গরমে ইউরোপে ৬১ হাজার প্রাণহানি, পুরুষের তুলনায় নারীমৃত্যু বেশি
ইউরোপের ইতিহাসে ২০২২ সালের গ্রীষ্মকাল ছিল সবচেয়ে উষ্ণতম। এ মহাদেশটি সেবারের তাপপ্রবাহ সব ধরনের রেকর্ড ভেঙেছে। ঋতুটিতে তীব্র গরমে ইউরোপে ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সোমবার (১০ জুলাই) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। খবর এএফপির।
গবেষণা প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, আগামী বছরগুলোতে তাপপ্রবাহ আরও আসতে পারে। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষদের রক্ষা করার জন্য আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা। প্রতিনিয়ত ভাঙছে আগের রেকর্ড। বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহ ও খরা এখন আরও ঘনঘন ও তীব্র হয়ে উঠছে।
গত গ্রীষ্মে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা এর আগেই জানিয়েছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাট। তবে, গরমের সঙ্গে মৃত্যুর সম্পৃক্ততার কথা স্পষ্ট করেনি তারা।
ইউরোপের ৩৫ দেশের ৮২৩টি অঞ্চলের ২০১৫ থেকে ২০২২ সালের ডেটা বিশ্লেষণ করেছে একদল গবেষক। এই গবেষণা চালিয়েছে বার্সেলোনা ইন্সটিটিউট ফর গ্লোবাল হেলথ এবং ফ্রান্সের হেলথ রিসার্চ ইন্সটিটিউট আইএনএসইআরএম। ২০২২ সালের গ্রীষ্মে ইউরোপের প্রতিটি অঞ্চলে প্রত্যেক সপ্তাহে তাপমাত্রাজনিত কারণে কত মৃত্যু হয়েছে তা জানতে কয়েকটি মডেলকে অনুসরণ করেছে গবেষক দল।
নেচার মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনটি গবেষকরা অনুমান করছে, গত বছরের মে মাসের ৩০ তারিখ থেকে সেপ্টেম্বরের ৪ তারিখ পর্যন্ত তাপমাত্রাজনিত কারণে ইউরোপে ৬১ হাজার ৬৭২ মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া জুলাইয়ের ১৮ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত অর্থাৎ, এক সপ্তাহের দাবদাহে ইউরোপে ১১ হাজার ৬০০ জন মারা গেছে।
আইএনএসইআরএমের গবেষক ও এই গবেষণা প্রতিবেদনের সহ-লেখক হিচাম আচেবাক বলেন, ‘মৃত্যুর পরিমাণ অস্বাভাবিক। তাপমাত্রাজনিত কারণে মৃত্যুর বিষয়টি আমরা ২০০৩ সাল থেকে জানতে পেরেছি। মানুষদের রক্ষা করতে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে।’
এএফপি বলছে, ২০০৩ সালে সবচেয়ে বেশি দাবদাহের মুখে পড়েছিল ইউরোপ। ওই সময় তীব্র গরমে এক বছরে ৭০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। গত গ্রীষ্মে ফ্রান্স রেকর্ড তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। ২০২১ সালের গ্রীষ্মের তুলনায় বছরটিতে তাপমাত্রা বেড়েছে দুই দশমিক ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালের গ্রীষ্মে তাপমাত্রা সুইজারল্যান্ডে দুই দশমিক ৩০, ইতালিতে দুই দশমিক ২৮ ও হাঙ্গেরিতে দুই দশমিক ১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
তীব্র গরমে মৃত্যুর দিক থেকে সবার ওপরে রয়েছে ইতালি। দেশটিতে মারা গেছে ১৮ হাজার ১০ জন। তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা স্পেনে মারা গেছে ১১ হাজার ৩২৪ জন। আর তৃতীয় অবস্থানে থাকা জার্মানিতে গরমে মারা গেছে আট হাজার ১৭৩ জন।
বয়সের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ৮০ ঊর্ধ্ব বয়স্করা। এ ছাড়া তীব্র গরমে মোট মৃত্যুর ৬৩ শতাংশই নারী।
আর ৮০ বছরের ওপরের যেসব বয়স্ক মারা গেছে তাদের মধ্যে পুরুষের তুলনায় ২৭ শতাংশ বেশি নারী মারা গেছে।
প্রতিবেদনে এএফপি জানিয়েছে, পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলেও ইউরোপে বেড়েছে দ্বিগুণ। ১৮০০ দশকের মধ্যবর্তী সময়ের পর থেকে বিশ্বের তাপমাত্রা বেড়েছে এক দশমিক দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে, প্রাক শিল্প যুগ পরবর্তী সময়ে গত বছর ইউরোপের তাপমাত্রা বেড়েছে দুই দশমিক তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস।
নতুন গবেষণা প্রতিবেদনে অনুমান করে বলা হচ্ছে, তাপমাত্রা থেকে মানুষদের রক্ষার পদক্ষেপ না নেওয়া হলে, ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপের প্রতিটি গ্রীষ্মে গড়ে ৬৮ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাবে। ২০৪০ এর মধ্যে মৃত্যুর এই সংখ্যা ৯৪ হাজারে পৌঁছাবে। আর ২০৫০ সালের মধ্যে গরমে প্রতি বছর গড়ে মৃত্যু এক লাখ ২০ হাজারে গিয়ে ঠেকবে।
হিচাম আচেবাক বলেন, ‘আমরা যে অনুমান করছি তা বর্তমান ও ভবিষ্যতের তাপমাত্রার ওপর ভিত্তি করে। যদি আমরা পদক্ষেপ নিতে পারি তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা কমে যাবে।’