লাফিয়ে পড়ে, দৌড়ে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা
অন্য যেকোনো সাধারণ ছুটির দিনের মতোই গতকাল শনিবার দিন শুরু করেছিল নেপালবাসী। ছুটির দিনের জন্য জমানো কাজগুলো গুছিয়ে নিচ্ছিল কেউ, টেলিভিশন সেটের সামনে বসে সিনেমা দেখছিল কেউ, কেউ বসে ল্যাপটপে কাজ করছিল কিংবা ঘরের কাজে ব্যস্ত ছিলেন গৃহিণীরা। ৭ দশমিক ৯ মাত্রার ভূমিকম্পটি যখন নেপালে আঘাত হানে, তখন দিগ্বিদিকশূন্য হয়ে পড়ে তারা।
প্রাণ বাঁচাতে যে কোনোভাবেই হোক না কেন ভবন থেকে বের হতে চাইছিল তারা। সে জন্য ব্যালকনি থেকে লাফও দিয়েছে কেউ কেউ। তবে এত কিছুর পরেও প্রাণে বাঁচেনি দুই হাজারেরও বেশি মানুষ। গতকাল রোববার রাত পর্যন্ত এই ভূমিকম্পে নিহতের সংখ্যা দুই হাজার ৫০০ জন ছাড়িয়েছে।
শক্তিশালী ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকারীরা একপ্রকার খালি হাতেই সেখানে উদ্ধারকাজ শুরু করেছেন। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে আটকে পড়াদের উদ্ধারে জোর প্রচেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে একদল উদ্ধারকারীকে নিয়ে নেপালের সেনা কর্মকর্তা সন্তোষ নেপাল কাঠমান্ডুর একটি ধসে পড়া ভবনের প্রবেশের পথ তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। এই পথ তৈরিতে তাঁদের ব্যবহার করতে হয়েছে কুড়ালের মতো যন্ত্র। কেননা প্রাচীন এই শহরের সড়কগুলো বুলডোজার যাওয়ার মতো প্রশস্ত নয়। তবে এখনো বিভিন্ন ভবনে অনেক মানুষ আটকা পড়ে আছে বলে রয়টার্সকে জানিয়েছেন সন্তোষ।
এদিকে একদিন পর আবারও একটি ভয়াবহ কম্পন অনুভূত হয়েছে নেপালে। গতকাল রোববার দুপুর ১২টা ৫৪ মিনিটে নেপালে এই ভূমিকম্প হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইউএসজিএস জানিয়েছে, এই ভূকম্পনের মাত্রা ছিল ৬.৭। ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল ছিল নেপালের কাঠমান্ডু থেকে ১৭ কিলোমিটার দক্ষিণের কোদারিতে। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
গতকাল মূল ভূমিকম্পের সময় উন্নয়নকর্মী লুইটেল কাঠমান্ডুতে তাঁর বাসায় বসে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান উপভোগ করছিলেন। এমন সময় তাঁদের ভবনটি ভয়ানকভাবে কাঁপতে শুরু করে। আশপাশের বাড়িগুলো থেকে মানুষ দৌড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে। হিন্দুস্তান টাইমসকে লুইটেল জানান, প্রথম তাঁরা হুড়োহুড়ি না করে শান্ত থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কম্পন এতই বাড়তে থাকে যে একপর্যায়ে ঘরের কাঠের আলমারিটি লুইটেলের স্ত্রীর শরীরে এসে পড়ে। এরপর তারা দ্রুত দৌড়ে বাড়ির বাইরে আসেন। তবে ভূমিকম্প শেষ হয়ে যাওয়ার পরও ঘরে ফিরতে ভয় পাচ্ছিলেন তাঁরা। কারণ কিছুক্ষণ পরপরই ছোট ছোট কম্পন অনুভূত হচ্ছিল।
পশু অধিকার কর্মী কামাল সুবেদির অভিজ্ঞতাও প্রায় একই রকম। ভূমিকম্পের সময় তিনি ছিলেন কাঠমান্ডু থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের চিতওয়ান শহরে। হিন্দুস্তান টাইমসকে তিনি বলেন, ‘ঘরে বসে ল্যাপটপে কাজ করছিলাম। তখনই ভূমিকম্পটা শুরু হলো। আশপাশের ভবনগুলোর মানুষ ভয়ে ব্যালকনি থেকে লাফ দিতে শুরু করে। পাশের একটি তিনতলা ভবন থেকে লাফ দেওয়ার পর এক বৃদ্ধ মারা গেছেন বলেও জানতে পারি।’
৮১ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এ ভূমিকম্প সম্পর্কে নেপালের সংবাদকর্মী অভয় রাজ জোশি বলেন, ‘সেই সময়কার পরিস্থিতি ছিল ভয়াবহ এবং মানুষ খুব ভয় পেয়ে গেছিল। ভূকম্পনের পরবর্তী কম্পনগুলোও অনেক শক্তিশালী ছিল। এর পর থেকে টেলিফোন লাইন পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছে। তবে আশ্চর্যজনকভাবে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল।’
এ ছাড়া স্মরণকালের সবচেয়ে খারাপ এই দুর্ঘটনায় বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টে নিহত হওয়া ১৭ পর্বতারোহীর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া আহত পর্বতারোহীদের মধ্যে প্রথম দফায় ১৫ জনকে নিয়ে আজ দুপুরে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেছে একটি বিমান।
এদিকে নিহত পর্বতারোহীর সংখ্যা বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আহত অবস্থায় উদ্ধার হওয়া গেলু শেরপা।
ভূমিকম্পের কারণে জরুরি অবস্থা জারি করেছে নেপাল। পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সার্ক দেশগুলোর কাছে খাদ্য ও চিকিৎসা-সহায়তা চেয়েছে দেশটি। এরই মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত, চীনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্র সহায়তা নিয়ে পৌঁছাতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপকারী প্রতিষ্ঠান ইউএসজিএস জানিয়েছে, নেপালে গতকাল সকাল থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মোট ২৪ বার ভূকম্পন হয়েছে। প্রথমে কাঠমান্ডুর পশ্চিমে লামজুং এলাকায় প্রথম দফায় ৭.৯ মাত্রার ভূকম্পন হয়। এরপর দফায় দফায় ভূকম্পন অনুভূত হতে থাকে। তবে তার মাত্রা তেমন তীব্র ছিল না। ভূমিকম্পে বহু লোক হতাহত হওয়া ছাড়াও শহরে জমেছে বিভিন্ন ভবনের ধ্বংসাবশেষের স্তূপ।
এর আগে ১৯৩৪ সালে নেপালে ৮.৩ মাত্রার ভূমিকম্পে সাড়ে আট হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। এরপর গতকালের ঘটনায় ব্যাপক মাত্রায় প্রাণহানি হলো।
ধারাহারা টাওয়ার ধস
প্রবল ভূমিকম্পে কাঠমান্ডুর প্রাচীন অনেক ভবন ধসে গেছে। এর একটি ১৯ শতকের ভবন ধারাহারা টাওয়ার। স্থানীয় সময় দুপুরের কিছু আগে ভবনটি ধসে পড়ে। সেখানে আটকা পড়ে দুইশর বেশি লোক।
টাওয়ারটি ১৮৩২ সালে নির্মিত হয়। গত ১০ বছর ধরে কাঠমান্ডুতে আগত পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ ছিল এটি। ১৪ তলা ভবনটি থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।