প্রেমিকার অপেক্ষায় রেলস্টেশনে ২০ বছর!
প্রিয় মানুষটির জন্য অপেক্ষার প্রহরগুলো সবসময় মধুর হয়। এই মধুর অপেক্ষাকে ঘিরে হাজারো কাব্য-গল্প-গান যুগ যুগ ধরে অনুরণন তুলেছে মানুষের মনে। কিন্তু সেই অপেক্ষা যদি হয় ২০ বছরের?
এমনই এক অপেক্ষার ঘটনার সাক্ষী তাইওয়ানের তাইনান শহরের বাসিন্দারা। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ওই শহরের একটি রেলস্টেশনে প্রেমিকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছেন ৪৭ বছর বয়সী অহ জি।
থাইল্যান্ডের অনলাইন অডিটিসেন্ট্রালডটকমের এক সংবাদদাতা ছয় মাস অপেক্ষা করে অহ জির কাছ থেকে জানতে পেরেছেন, এই রেলস্টেশনেই ২০ বছর আগের একদিন প্রেমিকা তাঁকে ছেড়ে গিয়েছিল। ছেড়ে যাওয়ার সময় বলেছিল, ‘অপেক্ষায় থেকো আমার জন্য।’ আর অহ জি কথা দিয়েছিলেন, ‘সারা জীবন থাকব তোমার অপেক্ষায়।’ ওই কথাটিকেই আঁকড়ে ধরে দুই দশক ধরে প্রেমিকার অপেক্ষায় আছেন জি।
তবে এই প্রেমিক কিন্তু জানেন না, সে মেয়েটি কোথায় থাকে, এখন কী অবস্থায় আছে কিংবা সে অন্য কারো হয়ে গেছে কি না? এসব প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে তিনি ওই সাংবাদিকের ওপর ক্ষেপে যান এবং সরাসরি মুখের ওপর বলে দেন তিনি এ ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না।
২০ বছর ধরে যাঁরা তাইনান স্টেশনে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছেন, তাঁদেরই একজন ৬১ বছর বয়সী শো জে পি। তিনি বলেন, ‘২০ বছরে ধরে আমি যত দিন স্টেশনে এসেছি, প্রতিদিনই তাঁকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। প্রথম কয়েক বছর তিনি অপেক্ষা করতেন রেলস্টেশনে ঢোকার মুখের একটি সিঁড়ির পাশে। আর গত চার-পাঁচ বছর ধরে তিনি স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন। সেখানে দাঁড়িয়েই স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোকে দেখেন তিনি। মানুষের মুখে কাকে যেন খোঁজেন।ঝড়-বৃষ্টি-তুষারপাত কোনোকিছুতেই তাঁর এই রুটিনের নড়চড় হয়নি। শুনেছি এই স্টেশনেই থাকেন তিনি।
এত বছরে তাই স্টেশনের যাত্রীদের সবারই পরিচিত মুখ হয়ে গেছেন প্রেমিক অহ জি। এখন স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথে অনেকেই তাঁর কুশল জিজ্ঞেস করেন। অনেকে তাঁকে খাবার দিয়ে যান।
তাইনান শহরের লোকজন জিকে ‘হিউম্যান হাচিকো’ নামে ডাকে। হাচিকো হচ্ছে জাপানের বিখ্যাত লেখক আকিতা ইনুর ম্যান বুকার এবং ডাবলিন সাহিত্য পুরস্কারজয়ী বই ‘জো জাসির’ একটি কুকুর চরিত্র। যে একটি রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে যুদ্ধে নিহত তাঁর মালিকের জন্য দীর্ঘ এক যুগ অপেক্ষা করেছিল।
অহ জির পরিবারের লোকজন থাকেন তাইনান শহরেই। তাঁর ছোট ভাই ওন জি জানান, প্রথম প্রথম পরিবারের লোকজন এসে তাঁকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতেন। ঘরে নিয়ে আটকেও রাখা হয়েছে। কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। ঠিক চলে এসেছেন আগের জায়গায়। কয়েক বছর আগে সমাজকর্মীরা তাঁকে ভর্তি করিয়েছিলেন এক পুনর্বাসনকেন্দ্রে। কয়েকদিন পর সেখান থেকে আগের ঠিকানায় পালিয়ে ফিরে এসেছেন তিনি।
অবশ্য কিছুদিন থেকে শহরের বিখ্যাত প্রেমিক জিকে নিয়ে দেশ-বিদেশের সংবাদপত্র ও জনগণের তুমুল আগ্রহের পর তাইনান শহরের সমাজকল্যাণ কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটিতে হস্তক্ষেপ করেছে। শহরের মেয়র একদিন নিজে এসে তাঁকে নিয়ে গেছেন স্থানীয় একটি চার্চের প্রার্থনা ও তাঁর সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায়। চুল কাটিয়ে, শহরের মেয়রের উপহার দেওয়া নতুন পোশাক পরে স্টেশনের কিছু বন্ধুকে নিয়ে ওই ভোজসভায় যান তিনি। এ সময় তাঁকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। কিন্তু যেই তাঁকে স্টেশন ছাড়তে বলা হলো, অমনি বেঁকে বসলেন তিনি। জানালেন তিনি কোথাও যাবেন না, বরং অপেক্ষা করবেন স্টেশনেই।
এরপর স্থানীয় একটি ট্যুরিজম ক্লাব তাঁদের অর্থায়নে জিকে পরিবারের একজনসহ ঘুরতে পাঠিয়েছেন। শহরের বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি আয়োজনেও তাঁকে নিয়মিত দাওয়াত দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু জীবনের এত আয়োজনে কিছুতেই মন লাগে না তাঁর। ঠিক ফিরে যান অপেক্ষার রেলস্টেশনেই। তাঁর মনে পড়ে যায়, কেউ তাঁকে বলেছিল- ‘অপেক্ষায় থেকো আমার জন্য।’ আর কাউকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, ‘সারা জীবন থাকব তোমার অপেক্ষায়।’