‘ছোটদের সময় জুলাই বিপ্লব সংকলন’-এর মোড়ক উন্মোচন
‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছড়াসাহিত্যের ভূমিকা শীর্ষক আলোচনা ও ছোটদের সময় জুলাই-বিপ্লব সংকলন’প্রকাশ করেছে শিশু কিশোর বিষয়ক পত্রিকা ‘ছোটদের সময়’। প্রায় শতাধিক লেখকের লেখা নিয়ে সম্পাদক মামুন সারওয়ার সংকলনটি প্রকাশ করেন। বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের (আমাই) হল রুমে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংখ্যাটির মোড়ক ও সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়।
ইমরান মাহফুজের উপস্থাপনায় খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার ফারুক হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন আমাই মহাপরিচালক অধ্যাপক ও লেখক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান, কবি ও শিশুসাহিত্যিক মনসুর আজিজ, লেখক ও গবেষক ড. কাজল রশীদ শাহীন, কবি আবিদ আজম, শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার আশিক মুস্তাফা ও কবি শামস আরেফিন।
শিশুসাহিত্যিক ফারুক হোসেন বলেন, আমার কর্মজীবনে ১৬ বছর ফ্যাসিবাদ সরকারকে পেয়েছি। এই সময়ে আমি সরকারের অন্যায়ের কথা অনিয়মের কথা লিখেছি। এজন্য আমাকে অনেকেই বলেছে ‘তুমি তো বিপদে পড়ে যাবা’। আমি বললাম ব্যক্তিগতভাবে কাউকে আক্রমণ করছি না। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লিখছি। তাই আজ ১৫টি ছড়া নির্বাচন করেছি অনুষ্ঠানে পড়ার জন্য।
এসময় তিনি সাভারের ঘটনা, পাতিনেতার পোস্টারসহ ৭১ থেকে শুরু করে নানা সমসায়িক বিষয় নিয়ে প্রতিবাদী ছড়া লেখার কথা জানান।
ফারুক হোসেন আরও বলেন, আমরা এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যদি সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে না পারি তাহলে কিন্তু খুবই দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় পড়ে যাব। যত কষ্ট করে ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়েছি তার চেয়েও অনেক কষ্ট করে দেশকে গড়ে তুলতে হবে। দেশটি নিয়ে রাজনীতিবীদরা যা করেছে, তা ভাষায় প্রকাশের মতো নয়।
অনুষ্ঠানে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ছড়া সাহিত্যের ভূমিকা’শীর্ষক প্রবন্ধে মনসুর আজিজ বলেন, যুগে যুগে সমাজের নানা অসঙ্গতি, ত্রুটি বিচ্যুতি ছড়ার মাধ্যেমে তুলে ধরেছেন ছড়াশিল্পীগণ। সমাজ, রাজনৈতিক অধিকার ও ভূমিকা পালন করেছে ছড়া। শাসকের রোষানল থেকে বাঁচতে প্রথম দিকের রাজনৈতিক ছড়ায় কিছুটা আড়াল ছিলো। যেমন- ‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে’নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে বর্গীদের হামলা ও লুটতরাজের কথা প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখ্য ছড়াটিতে।
তবে রাজেনৈতিক ছড়ার সেই নেকাবটি সরে গেছে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, ৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ছড়ার উপস্থিতি সরাসরি লক্ষ্য করা যায়।
স্বাধীনতা উত্তর বাংলা ছড়াসাহিত্যে রাজনৈতিক নীতি ও দর্শন, আবেগ ও অধিকার, জুলুম ও স্বাধীকার প্রশ্নে ছড়াশিল্পীগণ কোনোরকম রাখঢাক ছাড়াই লিখেছেন সমাজ বদলের ছড়া। এমনিভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও স্বৈরাচার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্ররা ছড়ার ভাষায় ক্ষুব্ধ স্লোগান তোলেন, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!/ কে বলেছে, কে বলেছে/ স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।”এবং “চাইতে গেলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার।”এরপরই ছাত্রদের ওপর হাসিনার নির্বিচারে গুলি শুরু হলে আমাদের ছড়াকাররাও কলম ধরেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সেই দুঃশাসনে চিত্র আমরা দেখতে পাই কবিতা, ছড়া ও কালজয়ী গানে।
আমাই মহাপরিচালক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, বৈষম্যবিরোধীদের যদি আমরা সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি তাহলে দুটো কথা থাকে, প্রথমত যারা শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তাদের সঠিক হিসাব করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে কেন আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে না, যারা হাসপাতালে আছে তাদের সঠিক চিকিৎসা কেন হচ্ছে না।
মুহাম্মদ আসাদুজ্জামান আরও বলেন, দ্বিতীয়ত যারা ১৬ বছরে অফিস, আদালতে এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই বৈষম্য তৈরি করেছে তারা এখনও কেন সেই জায়গায় বহাল তবিয়েত রয়েছে। তাহলে আমরা এখনো সব জায়গা থেকে বৈষম্যমুক্ত হতে পারিনি।
লেখক ও গবেষক ড. কাজল রশীদ শাহীন বলেন, গণঅভ্যুত্থানের পর আমরা যে বাংলাদেশ চেয়েছিলাম সে বাংলাদেশের পথে আমরা কিন্তু হাঁটছি না। এ দায় হলো লেখক-কবি সমাজের। ছড়া শুধু শব্দ বা ছন্দ মেলানো না। আদিকাল থেকে যে ছড়াশক্তি দেখেছি সেটি অভ্যুত্থানে আমরা পাইনি। আমাদের ছড়ার ভেতরে ইতিহাস-ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতিসহ দেশ নির্মাণের প্রেরণা পেতে হবে। কিন্তু এই জায়গায় আমরা নেই।
কাজল রশীদ শাহীন আরও বলেন, পত্রিকায় শিশুদের পাতা সম্পাদনা করতে গিয়ে গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। যেমন ধরুন, ‘আগডুম বাগডুম ঘোড়াডুম সাজে’। এই ছড়া শুধু ছড়া নয় এখানে ‘আগডুম’দ্বারা বোঝানো হচ্ছে ‘সেই সৈনিক দল যারা রাস্তা পরিস্কার করে। ‘বাগডুম’হলো বাগ বিষণ্ন দল যারা হচ্ছে সীমান্ত রক্ষা করে। বরুড়া সমাজকে এরা রক্ষা করেছে। সেই চেতনা থেকে বলা হচ্ছে ‘আগডুম বাগডুম’ছড়াটি। এইভাবে ছড়া নির্মাণ করে তার গভীর থেকে গভীরতর অর্থ আমাদেরকে বুঝিয়ে দিতে হবে।
আলোচক আবিদ আজম বলেন, বাংলাদেশে প্রথম যেটা জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে কোনো শিশু-সাহিত্য পত্রিকা বেরিয়েছে। যা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো পারেনি। অভ্যুত্থানের সময় আমরা অনেক স্লোগান দেখতে পাই যেমন- “বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।” এমন নানা স্লোগান কারা লিখেছে সেটার কোনো সঠিক তথ্য নেই। একইভাবে অভ্যুত্থানের সময় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অনেক কবিতার লাইন স্লোগান হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেখেছি। কিন্তু সেভাবে রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দের পঙক্তি দেখিনি। এতে প্রমাণিত হয় যে কবি হিসেবে এখনো নজরুলই বেঁচে আছেন।
শিশুসাহিত্যিক ও ছড়াকার আশিক মুস্তাফা বলেন, আমি এমন একদল দুরন্ত কিশোরদের চিনি যারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমেছিল। এমনকি তারা তাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ‘দেয়াল পত্রিকা’পর্যন্ত প্রকাশ করেছে। তাদের কেউ কেউ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে।
অনুষ্ঠানে লেখক, নাট্যকার হিসেবে আরও উপস্থিত ছিলেন হুসনি মোবারক, সীমান্ত আকরাম, শাহরিয়ার শাহাদাত, সাইনটা ইসলাম, গাজী মুনসুর আজিজ, কামাল মুস্তাফা, শাকিব হুসাইন প্রমুখ।