মন্দিরের সোনার দিকে মোদির চোখ!
থিতিয়ে পড়া ভারতীয় অর্থনীতিতে গতি ফেরানোর প্রতিজ্ঞা নিয়ে ক্ষমতায় আরোহণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। কট্টর হিন্দুত্ববাদী হলেও, মোদি সরকারের কর্মকৌশলে গুজরাটের আহমেদাবাদের মতো পুরো দেশের শিল্প-বাণিজ্যে সমৃদ্ধি জাগবে, এমন ভরসা দেশটির অধিকাংশ মানুষের। ভরসার প্রতিদান দিতে পরিকল্পনা আর কৌশলে ঘাটতি রাখছে না মোদি সরকারও। তাই এবার সরকার মনোযোগ দিয়েছে মন্দিরে রক্ষিত সোনার দিকে। সোনার বাজারে ঘাটতিজনিত সংকট কাটাতে সরকার দারস্থ হতে চায় মন্দির কর্তৃপক্ষের, জানিয়েছে রয়টার্স।
রত্নভরা মন্দির
ভারতের মুম্বাইয়ে ২০০ বছরের পুরোনো শ্রী সিদ্ধিবিনায়ক মন্দির। হিন্দু দেবতা গণেশের এই মন্দিরটি দিনমান ক্লোজসার্কিট ক্যামেরার নজরে থাকে। নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন ৬৫ জন রক্ষী। ভারতের অন্যতম ধনী মন্দির বলে নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র ফাঁকি নেই। সেখানে গচ্ছিত আছে প্রায় ১৫৮ কেজি সোনার অর্ঘ্য, যার মূল্য প্রায় ছয় কোটি ৭০ লাখ ডলার।
রয়টার্স জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সোনার বাজার ভারত। দেশটির প্রাচীন মন্দিরগুলোতে জমা আছে ভক্তদের উৎসর্গ করা বিপুল সোনার অলংকার, বাট ও মুদ্রা। এসবের মূল্য হাজার হাজার কোটি ডলার। কঠোর নিরাপত্তায় আধুনিক বা প্রাচীন গড়নের সিন্দুকের মধ্যে রাখা হয় এসব মূল্যবান রত্ন। মাঝেমধ্যে মন্দিরের গোপন কুঠুরিতেও মেলে মহামূল্যবান বস্তু। যেমন কয়েক বছর আগে কেরালার শ্রী পদ্মনাভ স্বামী মন্দিরের গোপন কুঠুরিতে প্রায় দুই হাজার কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের সোনা পাওয়া যায়।
মন্দিরগুলোতে রাখা সোনার মোট পরিমাণ প্রায় তিন হাজার টন, যা যুক্তরাষ্ট্রের কেনটাকির ফোর্ট নক্সে অবস্থিত স্বর্ণভাণ্ডারে গচ্ছিত সোনার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি।
এই বিপুল সোনাকে বাণিজ্য ঘাটতি মেটানোর কাজে লাগাতে চান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর সরকার আসছে মে মাসে একটি প্রকল্প চালু করতে চায়। এই প্রকল্পে মন্দিরগুলোকে তাদের সোনাদানা ব্যাংকের কাছে জমা রাখার জন্য উৎসাহিত করা হবে। আর বিনিময়ে সরকার মন্দিরগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ লভ্যাংশ দেবে।
মোদি সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ
বলা হচ্ছে, সরকার সোনার অলংকারগুলোকে গলিয়ে স্বর্ণকারদের কাছে বিক্রি করবে। এতে বিদেশ থেকে সোনা আমদানির ওপরে চাপ কমবে। দেশটিতে সোনার চাহিদা প্রায় অসীম এবং ২০১৩ সালে ভারতের মোট বাণিজ্য ঘাটতির ২৮ শতাংশের জন্য দায়ী সোনা আমদানি।
ভারতে প্রতিবছর ৮০০ থেকে এক হাজার টন স্বর্ণ আমদানির প্রয়োজন হয়। সরকার ও সোনা ব্যবসায়ীদের ধারণা, মন্দিরে গচ্ছিত সোনা বাজারে ওলে মোট চাহিদার অন্তত চার ভাগের এক ভাগ মিটে যাবে। বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে মোদি সরকারের এ উদ্যোগকে অনেক মন্দিরই স্বাগত জানিয়েছে।
সিদ্ধিবিনায়ক মন্দিরের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নরেন্দ্র মুরারি রানে বলেন, ‘সুবিধাজনক, নিরাপদ ও লাভজনক হলে আমরা সানন্দে আমাদের সোনা ব্যাংকে জমা করব।’ এ মন্দিরের প্রায় অর্ধেকটি সোনায় মোড়ানো।
তবে অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী মন্দিরের সোনার গয়না গলানোর সরকারি পরিকল্পনার সঙ্গে একমত নন। মুম্বাইভিত্তিক এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মতে, তাঁর পরিবার প্রায় ২০০ কেজি সোনা দেশের বিভিন্ন মন্দিরে দান করেছেন। দানকৃত এই সোনা গলিয়ে পুনরায় স্বর্ণালংকার তৈরি করলে পাপ হবে বলে তিনি মনে করেন। ওই স্বর্ণ ব্যবসায়ীর মতে, দান করা সোনা থেকে মুনাফা করতে গেলে সেটি হবে পাপ। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো ট্রাস্টি বোর্ডের কাছে নয়, দানটি করেছি মন্দিরে।’
শুধু মন্দিরই নয়, পারিবারিক স্বর্ণালংকারও কাজে লাগানোর পরিকল্পনা করছে মোদি সরকার। ধারণা করা হয়, ভারতের সাধারণ মানুষের কাছে প্রায় ১৭ হাজার টন সোনা গচ্ছিত আছে।
তবে, পরিবারগুলোকে রাজি করানো সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। কারণ, ভারতীয়রা ব্যাংক বা এর মতো অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তেমন বিশ্বাস করে না। আর কয়েক প্রজন্মের পুরোনো অলংকার তারা হারাতে চাইবে, এমনটা আশা করাও বোকামি।
স্বর্ণালংকার গচ্ছিত রাখার জন্য সুদের হার নির্ধারণের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এর আগেও ১৯৯৯ সালে ভারতে গচ্ছিত স্বর্ণালংকার সরকারের কাছে জমা করার প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, যা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। সুদের হারের স্বল্পতাকেই এ জন্য দায়ী করা হয়। ওই প্রকল্পে সুদ দেওয়া হয় দশমিক ৭৫ থেকে এক শতাংশ। সুদের এই নিম্ন হারের কারণে স্বর্ণাংলকার বা স্বর্ণ জমা হয়েছে মাত্র ১৫ টন।
মোদি সরকারের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলছেন, স্বর্ণাংকারের জন্য সুদের হার বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে সরকার। অনেক মন্দির চাইছে, এ হার যেন কমপক্ষে ৫ শতাংশ হয়। কারণ অধিক সুদের কারণে অনেক মন্দিরের ট্রাস্ট বা পরিবার তাদের সোনা সরকারের হাতে তুলে দিতে পারে।