বিশ্বসেরা ১০০ বই
তলস্তয়ের ‘আন্না কারেনিনা’
রুশ লেখক লেভ তলস্তয়ের বিখ্যাত উপন্যাস ‘আন্না কারেনিনা’। ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৭ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ‘দ্য রাশিয়ান ম্যাসেঞ্জার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় দীর্ঘ এই উপন্যাস।
তবে পরে পত্রিকার সম্পাদক মিকাইল কাতকোভের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধের কারণে উপন্যাসটির শেষাংশ ছাপা হয়নি। কারণ সার্বিয়াতে রাশিয়ার স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠানোর বিরুদ্ধে ছিলেন তলস্তয়।
১৮৭৮ সালে প্রকাশিত বইতে তলস্তয়ের লেখা পুরো উপন্যাসটি পাওয়া যায়। বাস্তববাদী উপন্যাসের অনন্য নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয় তলস্তয়ের এই উপন্যাসকে।
তলস্তয় নিজেও মনে করেন ‘আন্না কারেনিনা’ তাঁর প্রথম সত্যিকারের উপন্যাস। তবে ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’কে তিনি উপন্যাসের চেয়েও বেশি কিছু মনে করেন।
কাহিনী সংক্ষেপ
তলস্তয়ের অন্যতম সেরা কাজ মনে করা হয় ‘আন্না কারেনিনা’ উপন্যাসকে। বিংশ শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হিসেবেও বিবেচিত হয় ‘আন্না কারেনিনা’। ভালোবাসার গল্পের মধ্য দিয়ে এই উপন্যাসে রাশিয়ার উঁচুতলার রাজনীতি, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তুলে ধরেছেন তলস্তয়।
উপন্যাসটির গল্প শুরু হয় প্রিন্স স্টিফেন ওবলোনস্কি যিনি স্টিভা নামে পরিচিত এবং তার স্ত্রী ডলিকে নিয়ে। তাদের দাম্পত্য জীবনে চলছে টানাপড়েন। কারণ গৃহপরিচারিকার সাথে ওবলোনস্কির প্রেমের সম্পর্ক জেনে গেছে ডলি। আর তাই বিচ্ছেদ চাইছে সে।
এদিকে ওবলোনস্কির বোন আন্না কারেনিনা ঘুরতে আসছে তাদের বাড়িতে। আন্নার স্বামী সেন্ট পিটার্সবার্গের একজন ক্ষমতাধর সরকারি কর্মকর্তা। রাশিয়ার উচ্চবিত্ত সমাজে আন্না কারেনিনা বেশ জনপ্রিয় তার রুচি এবং ব্যবহারের কারণে।
আন্না এসে ডলিকে বোঝাতে সক্ষম হয় এবং ওবলোনস্কির ঘর আপাতত টিকে যায়। ওবলোনস্কির দুই বন্ধু লেভিন ও ভ্রোনস্কি। এক পার্টিতে লেভিনের সাথে দেখা হয় আন্নার। এর কিছুদিন পরই মস্কো ছেড়ে সেন্ট পিটার্সবার্গের দিকে রওনা দেয় আন্না। ট্রেন যাত্রার বিরতিতে আন্নার সাথে দেখা হয় ভ্রোনস্কির। ভ্রোনস্কি একজন সেনা কর্মকর্তা। সেখানেই আকস্মিকভাবে আন্নার প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা জানায় ভ্রোনস্কি। কিন্তু আন্না জানায়, এই প্রস্তাব তাঁর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
যদিও সেন্ট পিটার্সবার্গে পৌঁছানোর পর ভ্রোনস্কির সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুল হয়ে যায় আন্না। যেসব পার্টিতে ভ্রোনস্কি যেতে পারে সেসব জায়গায় যাওয়া শুরু করে সে। নিজেকে আন্না বোঝায়, এটা ভালোবাসা নয় কিন্তু নিজের প্রতি অন্যের এই মনোযোগটা সে উপভোগ করে। আর তাই বারবার ভ্রোনস্কিকে খোঁজে সে।
দ্রুতই ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যায়। আন্না ও ভ্রোনস্কির প্রেম নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়ে যায় সেন্ট পিটার্সবার্গের উঁচু মহলে। ব্যাপারটা মেনে নিতে পারে না আন্নার স্বামী। দূরত্ব তৈরি হয় তাদের মধ্যে। ভ্রোনস্কির কাছে গিয়ে আন্না জানায় তাঁর মনের কথা, ‘সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। তুমি ছাড়া এখন আমার আর কিছু নেই। সেটা মনে রেখো।’
সেন্ট পিটার্সবার্গের উঁচুতলার মানুষদের কাছে গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে আন্না আর ভ্রোনস্কির প্রেম। ভ্রোনস্কি ও তার ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় ভ্রোনস্কির পরিবার। এদিকে আন্না জানায় সে সন্তানসম্ভবা। ভ্রোনস্কির প্রতি আন্নার দুর্বলতা বাড়তেই থাকে, স্বামীর কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায় আন্না।
কিন্তু ভ্রোনস্কির সাথে আন্নার সম্পর্ক কিছুতেই মেনে নিতে পারে না আন্নার স্বামী কারেনিন। প্রয়োজনে জোর করে হলেও ভ্রোনস্কির কাছ থেকে আন্নাকে দূরে সরিয়ে আনতে চায় সে। অন্যদিকে আন্নার সাথে থাকার জন্য সেন্ট পিটার্সবার্গের বাইরে ভালো কাজের সুযোগ পেয়েও যেতে রাজি হয় না ভ্রোনস্কি।
এদিকে ভ্রোনস্কির কাছ থেকে আন্নাকে দূরে সরাতে ব্যর্থ হন কারেনিন। আর তাই বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেন কারেনিন। ভ্রোনস্কির কন্যাসন্তান জন্ম দিতে গিয়ে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পৌঁছে যায় আন্না। এ সময় কারেনিনের কাছে ক্ষমা চায় ভ্রোনস্কি এবং আন্নাকে তালাক দেওয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু কারেনিন জানায়, সে কখনো আন্নাকে ছাড়তে পারবে না। এ কথা শুনে আত্মহত্যার চেষ্টা করে ভ্রোনস্কি, কিন্তু ভাগ্যগুণে বেঁচে যায় সে।
রাশিয়া ছেড়ে ইতালিতে চলে যায় ভ্রোনস্কি ও আন্না। সেখানে গিয়ে শিল্পকলার প্রতি টান আকর্ষণ করে ভ্রোনস্কি। আন্নার ছবি আঁকা শুরু করে সে। একসময় আবার রাশিয়ায় ফিরে আসে তারা। কিন্তু সেন্ট পিটার্সবার্গের উঁচু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে আন্না।
আস্তে আস্তে হতাশা ভর করতে থাকে আন্নার ওপর। আর আন্নার চাহিদা মেটাতে গিয়ে ভ্রোনস্কিও তার থেকে দূরে সরে যেতে থাকে। একসময় বিরক্ত হয়ে যায় ভ্রোনস্কি। অথচ এতদিন পরও আন্নাকে আনুষ্ঠানিকভাবে তালাক দিতে অস্বীকৃতি জানায় কারেনিন।
ভ্রোনস্কির মা আন্নাকে ছেড়ে প্রিন্সেস সরোকিনকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয় ভ্রোনস্কিকে। ঝগড়া বাড়তেই থাকে আন্না আর ভ্রোনস্কির মধ্যে। একসময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে আন্না। ভ্রোনস্কিকে ছেড়ে ডলির কাছে চলে যায় সে। কিন্তু সেখানে আন্নাকে কেউ সহজভাবে মেনে নিতে পারে না।
আন্না আরো একা হয়ে পড়ে একসময় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আন্না তার চেনা পরিবেশ থেকে দূরে চলে যায়।
লেখক পরিচিতি
পুরো নাম কাউন্ট লেভ নিকোলাভিচ তলস্তয়, কিন্তু সবার কাছে তিনি পরিচিত লিও তলস্তয় নামে। ১৮২৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর (মতান্তরে ২৮ আগস্ট) তাঁর জন্ম। রুশ এই লেখক নিজের সময়ে তো বটেই এখনো বিশ্বসাহিত্যে অন্যতম সেরা একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে সমান সমাদৃত।
তলস্তয় জন্মেছিলেন ধনী এক রুশ পরিবারে। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ওয়ার অ্যান্ড পিস (১৮৬৯), আন্না কারেনিনা (১৮৭৭)। এই দুই উপন্যাসকে বাস্তববাদের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হিসেবে গণ্য করা হয়।
তলস্তয়ের লেখালেখি শুরু ২০ বছর বয়স থেকেই। সেই সময়ে তাঁর তিনটি আত্মজীবনীমূলক লেখা তাঁকে লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই ট্রিলোজির তিনটি হলো ‘চাইল্ডহুড’, ‘বয়হুড’ ও ‘ইয়োথ’। ১৮৫২ থেকে ১৮৫৬ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয় বই তিনটি। ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর আরেকটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘সেভাস্তোপোল স্কেচেস’। ক্রিমিয়ান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নিয়ে উপন্যাসটি লিখেছিলেন তিনি।
উপন্যাসের পাশাপাশি ছোটগল্প, উপন্যাসিকাও লিখেছেন তিনি। ১৯১০ সালের ২০ নভেম্বর (মতান্তরে ৭ নভেম্বর) মারা যান তলস্তয়।
** বিশ্বসেরা ১০০ বইয়ের তালিকাটি তৈরি করা হয়েছে ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত তালিকা অবলম্বনে। এ তালিকা তৈরি করেছে ‘নরওয়েজিয়ান বুক ক্লাবস’। বিশ্বের ৫৪টি দেশের ১০০ লেখকের কাছে তাঁদের চোখে সেরা ১০টি বই ও লেখকের নাম চেয়েছিল নরওয়েজিয়ান বুক ক্লাবস। ১০০ জন লেখকের দেওয়া সেই তালিকার ভিত্তিতেই যাচাই-বাছাই করে তৈরি করা হয়েছে এই তালিকা।