শেখ হাসিনাকে নির্বাচনী বার্তা দিতে পারে ভারত
আগামী মাসেই ভারতে বসতে যাচ্ছে জি-২০ সম্মেলন। এই সম্মেলনে আয়োজক দেশের আমন্ত্রণে যোগ দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে ভারত থেকে দুটি বার্তা দেওয়া হতে পারে। সেগুলো হলো–বাংলাদেশে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই অবাধ ও সুষ্ঠু হতে হবে এবং তার দল আওয়ামী লীগকে চীন ও ইসলামপন্থিদের বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ও জনপ্রিয় প্রার্থীদের বেছে নিতে হবে। আজ সোমবার (২১ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় গণমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফ।
ভারতের এই দুটি বার্তার বিষয়টি টেলিগ্রাফকে নিশ্চিত করেছে দেশটির নিরাপত্তা সংস্থার একটি সূত্র। ওই সূত্র বলছে, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন প্রশ্নে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ব্যাপক ঐকমত্যের ইঙ্গিত দেয়।
সূত্রটি আরও বলছে, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দুই দেশের (ভারত ও মার্কিন) নিরাপত্তা সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে ধারাবাহিক আলোচনা হয়েছে...ভারত এবং এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশে শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠক হয়েছে।’
ওই সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, ‘অতীতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বড় পার্থক্য ছিল (২০১৮ সালের মতো)। তবে, এবার তারা ঐকমত্য বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যখন জি-২০ সম্মেলনের জন্য দিল্লিতে থাকবেন, তখন তাকে বার্তা দুটি পৌঁছে দেওয়া হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’
প্রতিবেদনে দ্য টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, শেখ হাসিনার অধীনে হওয়া ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে দাবি তাঁর। আগামী নির্বাচনও আগের দুটি নির্বাচনের মতো হবে বলে জানানো হয়েছে। আর এতেই যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ওঠা অভিযোগ নিয়ে কখনও কোনো প্রশ্ন তোলেনি নয়াদিল্লি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই প্রথম শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।
ঢাকাস্থ এক কৌশলগত বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘তিনি (হাসিনা) এখনও ভারতের প্রিয় রয়ে গেছেন তাতে সন্দেহ নেই.... তবে, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন কৌশলগত উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। ভারতের উদ্বেগের সমাধান না করলে নয়াদিল্লি তাকে সমর্থন দেবে, এমন সম্ভাবনা নেই।’ যদিও ভারতের অনেক আশা পূরণ করেছে আওয়ামী লীগ সরকার।
ইসলামি সন্ত্রাসীদের দমন থেকে শুরু করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে পণ্য চলাচলের অনুমতি দিয়ে তারা। তবে, নয়াদিল্লির জন্য প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, চীনের সঙ্গে হাসিনা সরকারের স্পষ্ট নৈকট্য। বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রকে একই কাতারে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতীয় ও মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর যেসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সূত্র মতে সেগুলো হলো :
১. বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামো ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগে চীন এবং ইসলামপন্থিদের ব্যাপক উপস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দুপক্ষই। পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছে তারা। দিল্লি সফরে হাসিনাকে এই উদ্বেগ জানাতে ভারত সম্মত হয়েছে।
২. দুপক্ষই বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা এবং আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের পর্যবেক্ষণে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের পরিস্থিতি তৈরি করা নিয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। শেখ হাসিনার সফরে ভারত অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়টি তুলে ধরার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
৩. নির্বাচনকালীন সময়ে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নে দুপক্ষই একমত পোষণ করেছে। তবে, দেশটির প্রধান বিরোধী জোট বিএনপি ও জামায়াতের দাবির মধ্যে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার। তত্ত্বাবধায়ক বিষয়টি বাংলাদেশের সাংবিধানে না থাকায় বিষয়টি নিয়ে নয়াদিল্লি ও ওয়াশিংটনের আগ্রহ নেই।
৪. শেখ হাসিনা সরকারকে দুর্নীতি ও ব্যাংক খেলাপিদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে বলে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একমত পোষণ করেছে। পাশাপাশি সরকারকে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে; যা সাধারণ বাংলাদেশিদের জীবনকে কঠিন করে তুলেছে।
৫. ভারতীয় কর্মকর্তারা যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে ক্ষমতা পরিবর্তনের তাদের প্রাথমিক এজেন্ডা বিএনপি-জামায়াত জোটকে ক্ষমতায় আনবে এবং এই অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করবে। ভারতীয় পক্ষ মার্কিন প্রতিনিধিদের যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান সম্পর্কে তাদের আপত্তির কথা জোরালোভাবে জানিয়েছে। তারা বলেছে, জামায়াতে ইসলামি একটি ইসলামপন্থি রাজনৈতিক সংগঠন। ভারত জামায়াতকে একটি উন্মত্ত মৌলবাদী সংগঠন বলে মনে করে।
৬. বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে জো বাইডেন প্রশাসন কর্তৃক ঘোষিত বাংলাদেশিদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপের আগে ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শ করা উচিত বলে নয়াদিল্লির প্রতিনিধিরা মার্কিন কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন।
একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপক মিল রয়েছে। এমনটি শুধুমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে তাদের অতীতের পার্থক্যের কারণে নয়।
ঢাকার একটি সূত্র বলছে, বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবে। তরুণ প্রজন্ম যারা রাজনীতিতে আগ্রহী নয়, তাদেরও দেশ গঠনের প্রক্রিয়ায় যোগ দিতে উৎসাহিত করবে। ক্ষমতাসীন দলের কোনো চক্রের প্রতি আনুগত্য নয়, জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে প্রার্থী নির্বাচন আওয়ামী লীগকে আরও শক্তিশালী করবে। দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থাগুলো বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সূত্রটি আরও বলছে, এখন প্রশ্ন হলো বাংলাদেমে শক্তিশালী নেতা শেখ হাসিনা এসব পরামর্শ মানবেন কি না, যার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের মতপার্থক্য রয়েছে।