বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বিদেশি জঙ্গিদের আশ্রয়স্থল!
ঢাকার ব্লগার ওয়াসিকুর রহমান অসহিষ্ণুতার সর্বশেষ শিকার। গত ৩০ মার্চ সকালে রাস্তায় প্রকাশ্যে তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশে এ অসহিষ্ণুতার বিস্তার ঘটেছে কট্টর ইসলামপন্থীদের দ্বারা। অল্প কদিন আগে অভিজিৎ রায় নামের অপর এক ব্লগারকে হত্যা করা হয়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করতেন এবং প্রায়ই দেশে বেড়ে চলা ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা নিয়ে লেখালেখি করতেন। ঢাকার রাস্তায় স্ত্রীর সামনেই তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
বাংলাদেশে ইসলামী চরমপন্থীদের উত্থানের বিষয়টি নতুন কিছু নয়। গবেষক মোহাম্মদ গোলাম কবিরের তথ্য অনুযায়ী, গত শতাব্দীর ৭০-এর দশকে জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উদার মুসলিম দেশ থেকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিবর্তন করতে সক্ষম হন। গত কিছু দিনে একসময়ের বৈধ রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে কঠিন পরীক্ষার মুখে ফেলা হয়েছে।
বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার দলটিকে নিষিদ্ধ করার পথে রয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর অনেক শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে একাত্তরে পাকিস্তান বাহিনীকে সহায়তা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনায় বিচার চলছে। যা হোক, ২০০৫ সালে কবি শামসুর রহমানের ওপর হরকাতুল জিহাদের (হুজি) হামলা এবং পরবর্তীকালে একই ধরনের আরো ঘটনায় বাংলাদেশে কট্টরপন্থীদের উত্থানের বিষয়টিকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে।
ভারতের সাপ্তাহিক দ্য সানডে গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদন এভাবেই শুরু করা হয়েছে। পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক এম জে আকবর। তিনি ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র এবং সরকারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
৪ এপ্রিল ‘বাংলা-মিয়ানমার সীমান্ত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য সন্ত্রাসের হুমকি’ শিরোনামে প্রকাশিত এ প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা আল-কায়েদা, তালেবান ও উজবেক জঙ্গিদের মতাদর্শী উদ্বাস্তুদের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে মিয়ানমারের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত। এখানেই কক্সবাজার শহরের কাছে উখিয়ায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বৃহত্তম উদ্বাস্তু শিবির। কুতুপালং নামের এই উদ্বাস্তু শিবিরে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলমানের বাস। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ঘোষিত যুদ্ধের নজর থেকে এটি অনেক দূরে। বিশ্বের ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো এখান থেকেই সবার নজর এড়িয়ে নিভৃতে সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্র তৈরি করেছে। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারাই জঙ্গিদের প্রাথমিক লক্ষ্য।
দ্য সানডে গার্ডিয়ান দাবি করেছে, রোহিঙ্গাদের জিহাদের প্রশিক্ষণে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবির সক্রিয় বলে তারা জানতে পেরেছে।
ভারতের নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর ডিফেন্স স্টাডিজ অ্যান্ড অ্যানালাইসিসের (আইডিএসএ) দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও নিরাপত্তা গবেষক শ্রুতি এস পট্টনায়েক বলেন, ‘শিবির রোহিঙ্গাদের প্রশিক্ষিত করেছে এবং এদের কয়েকজন আফগানিস্তানের জিহাদের অংশ নিয়েছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রোহিঙ্গা ছাত্র সংগঠন আরএসওর সঙ্গে জঙ্গি সংগঠন হুজি ও অন্যান্য চরমপন্থী সংগঠনের সম্পর্ক আছে। এটি ভয়াবহ হুমকির, দেশের জন্য এটি মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। ১৯৮০ সালে আরএসও গঠিত হয়। গঠনের পর থেকেই সংগঠনটি আফগানিস্তানের হিজব-ই-ইসলাম ও হিজবুল মুজাহিদিনের মতো ‘সমমনা’ চরমপন্থী দলগুলোর সমর্থন পেয়ে আসছে।’
২০১৪ সালের ২ অক্টোবর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার খাগরাগড়ে একটি বাড়িতে বিস্ফোরণ ঘটে। ওই ভবনেই তৃণমূল কংগ্রেসের একটি কার্যালয় ছিল। জানা যায়, বিস্ফোরণের জন্য অভিযুক্ত একজন রোহিঙ্গা জঙ্গি। পরে হায়দরাবাদ থেকে খালেদ মোহাম্মদ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে ভারতের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ। তাঁরা দুজনই উপমহাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই তৈয়েবার (এলইটি) কাছ থেকে প্রশিক্ষণ পেয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
২০১৩ সালে বিহারের বুদ্ধগয়ায় বোমা হামলা হয়, যার লক্ষ্য ছিল মহাবধি মন্দির কমপ্লেক্স। এনআইএ এই হামলার জন্য ভারতের মুজাহিদিনদের দায়ী করেন। কিন্তু বুদ্ধগয়ায় তাদের হামলা চালানোর যৌক্তিকতা ও কারণ নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সন্দেহের তীর যায় রোহিঙ্গাদের দিকে। এর যথেষ্ট কারণও আছে। মিয়ানমারের কাচিন ও রাখাইন প্রদেশে জান্তা এবং ‘৯৬৯ আন্দোলন’ নামক আন্দোলকারীদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হন রোহিঙ্গারা।
চরমপন্থী বৌদ্ধ সংগঠন ‘৯৬৯ আন্দোলন’-এর নেতা বৌদ্ধভিক্ষু ভাইকু ইরাথু। ২০১৩ সালে ভারতের এক সাময়িকীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, উত্তর মিয়ানমারে ইসলামিক চরমপন্থীদের অস্তিত্ব থাকা পর্যন্ত তাদের কার্যক্রম চলবে। উগ্র বৌদ্ধ সংগঠন ও জান্তার অযাচিত সহিংস ধর-পাকড়ের কারণে রোহিঙ্গারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা হাডসন ইনস্টিটিউটের ২০০৬ সালে এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিন লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং তারা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে যেতে বাধ্য হয়েছে। এর পরে সংখ্যাটি দ্বিগুণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
মিয়ানমার এবং বহত্তর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াবিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থের লেখক ও প্রখ্যাত সাংবাদিক বার্টিল লিন্টনার। তাঁর লেখায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের চরমপন্থীদের বিষয়ও পাওয়া যায়। লিন্টার চরমপন্থার উত্থানে কয়েকটি চরমপন্থী অংশের নাম উল্লেখ করেন, যার মধ্যে আছে শিবির, ইসলামী ঐক্যজোট, আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (এআরএনও) ও অপর কয়েকটি সংগঠন। বাংলাদেশ ও এর সীমান্তবর্তী মিয়ানমারে আল-কায়েদা বা এর সংশ্লিষ্ট উজবেক সংগঠন ও তালেবানের মতো বিদেশি জঙ্গি ভাবধারার এক গোষ্ঠী মানুষ আছে।
গবেষক শ্রুতি এস পট্টনায়েক বলেন, ‘উজবেক গোষ্ঠীর ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে লিন্টনারের প্রতিবেদনে জানা গেছে, বাংলাদেশি আল-কায়েদা যোদ্ধাবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রামে নোঙর করেছিল। আল-কায়েদার উপস্থিতি কেউ উড়িয়ে দিতে পারবে না। বাংলাদেশে এলইটি বেশ সক্রিয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘গত কয়েক বছরে এলইটির বেশ কয়েকটি গোপন আস্তানায় অভিযান চলেছে। যেমন- হাটহাজারী মাদ্রাসা জঙ্গিদের শিবির হিসেবে ব্যবহার হতো। সম্প্রতি ঢাকায় জাল ভারতীয় মুদ্রাসহ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। এই সংগঠকদের দুটি লক্ষ্য। প্রথম লক্ষ্য বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ সরকার। আর দ্বিতীয় লক্ষ্য হলো ভারত।’