মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়ে যা ভাবছে রাশিয়া
ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ সালের নভেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে ১৩২টি শ্যাম্পেনের বোতল খুলে উদযাপনের ঘটনা ঘটেছিল। চরম উচ্ছ্বসিত রাশিয়ার উগ্র-জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ ভ্লাদিমির ঝিরিনোভস্কি রুশ পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘দুমা’ ও দলীয় কার্যালয়ে টেলিভিশন ক্যামেরার সামনেই ঘটিয়েছিলেন এই ঘটনা। তিনি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় রুশ-মার্কিন সম্পর্কে (ইতিবাচক) পরিবর্তন আসবে। সে সময় ঝিরিনোভস্কির মতো অনেক রুশ রাজনীতিবিদ ট্রাম্পের বিজয় উদযাপন করেছিলেন। এবারের নির্বাচনেও রাশিয়ার হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে। তবে তা উড়িয়েছে রুশ হাইকমিশন। যদিও দেশটির নির্বাচনে ট্রাম্প এবারও রাশিয়ায় ছড়াচ্ছেন উত্তাপ। এরইমধ্যে এই প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে তার অবস্থান অনেকটাই পরিষ্কার করেছেন।
বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে এসব তথ্যের পাশাপাশি আরও বলা হয়েছে, নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার পরের দিন রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম আরটির প্রধান সম্পাদক মার্গারিটা সিমোনিয়ান এক এক্স (সাবেক টুইটার) বার্তায় এমন অভিপ্রায়ও ব্যক্ত করেছিলেন যে, মার্কিন পতাকা উড়িয়ে তিনি মস্কোর রাস্তায় গাড়ি চালাতে চান। তখন আরও একটি ঘটনা ঘটেছিল, যা আমি কখনোই ভুলব না। সেটি হচ্ছে, একজন রুশ কর্মকর্তা আমাকে বলেছিলেন যে, ট্রাম্পের বিজয় উদাযাপন করতে তিনি একটি সিগার ধরিয়েছিলেন এবং এক বোতল শ্যাম্পেন (হ্যাঁ, আরও শ্যাম্পেন) পান করেছিলেন।
মস্কো আশা করেছিলো যে, রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর রাশিয়ার ওপর থেকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন। এমনকি, তিনি ক্রাইমিয়াকে রাশিয়ার অংশ হিসাবে স্বীকৃতিও দিয়ে দিতে পারেন বলে আশা করছিলেন অনেকে। যদিও বাস্তবে সেসবের কিছুই ঘটতে দেখা যায়নি। রাশিয়ার নেজাভিসিমায়া গেজেটা পত্রিকার সত্ত্বাধিকারী ও প্রধান সম্পাদক কনস্ট্যান্টিন রেমচুকভ বলেন, ‘এত আশা-প্রত্যাশার বিপরীতে প্রাপ্তি এতটুকুই ছিল যে, ক্ষমতায় থাকাকালে ট্রাম্প রাশিয়ায় মানবাধিকারের বিষয়ে কখনোই প্রচারণা চালাননি।’ ফলে তখন রুশ নাগরিকদের মধ্যে যারা একটু বেশিই আশা করে ফেলেছিলেন, তাদের সেই মোহ কাটতেও খুব বেশি সময় লাগেনি।
অনেকেই ভেবেছিলেন যে, ক্ষমতায় গেলে ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবেন। ‘অথচ ট্রাম্পের শাসনামলেই রাশিয়ার উপর সবচেয়ে বড় নিষেধাজ্ঞাটি দেওয়া হয়েছিল’, বলেন রেমচুকভ। তিনি আরও বলেন, ‘বিশেষ করে গত মেয়াদের শেষদিকে তার কার্যক্রম নিয়ে অনেক মানুষ হতাশ হয়েছিল।’ আর হয়তো সেকারণেই আট বছর পর এবারের মার্কিন নির্বাচনের আগে কোনো রুশ রাজনীতিবিদ বা কর্মকর্তা এখন পর্যন্ত ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে জয়লাভের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেননি। এতে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে যে, ট্রাম্প প্রশ্নে তারা এখন ঠিক আগের অবস্থানে নেই। বরং এবার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে দেখা গেছে ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী কমালা হ্যারিসের প্রশংসা ও সমর্থন করতে।
যদিও পুতিনের ওই প্রশংসা ও সমর্থনকে ‘ক্রেমলিন ট্রোলিং’ বা ক্রেমলিনের রসিকতা হিসাবেই ব্যাখ্যা করেছেন অনেকে। সম্প্রতি নিজের এক বক্তব্যে রুশ প্রেসিডেন্ট জানিয়েছেন যে, তিনি মিজ হ্যারিসের ‘সংক্রামক হাসি’কে পছন্দ করেন। কিন্তু পুতিনের মুখে যে হাসি এখনও টিকে আছে, সেটির কৃতিত্ব যে মিজ হ্যারিসের না বরং ট্রাম্পের, সেটি বুঝতে রাজনীতির বিষয়ে মহাজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এখানে উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক সহায়তা নিয়ে রিপাবলিকানপ্রার্থী ট্রাম্প তার নির্বাচনি প্রচারণায় বাইডেন প্রশাসনের কঠোর সমালোচনা করছেন। অথচ ইউক্রেনের ওপর পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন চালানোর জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনকে দায়ী করে বক্তব্য দেওয়ার ব্যাপারে তার ভেতরে যে অনিচ্ছা কাজ করছে, সেটা বেশ স্পষ্টভাবেই বোঝা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক নির্বাচনি বিতর্কের সময়েও তিনি ইউক্রেনকে যুদ্ধে জেতানোর বিষয়ে নিজের অবস্থান স্পষ্ট করেননি। প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে ট্রাম্প উল্টো দাবি করেছেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকলে এই যুদ্ধ শুরুই হতো না। কিন্তু ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী কমালা হ্যারিসকে এর ঠিক বিপরীত অবস্থানে দেখা যাচ্ছে। তিনি সরাসরি ইউক্রেনের পক্ষে কথা বলছেন।
নানান যুক্তি তুলে ধরে মিজ হ্যারিস বলছেন যে, ‘কৌশলগত স্বার্থেই’ ইউক্রেনকে সমর্থন করা প্রয়োজন। এসব বক্তব্য প্রদানের সময় তিনি রুশ প্রেসিডেন্টকে ‘খুনি স্বৈরশাসক’ বলেও উল্লেখ করেছেন। অবশ্য রাশিয়ার টিভি চ্যানেলে যে মিজ হ্যারিসের খুব প্রশংসা করা হচ্ছে, তেমনটাও নয়।
কয়েক সপ্তাহ আগে রাশিয়ার একজন প্রথম সারির সংবাদ উপস্থাপককে মিজ হ্যারিসের রাজনৈতিক জ্ঞান ও সক্ষমতার বিষয়ে প্রশ্ন পর্যন্ত তুলতে দেখা গেছে। মার্কিন ডেমোক্র্যাটপ্রার্থীকে তিনি রাজনীতির মাঠ ছেড়ে টিভিতে রান্নার অনুষ্ঠান করার পরামর্শ দিয়েছেন। তবে এসব আলাপ-আলোচনার বাইরে মার্কিন নির্বাচন শেষ পর্যন্ত কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হতে যাচ্ছে, সেটি রাশিয়ার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, নির্বাচন যদি তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয় এবং ট্রাম্প ও হ্যারিসের মধ্যে একজন যদি সামান্য ব্যবধানে হেরে যান, সেক্ষেত্রে দু’পক্ষের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও রেষারেষি-বিতর্ক বেড়ে যাবে। এতে সারা দেশে নির্বাচন পরবর্তী বিশৃঙ্খলা, বিভ্রান্তি এবং সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়বে। ফলে সেগুলো ঠেকাতেই মার্কিন সরকার ব্যস্ত হয়ে পড়বে। এতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈদেশিক নীতির বিষয়ে তাদের মনোযোগ কম থাকবে বলে মনে করেন অনেকে।
সাবেক প্রসিডেন্ট বারাক ওবামা ক্ষমতা নেওয়ার পর রুশ-মার্কিন দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে। ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর সেটির আরও অবনতি হয়। জো বাইডেনের সময়েও অবস্থার উন্নতি হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত সদ্য সাবেক রুশ রাষ্ট্রদূত আনাতোলি আন্তোনোভের ভাষায়, বাইডের প্রশাসনের অধিনে রুশ-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক কার্যত ‘ভেঙে পড়েছে’। ওয়াশিংটন অবশ্য এ ঘটনার জন্য অবশ্য পুরোপুরিভাবে মস্কোকেই দায়ী করছেন।
জেনেভায় বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের মাত্র আট মাসের মাথায় ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আক্রমণের নির্দেশ দেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। এরপর রাশিয়ার ওপর রীতিমত নিষেধাজ্ঞার সুনামি বইয়েছে বাইডেন প্রশাসন। সেইসঙ্গে, গত আড়াই বছরেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধে টিকে থাকতে কিয়েভকে সামরিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।