পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র!
পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানের তৎকালীন সরকারকে ব্যবহার করে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডের ৬৪ বছর পর সম্প্রতি মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত সে সময়কার গোপন নথিপত্র থেকে এ তথ্য উঠে এসেছে।
পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রকাশিত ওই নথির বরাত দিয়ে ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান টুডে জানিয়েছে, পঞ্চাশের দশকে মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোকে ইরানে তেলের চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু লিয়াকত আলী এই অনুরোধে সায় না দেওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়।
পাকিস্তান টুডে-কে লিয়াকত আলী খানের নাতি মুয়াজ্জেম আলী খান জানান, তাঁরা প্রকাশিত নথির ব্যাপারে অবগত আছেন এবং নথির তথ্যগুলো সত্য।
অন্যান্য হাই প্রোফাইল হত্যাকাণ্ডগুলোর মতোই লিয়াকত আলীর হত্যাকাণ্ডটিও রহস্য হয়েই ছিল এতকাল। হত্যাকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। হত্যার সন্দেহভাজন হিসেবে অনেককে জেরাও করেছিল এই কমিশন, সামনে এসেছিল বিভিন্ন রকম মতামতও কিন্তু এর একটিও প্রমাণ করার মতো ছিল না বলে এতদিনেও এই রহস্যের সমাধান হয়নি।
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগে ভাষণ দেওয়ার সময় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন লিয়াকত আলী খান। সেই সময়ে ইরানের তেলক্ষেত্রগুলো থেকে তেল উত্তোলন করতে চাইছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর জন্য তেহরানের সাথে চুক্তি করতে যুক্তরাষ্ট্র লিয়াকতের সাহায্য চায়। ওই সময় পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি উল্টো পাকিস্তান থেকে মার্কিন ঘাঁটি সরানোর দাবি জানান তিনি।
লিয়াকত আলী খানের অনড় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। কিন্তু তখন পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করার মতো কাউকে জোগাড় করতে পারেনি তারা। সিআইএ তখন কৌশলগত কারণে আফগানিস্তানের দিকে নজর দেয়।
গত শতকের পঞ্চাশের দশকের সে সময় দেশ দুটির মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিল তিক্ত। তখনো পাকিস্তানকে মেনে নেয়নি আফগানিস্তান। প্রকাশিত নথি অনুযায়ী, লিয়াকতকে হত্যায় এ তিক্ত সম্পর্ককে কাজে লাগায় ওয়াশিংটন।
সমকালীন আফগান রাজা জহির শাহর কাছে একজন আততায়ী চান কাবুলে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত। বিনিময়ে পাকিস্তান ও আফগান সীমান্তের পাশতুনিস্তানকে স্বাধীনতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। কৌশলগত কারণে এই প্রস্তাবে রাজি হন জহির শাহ এবং আততায়ী হিসেবে সৈয়দ আকবর নামের একজনকে নিয়োগ করেন তিনি। সিআইএর পরামর্শে লিয়াকত আলী খানকে হত্যা করার পর হত্যাকারী আকবরকে হত্যার জন্যও প্রস্তুত রাখা হয় আরো দুজনকে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নথি মোতাবেক জানা গেছে, হত্যাকাণ্ডের একদিন আগে রাওয়ালপিন্ডির একটি আবাসিক হোটেলে ওঠে তিন হত্যাকারী।
পরদিন ১৯৫১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির কোম্পানিবাগ সমাবেশে ভাষণ দিতে দাঁড়ালে লিয়াকত আলী খানকে দুটি গুলি করে আকবর। ৫৬ বছর বয়সী লিয়াকত আলী খানের বুকে লেগেছিল গুলি। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরও বাঁচানো যায়নি প্রধানমন্ত্রীকে।
হত্যাকাণ্ডের পর পরিকল্পনা অনুযায়ী বাকি দুজন ঘাতক আকবরকে গুলি করে মেরে ফেলে। একটু পর ওই দুজনও বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে মারা যায়। ফলে হত্যাকাণ্ডের সব তথ্য-প্রমাণ শেষ হয়ে যায় তখনই।
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পর গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত বুলেট সাধারণভাবে পাকিস্তানের বাজারে পাওয়া যেত না। ওই ধরনের বুলেট পদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারা ব্যবহার করেন বলেও ওই প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল।
পাকিস্তানের জাতির পিতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ডানহাত হিসেবে পরিচিত ছিলেন দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি কায়েদ-এ মিল্লাত, শহীদ-এ মিল্লাত উপাধি পেয়েছিলেন। তিনি আলিগড় ও অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯৩০-এর দশকে ব্রিটিশ ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে উঠে আসেন। পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে ভারতে ফিরে আসতে আগ্রহী করে তোলেন তিনি। এরই ফলশ্রুতিতে একপর্যায়ে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হয় এবং দেশটি স্বাধীনতা অর্জন করে।