙ্গ জয় করেছিলেন তিনি।
ভারতের বিখ্যাত খগড়পুর আইআইটি ও কলকাতার আইআইএম থেকে পাশ করা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি। কিন্তু কোনো চাকরি তাঁর ধাতে সয়নি। পর্বতে ওঠাকেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন পেশা ও নেশা হিসেবে। আর তাই হয়তো চিরঘুমে যাওয়ার জায়গা হিসেবে বেছে নিলেন প্রিয় পর্বতকেই।