শেষ কিস্তি
ঔপনিবেশিক বুকাননের চোখে চট্টগ্রাম
(গত কিস্তির পর)
৪.
বুকাননের পরিকল্পনায় পুরোনো আদিম অরণ্য দুটো কারণে রাখা যাবে না। প্রথমত, সেটা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভজনক নয় কোম্পানির কাছে। যত ইজারা, ভূমি বন্দোব্স্ত, তত বেশি বাড়তি খাজনা। ফলে নগদ অর্থকরী কিছু ফলছে না এমন যেকোনো ভূমিই এমন বণিকের চোখে অপচয়। অন্যদিকে, অরণ্য মানেই তো পশুদের আশ্রয়, যারা ফসলের ক্ষতি করে কিংবা গবাদিপশু বা মানুষের। ফলে এদের আশ্রয় দেয়, এমন কিছু থাকতে পারবে না। উদ্ভিদবিষয়ক জ্ঞান, কৃষিবিদ্যা সেখানে বাণিজ্যের জ্ঞানের পরিপূরক মাত্র। যেমন, ১৪ মে ১৭৯৩ সালে তিনি লিখছেন :
‘যেকোনোভাবেই হোক, পাহাড়গুলোকে পরিষ্কার করে ফেলতেই হবে, তারপর সেখানে পাওয়া যাবে পশুখাদ্য, আর সেখানে কোনো হিংস্র পশু আশ্রয় পাবে না, যেগুলো এখানে বর্তমানে প্রচুর পরিমাণে আছে বলে বলা হয়; যদিও এগুলোর বিপদকে অনেকখানিই বাড়িয়ে বলা হয় বলেই আমার বিশ্বাস।’
আর মানুষ যত এনে ফেলা যাবে, যত বসতি বাড়বে, তত বাড়বে এই বন্দোবস্ত। তত খাজনা আসবে কোম্পানির তহবিলে। ফলে এপ্রিল ২৯ তারিখের বিবরণে রাঙামাটির কাজুলাঙ নদীর মুখে ছোট ছোট টিলা দেখে বুকাননের অনুভূতি :
‘এই গ্রামের আশপাশের মাটি চমৎকার, তবে স্থানীয়রা এর সামান্যই ব্যবহার করে, কেবল কিছু জায়গায় তারা সুপারি লাগিয়েছে... আমরা যতই এগোলাম, এলাকাটা সীতাকা ঘাটের মতই নিচু পাহাড় দিয়ে গঠিত; আর সেখানকার মতই পাহাড়ের মধ্যবর্তী সমতল ভূমিগুলোতে তুলনামূলকভাবে জনবসতিও বেশ ভালো, কেননা, জুম চাষির জন্য পাহাড়ই সবচে উপযুক্ত, যেটা এখানে চাষের একমাত্র পদ্ধতি। জ্যামাইকাতে আমার দেখা সবচে ভালো কিছু নিষ্কর জমির মত একদম হুবহু এই জেলাটা, আর একই পদ্ধতিতে আবাদ করা হলে সহজে আর সুপ্রাচুর্যে বহু হাজার অধিবাসীর ভরণপোষণ করতে পারবে।’
৫.
ভূমি শুধু বণিকের চোখেই দখলের আরাধ্য নয়। যে লাতিন উৎস থেকে আসা কলোনি শব্দটির অনুবাদ হয়েছে উপনিবেশ, তার আদি অর্থও আসলে কৃষকই। নতুন স্থানে আবাদ করাকেই বোঝাত তা। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সংকটে প্রকৃতির পিছু হটা বিশ্ব ইতিহাসে বারংবারই ঘটেছে। মহাভারতে ‘খাণ্ডব দাহন’ অরণ্যচারী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কৃষিবিস্তারী জনগোষ্ঠীর সংগ্রামেরই একটা বিবরণ। আগুন লাগিয়ে বন বিনাশ করে সেটাকে কৃষির আওতায় আনার চল ছিল ভারতের শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে। প্রক্রিয়াটিকে মহত্ত্ব দিল, স্মরণীয় করে রাখল ঘটনার স্মৃতির সঙ্গে পঞ্চপাণ্ডবকে যুক্ত করে নিয়ে মহাভারতে তার স্থানলাভ। আগুন শুষ্ক অরণ্যভূমিতে এই কৃষিপত্তনের সূচক বলেই তা এত পবিত্র, এমনকি নিম্নগঙ্গার জলাময় ম্লেচ্ছ অঞ্চল যে অশুচি, কারণ আগুন তাকে স্পর্শ করে শুচি করে নিতে পারেনি। কিন্তু কৃষির বিস্তারের ফলেই জনসংখ্যা তো গঙ্গা অববাহিকায় ধীরে ধীরে বাড়ছিল, যত বেশি খাদ্য উৎপাদন, তত বেশি হারে মাথার সংখ্যার বিস্তার হচ্ছিল। মুকুন্দরামের ‘কালকেতু আর ফুল্লরার উপাখ্যান’ও আরেক যুগে, মোগল আমলে আধুনিক পশ্চিম বাংলা এলাকায় অরণ্যের রূপান্তরের কাহিনী, বলেছেন রিচার্ড এম ইটন। এটাও অলৌকিকত্ব পায় প্রাক-আধুনিক মননের গুণেই। দেবীর আদেশেই কালকেতু নগরপত্তনে হাত দেয়, সে শিকারবৃত্তি ছাড়লে যেন প্রাণিকুল বংশবিস্তার করতে পারে। দেবীর আদেশে :
‘মহাবীর কাটে বন শুনি বেরুনিয়া জন
আইসে তারা দেশে দেশে হইতে
কাঠদা কুঠার বাসী টাঙ্গী কিনে রাশি রাশি
কিনে বীর সভাকারে দিতে।’
এই্ হলো জলকাদার দেশে অরণ্য সাফ করার বর্ণনা, কেননা ভেজা এই প্রকৃতিতে শুষ্ক ভারতের মতো অগ্নিদাহ ভূমিকে শুচি করছে না। প্রতিটি গাছকে তাই আলাদা করে কাটতে হচ্ছে, প্রতিটি ঝোপকে আলাদা করে উপড়ে ফেলতে হচ্ছে। এরপরও আছে দীর্ঘকাল ধরে উৎপাত করে যাওয়া শিকড়বাকড়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। তবেই জমি লাঙলের ডাকে সাড়া দিত জলকাদার বাংলায়। এখানকার প্রধান বৃক্ষ শালের তাই আরেক নাম গজারি, কেননা উপড়ে ফেলার বহু বছর পরও তার শিকড় থেকে শালের ছানাপোনা উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে। অরণ্যের এই নিধনের ফলে পশুদের কী হাল হলো, তারও বিবরণ মুকুন্দরাম দিয়েছেন :
‘ভোজন করিয়া জন প্রবেশ করিল বন
সহস্র বেরুনিয়া জন
বনকাটে দিয়া গাড়া পাইআ বেরুনিঞার সাড়া
ধায় বাঘ করিআ করুণ।’
মুকুন্দরামের কালকেতুর নগর পত্তনের আখ্যান, তাই অরণ্যের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে কৃষির বিকাশের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তারই রূপক বিবরণ। অরণ্যের ভূমি দখল এখানেও ঘটে বটে, কিন্তু তারপরও কৃষকের সঙ্গে বণিকের একটা পার্থক্য আছে, সেটা মৌলিক বটে। কৃষক ঐতিহ্যের বিস্তার চায়, প্রজন্মান্তরে একই জমিতে তার উত্তরাধিকার চায়। জবির উর্বরতা, পানি-মাছ-পোকামাকড়ের সংরক্ষণ এবং এগুলোর সম্পর্কে জ্ঞান তার জন্য জরুরি। প্রাচীন বনি ইসরায়েল তাই প্রতি সপ্তম বছর ভূমিকে বিশ্রাম দিত তার উর্বরতা ফিরিয়ে আনতে, যেমন প্রতি সপ্তম দিবসে আমরা বিশ্রাম নিই। আমাদের গ্রাম্য জেলেও বিল কিংবা হাওরে কিছু স্থানে শিকার করত না ডিম ভরা মাছকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য। এখানেই বণিকের চঞ্চলতার সঙ্গে কৃষকের স্থিতির পার্থক্য। অরণ্য ধ্বংস করে আবাদ করলেও কৃষক গড়ে নিয়েছিল নতুন একটা গ্রামীণ বাস্তুসংস্থান।
বণিকের মন ভূমি থেকে দ্রুত মুনাফা চায়। শুধু খাঁটি বণিক নন, প্রশাসন-রাষ্ট্র কিংবা আর যেকোনো সূত্রেও ক্ষমতাবানও বণিক বনে যেতে পারেন, যদি যথা সুযোগ মেলে। আর বণিকের চোখ দিয়েই যখন দেশকে, মাটিকে, পাহাড়কে ক্ষমতাধর সকলে দেখেন, পরিণতি কী হয়, তাই আমরা পাহাড়ে দেখলাম।
৬.
ঔপনিবেশিক বা দখলদারের চোখ দিয়ে ভূমিকে দেখার এই প্রক্রিয়াটি সাহিত্যিকদের চোখ এড়ায়নি। রবীন্দ্রনাথের মুক্তধারা তার অনন্য উদাহরণ। অমিয়ভূষণ মজুমদার যেমন তাঁর ‘মহিষকুড়ার উপকথা’য় খেয়াল করিয়ে দেন, অরণ্য আর অরণ্যের অধিকারে নেই। হয় ব্যক্তির কিংবা রাষ্ট্র এখন তার মালিক। অরণ্যের সাথে সভ্যতার এই দ্বন্দ্বের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত একটি ধ্রুপদি শিল্প হলো জাপানি চলচ্চিত্রকার হায়ায়ি মিয়াজাকির বানানো রাজকুমারী মনোনোকের কাহিনী। দেয়ালঘেরা লৌহনগরী সেখানে প্রভুত্ব বিস্তার করতে চায় অরণ্যের আত্মার ওপর, চায় তার কাটামুণ্ডু। জাপানি আরেকজন চলচ্চিত্রকার কুরোশাওয়াও এই দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন কয়েকটি স্বপ্নদৃশ্যে। এই সবই প্রকৃতিকে দেখার ভিন্ন চোখগুলো যে শক্তিশালী হয়ে উঠছে, বণিকের তড়িৎ লাভ তুলে নেওয়ার বিপরীতে মানুষ দীর্ঘ মেয়াদে লাভক্ষতির হিসাবও শিখছে, তারই স্মারক। যে শিল্পবিপ্লবে ইউরোপ থেকে বহু আদিম অরণ্য বিলীন হয়ে গিয়েছিল, সেখানে অচিরেই তাই আমরা দেখি প্রকৃতির শেষটুকুকে রক্ষার প্রাণপণ চেষ্টা।
ন্যাড়া আর খোঁড়া পাহাড়গুলোই ধসে পড়েছে, এই বাক্যটা শুনলে আমাদের স্মৃতিতে ভাসে বুকাননের সেই অপ্রয়োজনীয় ঝোপঝাড় সাফ করে ফেলার বাসনার কথা। বৃক্ষের শিকড়ে বৃষ্টির পানি ধরে না রাখলে কোনো পাহাড়ি ঝর্ণারই অস্তিত্ব থাকত না, পানির অভাবেই একসময় সকল কৃষির কঠিনতর হয়ে যাওয়ার কথা, শুধু তাই না, শুষ্ক মাটির উর্বর অংশটুকুকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে বাতাসও, দ্রবীভূত করে উধাও করে দেবে পানিও। শিকড়গুলোই যে মাটিকে ধরে রাখে, এই তথ্য যে বুকাননের জানা ছিল, ওপরের জুম চাষ সম্পর্কিত একটি উদ্ধৃতিতে তার নমুনা আছে। কিন্তু সেই দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির বিবেচনা বণিকের মন করতে রাজি হবে না। এক পাহাড় ধসে গেলে আরেক পাহাড়ে যাবে সে, তারপর আরেকটা... আর বুনো প্রাণীর দাম তো তার কাছে কানাকড়িও নেই।
অবশ্য এই জনপদের মানুষের কপাল ভালো, বুকাননের সুপারিশ কিংবা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রকল্প সফল হয়নি। সম্ভবত ওই সময়েই বিপুল বিনিয়োগের চাহিদার তুলনায় মসলার বাণিজ্যের মুনাফা কমে আসার সম্ভাবনা একটা কারণ, হয়তো এরপরই বাঙলার দেওয়ানি নিয়ে এবং ভারতেও অনেকগুলো আগ্রাসী দখলদার যুদ্ধ নিয়ে মশগুল থাকতে হয়েছিল, হয়তো ওলন্দাজদের ক্রমশ শক্তিহীন হয়ে পড়ায় অচিরেই মালয়েশিয়া-ইন্দোনেশিয়ার মশলা-অঞ্চলগুলোর ওপর ব্রিটিশদের আধিপত্য বিস্তারের সম্ভাবনাও হয়তো আর একটা কারণ। মসলার চাহিদাও তো ধীরে কমে আসছিল, সম্ভবত ইউরোপজুড়ে উন্নত-পরিকল্পিত গো-খাদ্যের চাষের কারণে মাংসের সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা আর শুঁটকি করার চাহিদাও যাচ্ছিল কমে। হয়তো সব মিলেই আরাকান সীমান্তে মসলার চাষের বিস্তারের দরকার পড়েনি তখন আর। এরপর তো ইউরোপীয়রা মসলা দেওয়া খাবারের কথাই গেল ভুলে... কিন্তু একটু অন্যরকম হলেই শত বছর আগেই সীমান্তের এই পাহাড়গুলো শুষ্ক শীতের বাতাসে মাটির অগ্রভাগটুকু হারিয়ে, সম্পূর্ণ উর্বরতাহীন হয়ে, প্রতি বৃষ্টিতে গলে গলে ধস নামিয়ে বিলীন হয়ে যেতে পারত।
৭.
ইতিহাস একবার আমাদের রক্ষা করেছে, ঘটনাক্রমে বাঁচিয়ে দিয়েছে প্রবল শক্তিশালী কোম্পানি রাজের হাত থেকে পাহাড়গুলোকে। এখন আমরা নিজেরাই মালিক, নিজেরা তাকিয়ে আছি একই রকম ক্ষুধাতুর বণিকের দৃষ্টি নিয়ে, আমাদের নিজের ভূমি, নিজের পাহাড়ের দিকে। অজস্র পাহাড়ের স্বাভাবিক বৃক্ষগুলোকে কেটে রোপণ করেছি ইউক্যালিপটাস আর একাশিয়া কিংবা মেহগনি। গড়ছি ছাউনি, কাটছি পাহাড়ের গোড়া, সমতল ভূমির মতো করে আবাদ করছি বাণিজ্যিক সবজি ও ফল, আগাছা দমনের নামে বড় অংশের মাটিকে উন্মুক্ত করে ফেলছি বর্ষায় গলে পড়া আর শীতের বাতাসে উড়ে যাওয়ার মুখে। উর্বরতা তাই ক্ষয় পেলে ঢালছি সার। শুধু কি তাই! পাহাড়ে ঠেলে দিচ্ছি সমতলভূমির অসহায় ভূমিহীনদের, আরো, আরো ভেতরে। এই লেখা শেষ করার মুহূর্তে পড়লাম দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় : ‘এক চতুর্থাংশ বনভূমি ধ্বংস হয়েছে, ৬১ শতাংশ ঝর্ণা শুকিয়ে গেছে, ভূতাত্ত্বিক গঠন নষ্ট করে সড়ক নির্মাণ, পাহাড় কেটে ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসতি নির্মাণ।’ ভিত্তি হারানো, ঝোপঝাড়হীন পাহাড় বৃষ্টিতে তাই কাদার স্তূপ হয়ে গলে গলে পড়ছে। সমূহ বিপর্যয় থেকে তাদের এইবার বাঁচাবে কে—জেগে ওঠা চেতনা ছাড়া?
(শেষ)
তথ্যসূত্র :
ফ্রান্সিস বুকানন, ফ্রান্সিস বুকানন ইন দ্য সাউথ ইস্ট বেঙ্গল (১৭৯৮), ইউপিএল, ১৯৯২।