প্রকাশিত হলো লিটলম্যাগ ‘দূরের সাইকেল’র ‘কবি জুয়েল মাজহার’ সংখ্যা
বাংলা সাহিত্যে এ সময়ের শক্তিমান কবি হিসেবে যাঁদের নাম, তাঁদেরই একজন কবি জুয়েল মাজহার। তাঁকে নিয়ে প্রকাশিত হলো লিটলম্যাগ ‘দূরের সাইকেল’র ‘কবি জুয়েল মাজহার’ সংখ্যা।
গতকাল শুক্রবার (২৭ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর কাটাবনের পাঠক সমাবেশকেন্দ্রে এই লিটলম্যাগটির প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। একইসঙ্গে কবি জুয়েল মাজহার ও তাঁর কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন বিশিষ্ট কবি-লেখক- সাহিত্যিকেরা।
এই আয়োজনে সভাপতিত্ব করেন লিটলম্যাগ ‘দূরের সাইকেল’-র সম্পাদক কবি হোসেন দেলওয়ার। আলোচনা করেন কবি আব্দুর রব, কবি ফরিদ কবির, কবি মুম রহমান ও কবি সোহেল হাসান গালিব। আয়োজনে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন কবি শেখ ফিরোজ আহমেদ বাবু। আয়োজন সঞ্চালনা করেন কবি মোকাতার হোসেন এবং কবি পারভীন মিনু।
আলোচনায় কবি সোহেল হাসান গালিব বলেন, আশির দশকের কিছু কবি ওই সময়ের নিয়মিত ধারা থেকে বের হয়ে এসেছেন। তাঁরা একটা নতুন ধরনের ভাষা দিয়ে কবিতাকে বক্তব্য নির্ভরতার জায়গা থেকে বের করে এনেছেন। এটি খুবই সচেতনতা নির্ভর একটা স্টাইল। বিশেষ করে একটা মুহূর্ত, যে মুহূর্তে অনুভবটা কবিতার মধ্যে ধরা পড়ে, সেই বার্তার একটা নান্দনিক উপস্থাপন আমরা এই কবির কবিতায় দেখি; যা কখনো পুরনো হয় না বা মনে হয় না এই ধরনের কবিতা আগে পড়া হয়েছে বা এই মেসেজটা আগেই পৌঁছে গেছে। এগুলো আমরা যেন সব সময় নতুনভাবে দেখি। আবার কিছু কবিতা আছে যেগুলো ফিলোসফিক্যালি কবিতা, যার বার্তাগুলো আমাদের কাছে আছে, এগুলো নতুন করে যখন পড়তে যায়, তখন মেজাজ খারাপ হয়। কিন্তু এই কবির কবিতায় সেই ব্যাপারটা হয় না।
তিনি বলেন, কবি জুয়েল মাজহার আমাদের কাটকাট কথার জায়গা থেকে একটা প্রবহমানতার দিকে নিয়ে গেলেন। সেখানে চমৎকার কিছু টানা গদ্যের কবিতা যেমন আছে, ঠিক একইভাবে এতদিনের ভাষার যে শৃঙ্খল ও শৃঙ্খলা ছিল, প্রমিত এবং শাসিত যে ব্যাপারটা ছিল, সেটার বাইরে যাওয়ার একটা প্রবণতা এই কবির কবিতায় আমরা দেখি। এই কবির কবিতা পড়লে বোঝা যায়, ব্যক্তিসত্ত্বা থেকে বেরিয়ে এসে তাঁর ভেতরে যে আরকেটা মানুষ বাস করে, সে তখন তাঁরনিজেঁর ভাষাটা নিয়ে হাজির হচ্ছে।
কবি মুম রহমান বলেন, কবি জুয়েল মাজহারের কবিতায় উপমার আলাদা একটা ধারা পাওয়া যায়। তাঁর কবিতা তাড়িত করে খুব, যন্ত্রণা দেয়, পীড়া দেয়; আরাম দেয় না। আর তাঁর কিছু কবিতায় আঞ্চলিক ভাষার চমৎকার চিত্রণ পাওয়া যায়। একসঙ্গে অনুবাদক হিসেবে তাঁকে আমি অত্যন্ত পছন্দ করি।
কবিতার বাঁক বদলের মধ্য দিয়ে কবি জুয়েল মাজহার কবিতায় স্বরাট করতে এসেছেন বলে আলোচনায় উল্লেখ করেন কবি ফরিদ কবির। তিনি বলেন, আমাদের এখানে যেটা হয়, কবিরা একই রকম কবিতা লিখতে থাকেন এবং লিখতেই থাকেন। এক সময় তা ফেলে দেন। ফলে পাঠকরাও একই রকমের কবিতা পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যান। তবে কোনো একটা জায়গাতে যে কোনো লেখাকে থামানো প্রয়োজন, এটা বোঝা উচিত। এটা যে শুধু লেখার ক্ষেত্রে শুধু নয়, প্রতিটা বইয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এটা জুয়েল মাজহারের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তাঁর একেকটা কবিতার বই একেক রকম। একজন কবি বুঝতে পারেন যে, ‘আমি আগে এরকম লিখেছি, এখন আরও একটি রকমে লেখা উচিত। ’ এই যে একটা কবিতা থেকে, একটা বই থেকে আরেকটা কবিতা বা বইয়ে যাওয়া, একটা রকম থেকে আরেকটা রকমে যাওয়া, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। যে কোনো বড় কবির কাজ হলো এটা জারি রাখা এবং জুয়েল মাজহার এখন পর্যন্ত সেটি ধরে রেখেছেন। একজন কবির কিছু কবিতা দেখলেই বোঝা যায় তিনি কবিতা শাসন করতে এসেছেন; সেটি এই কবির ক্ষেত্রে প্রখর।
আশির দশকের কবিতায় কবি জুয়েল মাজহার ভিন্নমাত্রা যোগ করেছেন উল্লেখ করে আলোচনা করেন কবি আব্দুর রব। তিনি বলেন, আশির দশকের কবিতার মূল যে ধরন, কবি জুয়েল মাজহার সেখান থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার কবিতায় কতগুলো ট্রেন্ড আছে। তাঁর কবিতা কখনো কখনো বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন পুরাণ যেমন 'মনসামঙ্গল' বা 'চর্যাপদে'র যে ধারা, তারই একটা আধুনিক ভার্সন। তাঁর কবিতায় কামনা-বাসনা, যৌনতার চূড়ান্ত রূপ দেখা যায়। অথচ সেগুলো প্রকাশের জন্য কোনো অশ্লীল শব্দের ব্যবহার নেই।
সব মিলিয়ে অত্যন্ত রসবোধ সম্পন্ন একজন কবি। যেসব নবীন কবি নতুন কবিতার সম্পর্কে জানতে চান, পড়তে চান শিখতে চান, ভাষাকে গভীরভাবে বুঝতে চান, তাঁদের জন্য জুয়েল মাজহারের কবিতা অনুসরণীয়।
‘জুয়েল মাজহারের কবিতা এক ধরনের গোপন নব অভিধান’ ---উল্লেখ করে কবি আব্দুর রব বলেন, যদি খুব যত্ন করে তাঁর কবিতা দেখা যায়, তবে এটা লক্ষ্য করা যায় যে, সেটি যেন একটা গোপন ডিকশনারি। শব্দরা যেন সারাক্ষণ তাঁর কবিতায় নাচতে থাকে। তিনি যেন নটরাজের মতো এক কবি, তিনি যেন নটরাজের মতো শব্দ নিয়ে বিস্তার করেন তাঁর কবিতায়। তাঁর ‘রুবিকন’, ‘ঈর্ষার ইঞ্জিন’-এর মতো কবিতাগুলো তারই প্রমাণ। এই কারণেই কবি জুয়েল মাজহার অন্য সকলের থেকে আলাদা। আর যে ঐতিহ্যকে ধারণ করেন, ঐতিহ্যকে ধারণ করে নতুন ঐতিহ্যের পথ সামনে এনে দেন, আমি মনে করি এই কবি সেই কাজটিই খুব জোরালো ভাবে করেছেন, যা কালের বিচারে বহুকাল থেকে যাবে।
এ সময় সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসরের মধ্যমণি কবি ও বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের সম্পাদক জুয়েল মাজহার বলেন, আমি নিজেকে ভাঙতে চাই। প্রতিটি বইয়ে আমি নিজেকে অতিক্রম করে যেতে চাই। আমি পুরনো যা কিছু করেছি তা যেন শিশুর বানানো বালির প্রাসাদের মতো ভেঙে দিতে পারি, সেই সাহস আমার থাকে। আমি জানিনা বাংলা ভাষায় আমি নতুন কিছু যোগ করেছি কিনা, তবে আমার সঙ্গে যাঁরা লিখতে এসেছিলেন, আমি তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চাই। তাঁরা তো আমারই অংশ। আমি অংশ যেমন তাঁদের। আমি আমার কোনো কোনো কবিতায় আশির দশকের সময়টাকেও ধরেছি। সেই সময়টাকে তুলে আনতে চেষ্টা করেছি।
এ সময় তিনি আসরে উপস্থিত তাঁর স্ত্রী শিরীন সুলতানা এবং সন্তান অর্ক মাজহারের প্রতি- ‘এদের কাছে আমার অনেক ঋণ আছে’ মন্তব্য করে বিশেষ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
অজস্র কবিতা অনুবাদের অভিজ্ঞতা থেকে বাংলা কবিতা নিয়ে এ সময় জুয়েল মাজহার বলেন, আমাদের বাইরের কবিতাকে আমরা বাংলায় অনুবাদ করি এবং সেগুলো পড়ি। আমরা নাইজেরিয়ার একজন কবিকে পড়ি, লাতিন আমেরিকার কবিকে পড়ি, কিন্তু বাংলা ভাষা অনেক সমৃদ্ধ একটি ভাষা। আমি মনে করি, পৃথিবীর সর্বোত্তম কবিতার ভাষা হলো বাংলা। আমাদের এখানে যে কবিতা লেখা হচ্ছে, তার চেয়ে এখনকার ফরাসি ভাষার, ইংরেজি ভাষার কবিতা উন্নততর বলে আমি মনে করি না। বাঙালি কবিদের কবিতাও অনুবাদ করা উচিত। সেই সাহসে ভর করে আমি বাংলা কবিতাও অনুবাদ করেছি, করে চলেছি। আমাদের সকলেরই বাংলা কবিতার কাছে খুব ভালোভাবে আসা উচিত।
সভাপতির বক্তব্যে লিটলম্যাগ ‘দূরের সাইকেল’ সম্পাদক হোসেন দেলওয়ার ‘কবি জুয়েল মাজহার’ সংখ্যা নিয়ে বলেন, আমি মনে করি কবি জুয়েল মাজহারের কবিতা পড়তে হলে পাঠককেও দীক্ষিত হতে হবে। তাঁর কবিতা পড়তে হলে পাঠককেও একটা পড়াশোনার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। একটি ভালো কবিতা যখন লেখা হয়ে যায়, সেই কবিতাটি তখন তা আর সেই লেখকের থাকে না, কবিতাটি সকলের হয়ে যায়। সেদিক থেকে আমি গর্ব করতে পারি যে আমি জুয়েল মাজহারের সময় জন্মগ্রহণ করেছিলাম, তাঁর কবিতার পাঠক হতে পেরেছিলাম।
এ সময় তিনি কবি জুয়েল মাজহারের ‘মেগাস্থিনিসের হাসি’ কবিতাটি পাঠের মাধ্যমে আয়োজনের সমাপ্তি ঘোষণা করেন।
আসরে আলোচনার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন কবি কুমার চক্রবর্তী, কবি চঞ্চল আশরাফ, কবি হাসান রোবায়েত, কবি রিক্তা রিচি এবং কবি প্রিয়াঙ্কা আশ্চার্য্য। আর জুয়েল মাজহারের ‘রুবিকন’ কবিতার নিজের করা ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান রণজিৎ দাশ।
এ সময় অনুষ্ঠানে কবি-লেখক-পাঠক-সমালোচকদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন আবদুর রাজ্জাক, কাজল শাহনেওয়াজ, শামস আল মমিন, শিহাব শাহরিয়ার, ওবায়েদ আকাশ, জিল্লুর রহমান, আলী আফজাল খান, ফারুক আহমেদ, মাসুদ হাসান, শাহেদ কায়েস, সরদার ফারুক, বিপুল অধিকারী, শামীম জাহান, বিধান সাহা, সারাজাত সৌম, মোজাফফর হোসেন, শিরিন সুলতানা, মণিকা চক্রবর্তী, মেঘ অদিতি, সুমী সিকান্দার, সাবেরা তাবাস্সুম, ফারহানা রহমান, অজিত দাশ, জেবুন্নেসা হেলেন, আমির খসরু স্বপন, আহসান হাবীব, সায়েম রানা, ধ্রুব সাদিক, রণজিৎ দাশ, মনিরুজ্জামান রিয়াদ, আফিফি ঈশিতা, অর্ক মাজহার, ওয়াসিকুর রহমান মনির, বিপুল অধিকারী, শাহানা পারভীন, অনিরুদ্ধ দেলওয়ার, মাহবুবা ফারুক, মীর রবি, সানাউল্লাহ সাগর, বাদল ধারা, তিথি আফরোজ, সুরঞ্জনা দাশ ও পাঠক সমাবেশের কর্ণধার সাহিদুল ইসলাম বিজুসহ অনেক বিশিষ্টজন।