যুক্তরাজ্যের নির্বাচনে প্রভাব ফেলতে পারে যে বিষয়গুলো
আগামী ৪ জুলাই যুক্তরাজ্যে অনুষ্ঠিত হবে সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনকে ঘিরে প্রতিদিনই আলোচনা, সমালোচনা ও বির্তকের মুখোমুখি হচ্ছেন প্রার্থীরা। আসন্ন সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে রেকর্ড সংখ্যক প্রার্থী দেশজুড়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন। যুক্তরাজ্যের নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে, চার হাজার প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে এবার, যা অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় সর্বোচ্চ।
নির্বাচনি এক জরিপে দেখা গেছে, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী (সাবেক প্রধানমন্ত্রী) ডেভিড ক্যামেরনসহ পাঁচ নেতার নেতৃত্বে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা কনজারভেটিভ দলের শাসনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। ভোটের ফলাফলে লেবার পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে মূলত দুটি দলের মধ্যেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। এদের একটি হচ্ছে কনজারভেটিভ অ্যান্ড ইউনিয়নিস্ট পার্টি বা সংক্ষেপে কনজারভেটিভ পার্টি। দলটির আরেকটি প্রচলিত নাম—টোরি। ‘টোরি’ আইরিশ শব্দ যার আভিধানিক অর্থ অন্বেষণ করা। অন্য দলটি হলো লেবার পার্টি, যারা এখন বিরোধী শিবিরে অবস্থান করছে।
২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে অর্থনৈতিক স্থবিরতা, আবাসন সংকট, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, অভিবাসন ও বৈদেশিক নীতির বিষয়গুলো আলোচনার শীর্ষে রয়েছে। কোন দল ক্ষমতায় এসে এসব সমস্যা মোকাবিলা করে দেশকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করবে তাই এখন দেখার বিষয়। খবর আলজাজিরার।
সাম্প্রতিক সমস্যাগুলো যেভাবে বিছিয়ে আছে যুক্তরাজ্যে—
অর্থনীতি
যুক্তরাজ্যের যেকোনো সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় মাথাব্যথার কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক অচলাবস্থা। ইনস্টিটিউট ফর ফিসক্যাল স্টাডিজের (আইএফএস) মতে, গত ১৫ বছরে মধ্যে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে খারাপ আয়ের প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে। মে মাসের শেষের দিকে আইএফএসের সহযোগী পরিচালক টম ওয়াটার্স বলেন, ধনী-দরিদ্র, বৃদ্ধ, যুবক কিংবা যুবতী সকলের জন্য বর্তমান অর্থনীতি অচল অবস্থা তৈরি করছে। আয়ের বৈষম্য স্থিতিশীল থাকলেও, দারিদ্র্য হ্রাসের অগ্রগতি ব্যাপক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং বেতন স্থবির হয়ে থাকার কারণে ব্রিটিশরা জীবনযাত্রার ব্যয় সঙ্কটের সঙ্গেও লড়াই করছে।
কনজারভেটিভ এবং লেবার পার্টি দেশটির অর্থনীতি ঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন উপায়ের কথা বললেও কোনো সুরাহা মিলছে না।
লেবার পার্টির নেতা কায়ার স্টারমার জাতীয় স্বাস্থ্য পরিসেবা, গৃহনির্মাণ ব্যবস্থা, জ্বালানি খাত এবং অন্যান্য শিল্পে সংস্কারের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। নির্বাচনে লেবার পার্টি জয়ী হলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সাত দশমিক চার বিলিয়ন পাউন্ড কর কমানো হবে।
অন্যদিকে, কনজারভেটিভ পার্টি প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, প্রতি বছর ১৭ বিলিয়ন পাউন্ড কর কমানোর হবে। যার মধ্যে জাতীয় বিমায় আরোপিত মূল কর হার থেকে ২ শতাংশ কমানো হবে এবং বেতনের উপর বাধ্যতামূলক কর রাখা হবে।
আবাসন সংকট
সম্পত্তির দাম বৃদ্ধি, ভাড়া বৃদ্ধি এবং সাশ্রয়ী মূল্যে নতুন ভবনের অভাব বছরের পর বছর ধরে চলমান থাকার কারণে আবাসন সঙ্কট তীব্র আকার ধারণ করেছে। স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর মতে, সামাজিক আবাসন ঘাটতির কারণে অস্থায়ী বাসস্থানের সংখ্যা মার্চ ২০২৩ সাল নাগাদ গত ১০ বছরে ৮৯ শতাংশ বেড়েছে।
স্বাস্থ্য খাত
স্বাস্থ্যসেবার জন্য অপেক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বৃদ্ধির কারণে বিপর্যয়ের মুখোমুখি যুক্তরাজ্য। জীবনযাত্রার ব্যয়ে সবচেয়ে খরচ হওয়া খাতের দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে স্বাস্থ্য। ভোটের আগে ব্রিটিশদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জরিপে অংশ নেওয়া ৩৪ শতাংশ উত্তরদাতা স্বাস্থ্য খাতকে তালিকাভুক্ত করেছেন সবচেয়ে ব্যয়বহুল হিসেবে।
অভিবাসন
২০২৪ সালে যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় অভিবাসন। স্কাই নিউজের পরিচালিত সাম্প্রতিক ইউগভ জরিপে দেখা গেছে যে ৪৩ শতাংশ ব্রিটিশ বিশ্বাস করেন, অভিবাসন ব্রিটিশ সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে, ৩৫ শতাংশের বেশি ব্রিটিশ নাগরিক অভিবাসনের প্রভাব ইতিবাচক বলে মনে করেন।
কনজারভেটিভ দল বারবার অনিয়মিত উপায়ে আগত অভিবাসন প্রত্যাশীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো কার্যকারী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গত বুধবার সরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮৮২ জন লোক একদিনে যুক্তরাজ্যে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়ে প্রবেশ করছে, যা ২০২২ সালের পর সংখ্যায় সর্বোচ্চ।
ইউক্রেন যুদ্ধ
২০২২ সালে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করার পর থেকে যুক্তরাজ্য ইউক্রেনের প্রতি অটল সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্য ও কিয়েভের মধ্যকার বন্ধনকে একটি অবিচ্ছেদ্য জোট হিসাবে উল্লেখ করে আসছেন।
সম্প্রতি ইতালিতে অনুষ্ঠিত হওয়া জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে সুনাক বলেন, যুক্তরাজ্য ‘যাই হোক না কেন’ ইউক্রেনের সঙ্গে রয়েছে। তিনি জি-৭ নেতাদের ‘সিদ্ধান্তমূলক’ হতে ও ‘সংকটময় মুহূর্তে পুতিনের অবৈধ যুদ্ধের’ অবসান ঘটানোর আহ্বান জানান।
গাজার সংঘাত
পুরো বিশ্ব গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চাইছে। গত আট মাস ধরে গাজায় চলমান যুদ্ধ বন্ধ ও শান্তির জন্য প্রতিবাদ করতে থাকা হাজার হাজার ব্রিটিশদের জন্য ৪ জুলাইয়ের নির্বাচন সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে।
মে মাসে মেডিকেল এইড ফর প্যালেস্টাইন এবং কাউন্সিল ফর আরব-ব্রিটিশ আন্ডারস্ট্যান্ডিং পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৭০ শতাংশেরও বেশি ব্রিটিশ মানুষ গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি চায়। জরিপে দেখা গেছে, যুদ্ধবিরতি চেয়ে ভোট দেওয়া ৬৭ শতাংশ রক্ষণশীল ভোটার এবং ৮৬ শতাংশ লেবার ভোটার রয়েছে।