ভারতে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নিয়ে বিতর্ক কেন?
বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতে একইসঙ্গে লোকসভা ও রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন ইস্যুতে এখন বিতর্ক তুঙ্গে৷ এই লক্ষ্য সামনে রেখে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কয়েক বছর ধরেই ‘এক দেশ এক নির্বাচন’-এর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চাইছে৷ চলতি মাসে সংসদের বিশেষ অধিবেশনে আসতে পারে এই সংক্রান্ত বিল৷ দেশটির বিরোধী রাজনীতিকরা বিজেপি সরকারের এই নীতির সমালোচনা করছে৷
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগে ফের এই নীতি নিয়ে তৎপরতা দেখা যাচ্ছে৷ ১৮ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছে৷ সেই অধিবেশনে একসঙ্গে দুই নির্বাচন আয়োজন সংক্রান্ত বিল পেশ করা হতে পারে৷ কীভাবে এই পরিকল্পনা কার্যকর করা যায় তা খতিয়ে দেখতে কেন্দ্র একটি কমিটি গঠন করেছে৷ সাবেক রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের নেতৃত্বে এই কমিটি বিশেষ অধিবেশনে ‘এক দেশ এক নির্বাচন' নিয়ে রিপোর্ট পেশ করবে৷
সরকারের ভাবনা
‘এক দেশ এক নির্বাচন’ বাস্তবায়িত হলে অনেকগুলো সুবিধা হবে। এমনকি নতুন এই নীতি কার্যকর হলে ভোট পরিচালনার খরচ অনেকটাই কমবে বলে সরকারপক্ষের অভিমত৷ ভোট ঘোষণার পরেই আদর্শ আচরণবিধি কার্যকর থাকায় নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া যায় না৷ নির্বাচন পরিচালনার জন্য সরকারি আধিকারিকদের বিপুল সংখ্যায় নিয়োগ করতে হয় নির্বাচন কমিশনকে৷ এতে উন্নয়নের কাজে বাধা পড়ে৷ এই ব্যবস্থায় ভোটদানের হার বাড়াতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে৷ ভোটপর্ব সুষ্ঠু ও অবাধ করা সম্ভব বলেও দাবি করা হচ্ছে৷
সমালোচকদের ভাবনা
অবশ্য বিরোধীরা একগুচ্ছ যুক্তি হাজির করছে এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে৷ সবচেয়ে বড় যুক্তি হলো যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ঘিরে৷ তাদের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় সরকার এই কাঠামো ক্রমশ ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ধাঁচে ভোটব্যবস্থা পরিচালনা করতে চাইছে৷
আঞ্চলিক দলগুলোর আশঙ্কা, রাজ্যকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয়কে ধামাচাপা দিয়ে কেন্দ্রীয় ইস্যুতে সারা দেশের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে চায় বিজেপি৷ নির্বাচনে যে বিপুল খরচ হয়, তা জোগাতে সমস্যা হবে ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রে৷ অর্থাৎ প্রচারের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে তারা৷ ‘ইন্ডিয়া’ জোটের পক্ষ থেকে কেন্দ্রের উদ্যোগের বিরোধিতা করা হয়েছে৷
অতীতে একত্রে ভোট
ভারতের সংসদীয় রাজনীতির ইতিহাসে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন একসঙ্গে হওয়ার নজির রয়েছে৷ ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত দুই নির্বাচন একই সঙ্গে হতো৷ ১৯৫৭ সাল থেকে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার মধ্যে সাতটির ক্ষেত্রে সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি৷ বিধানসভার ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা একশরও বেশি৷
১৯৭২ সালের সাধারণ নির্বাচনকে এক বছর এগিয়ে এনেছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী৷ তারও আগে ১৯৫৯ সালে কেরালায় বাম সরকার ভেঙে দেওয়া হয়৷ কোনো ক্ষেত্রেই সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করেনি৷
রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের স্থায়িত্ব এক না হওয়ায় আলাদা সময় দুই ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়৷ রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকার তাদের নির্ধারিত মেয়াদ অর্থাৎ পাঁচ বছরের সময়কাল পূর্ণ করতে না পারলে একইসঙ্গে নির্বাচনের পরম্পরা ধরে রাখা যায় না৷
নতুন করে উদ্যোগ
গত ৮০-র দশকে একসঙ্গে ভোট করানোর প্রস্তাব উঠেছিল৷ নির্বাচন কমিশন এমন প্রস্তাবও দিয়েছিল৷ তবে সেই সময় কেন্দ্রীয় সরকার এই সুপারিশ গ্রহণ করেনি৷ পরবর্তীকালে আইন কমিশনও একযোগে ভোটগ্রহণের উপর জোর দেয়৷ এরপর দেড় দশক বিষয়টি নিয়ে আর তেমন আলোচনা হয়নি৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ২০১৬ সালে ‘এক দেশ, এক নির্বাচন’ নীতি নিয়ে আসার চেষ্টা করে৷ যদিও সেবার বিষয়টা বেশি দূর এগোয়নি৷
কেন্দ্র ২০১৯ সালে আরও একবার সব দলের সহমতের ভিত্তিতে এই পরিকল্পনা কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়৷ কিন্তু কংগ্রেস, তৃণমূল-সহ বিভিন্ন জাতীয় ও আঞ্চলিক দল আলোচনায় রাজি হয়নি৷
গত বছরই জাতীয় নির্বাচন কমিশন বলেছে, লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে তারা সব বিধানসভার ভোটগ্রহণ করতে তৈরি রয়েছে৷ তবে এজন্য দরকার আইন পাস করা৷ শুধু আইন করলেই হবে না, সংবিধানের একাধিক ধারার সংশোধনও দরকার৷
ব্যয়ের যুক্তিই সরকারপক্ষের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার৷ অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর)-এর পশ্চিমবঙ্গ শাখার সঞ্চালক উজ্জয়িনী হালিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত নির্বাচনি প্রচারের খরচ কমানো৷ তার বদলে সস্তায় ভোট সারার যুক্তি অসার৷’
আচরণবিধি সম্পর্কে উজ্জয়িনী হালিম আরও বলেন, ‘‘আচরণবিধি কার্যকর হলেও পুরোনো প্রকল্প চালিয়ে যাওয়া যায়৷ নতুন প্রকল্প ঘোষণায় বাধা থাকে৷ তবে সেটাও সম্ভব যদি বিশেষ অনুমতি নেওয়া হয়৷ অতীতে সেই নজির আছে৷’’
কতটা সম্ভাবনা?
কেন্দ্র চাইলেই এই আইন আনতে পারবে, এমনটা নয়৷ প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র বলেন, ‘‘এই পরিকল্পনা কার্যকর করতে আইন তৈরি ও সংবিধান সংশোধনের কাজটাও করা কঠিন৷ অর্ধেকের বেশি রাজ্য বিধানসভার সম্মতি লাগবে৷ এর বদলে প্রকৃত সংস্কার দরকার৷ অপরাধে অভিযুক্তদের আইনসভার প্রবেশ রুখতে হবে৷ নির্বাচনি ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে৷”
এই উদ্যোগের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদি বিজেপির একমাত্র ভোট ক্যাচার৷ তাই তাকে সামনে রেখে লোকসভা ও বিধানসভা নির্বাচন করাতে চায় বিজেপি৷ তারা চায়, একই এজেন্ডায় সারা দেশ ভোট দিক৷ কিন্তু সেটা তো সম্ভব নয়৷”
আইন পাস হলেও লোকসভা বা কোনো বিধানসভা পাঁচ বছরের আগে ভেঙে যেতে পারে৷ তখন কী হবে? শুভাশিস বলেন, ‘‘এর একটাই সমাধান৷ অনাস্থা ভোটের সঙ্গে সঙ্গেই আস্থা ভোটের সংস্থান রাখতে হবে৷ যাতে কেন্দ্র বা রাজ্যে বিকল্প সরকার গঠন করা যায় যেটি পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করবে৷’’