গোদাগাড়ীতে আওয়ামী লীগপ্রার্থী মেয়র নির্বাচিত, অন্যদের ভোটবর্জন
রাজশাহীর গোদাগাড়ী পৌরসভার উপনির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের অয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস ছয় হাজার ২৮৫ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তবে নির্বাচন চলাকালে সকাল ১০টার দিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা গোলাম কিবরিয়া রুলু এবং দুপুর পৌনে ১২টার দিকে কারচুপির অভিযোগ এনে ভোট বর্জন করেন প্রয়াত মেয়র মনিরুল ইসলাম বাবুর সহধর্মিনী জান্নাতুল ফেরদাউস।
দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে জান্নাতুল স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ‘নারিকেল গাছ’ প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছিলেন। ভোট গণনা শেষে দেখা যায়, তিনি পেয়েছেন ৬১৬ ভোট। আর বিএনপি নেতা গোলাম কিবরিয়া রুলু মোবাইল ফোন প্রতীকে পেয়েছেন ২৭৬ ভোট।
এর আগের দিন আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক মেয়র ও জামায়াতে ইসলামীর বহিষ্কৃত নেতা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম নির্বাচনী পরিবেশ নেই এবং প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তুলে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। নির্বাচনে জগ প্রতীকে তিনি পেয়েছেন মাত্র ৩০ ভোট।
গোদাগাড়ী পৌরসভা নির্বাচনে নৌকা প্রতীক বাদে অন্য সব প্রার্থীদের এজেন্টকে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ উঠে। এর কোনো প্রতীকার না পেয়ে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ফেসবুক লাইভে এসে জান্নাতুল ফেরদাউস ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি সরকারি দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট লুটপাটেরও অভিযোগও করেন।
ফেসবুক লাইভে জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর থেকেই তিনি অনেক হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রতীক বরাদ্দের দিন থেকে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে তিনি যেসব পোস্টার-ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়েছিলেন, তা আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা প্রশাসনের সহায়তায় ছিঁড়ে ফেলেছে। থানায় অভিযোগ করলে তারা দেখিয়ে দেয় ইউএনওকে, ইউএনওর কাছে গেলে বলে উপজেলা রিটার্নিং অফিসারের কাছে যেতে। আর তাঁকে বললে তিনি বলেন, জেলা পর্যায়ে নির্বাচন কর্মকর্তাকে বলেন। এভাবে তাঁরা হয়রানি করেছেন। কিন্তু কেউ সহযোগিতা করেননি।
জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, তাঁর প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। মাইক ভেঙে ফেলা হয়েছে। সমর্থকদের মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। সপরিবারে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়েছে। তানোর-গোদাগাড়ীর দলের প্রধান তাঁকে প্রাণে মেরে ফেলার এবং পরিবারের ক্ষতি করার হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাকে ভোট করতে দিব না। পাস করতে দিব না, মাঠে নামতে দিব না।’ তাঁর কথা না শোনাতে তিনি উঠে পড়ে লেগেছেন। প্রতিটি পদক্ষেপে বাধা দিয়েছেন। সমর্থকদের প্রত্যেকের বাসায় বাসায় তল্লাশি করে কর্মীদের উঠিয়ে নিয়ে গেছেন।
ভোটের দিনের পরিস্থিতি বর্ণনা করে এই স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেন, ১৬টি কেন্দ্রে তিনি এজেন্ট দিয়েছেন। কিন্তু কোনোটিতেই তাঁর কোনো এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ১ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দ্রে তিনি গিয়েছিলেন। শাহীন, জামরুল ও কমিশনার জাব্বারের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাঁরা তাদের বাহিনী নিয়ে তাঁকে আক্রমণ করেছেন এবং তাঁকে কেন্দ্র থেকে ঠেলে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেই কেন্দ্রে তিনি এজেন্ট দেননি। অথচ তাঁরা নিজেদের মতো করে জান্নাতুলের একজন এজেন্ট পরিকল্পিতভাবে দিয়ে রেখেছেন। তাঁরা এভাবে একতরফাভাবে নৌকার ভোট করছেন। কেন্দ্রে কেউ ভোট দিতে গেলে ইভিএমে জোরপূর্বক নৌকাতে চাপ দেওয়ান। প্রতিটি কেন্দ্রে এভাবে আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থকেরা পাহারা দিয়ে ভোট নিচ্ছেন। এসব কারণে তিনি ভোট বর্জন করেছেন। এই ভোট তিনি মানেন না।
এদিকে, সকাল ১০টার দিকে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী বিএনপি নেতা গোলাম কিবরিয়া রুলু বলেন, সকালের দিকে পরিস্থিতি দেখে তিনি সিদ্ধান্ত নেন এই ভোট তিনি করবেন না। কোনো কেন্দ্রেই তাঁর এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ থেকে তাঁর প্রতীক মোবাইল ফোনের এজেন্ট বানিয়ে ভোটকক্ষে বসিয়ে রাখা হয়েছে। এ কারণে তিনি তাঁর সব সমর্থককে ভোট বর্জন করার আহ্বান জানিয়েছেন এবং নিজেও এই ভোট বর্জন করেছেন। তিনি দাবি করেন, যতোগুলো ভোট পড়েছে সকাল থেকে, তা নৌকার প্রার্থী জোর করেই নিয়েছে। তাই এই ভোট তিনি মানেন না। তিনি পুনরায় নির্বাচন চান।
একদিন আগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দেন সাবেক মেয়র জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলাম। বুধবার সন্ধ্যায় মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর ব্যানার ফেস্টুন খুলে ফেলা হচ্ছে, কর্মীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। নির্বাচন কমিশনে এসবের অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার না পেয়ে তিনি নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বলেন, সরকার দলীয় প্রার্থীকে বিজয়ী করতে স্থানীয় প্রশাসন সব ধরনের আয়োজন করেছে। তাই তিনি ভোট বর্জন করেছেন।
তবে ভোট বর্জনকারী তিন প্রার্থীর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন গোদাগাড়ী পৌরসভার একাধিক নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত নৌকার প্রার্থী অয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস। তিনি বলেন, বিএনপিনেতা গোলাম কিবরিয়া রুলু তো দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে এসে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। ফলে তাঁর দলীয় সমর্থকেরাই তাঁর পোস্টার ছিঁড়েছেন। জামায়াত নেতা আমিনুল ইসলাম নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করেছে। ফলে তিনি জানতেন নির্বাচনে তাঁর ভরাডুবি হবে। এ কারণে নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে তিনি একদিন আগে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
আর জান্নাতুল ফেরদৌসের অভিযোগের বিষয়ে অয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস বলেন, তাঁর স্বামী গোদাগাড়ী পৌরসভার মেয়র ছিলেন। তাঁর ভোট ছিল এলাকায়। জান্নাতুলের তো সেই অবস্থান নেই। এই এলাকায় ‘মহিলা মানুষ’কে কেউ ভোট দেয় না। খামাখা নির্বাচন করছেন তিনি। তাঁর সব অভিযোগই মিথ্যা। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচন চলাকালে কাউকেই বাধা দেয়নি।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মশিউর রহমান প্রার্থীদের ভোট বর্জন ও অভিযোগের বিষয়ে বলেন, একজন প্রার্থী ফেসবুক লাইভে এসে ভোট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন বলে শুনেছেন। তবে এ বিষয়ে লিখিত কোনো কিছু তিনি পাননি। আগের দিন একজন বর্জন করেছেন, সে বিষয়ে তাঁরা জেনেছেন। মোবাইল ফোন প্রতীকের প্রার্থী গোলাম কিবরিয়া রুলুর বর্জনের বিষয়েও তিনি অফিসিয়ালি কিছু জানেন না। উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আরও বলেন, নির্বাচনে কাউকে বাধা দেওয়া হয়নি। প্রশাসন সবাইকে সহযোগিতা করেছে। কোনো প্রার্থীর বিরুদ্ধে নন তাঁরা। সব প্রার্থীই তাঁদের কাছে সমান।
এদিকে, ভোট চলাকালে গোদাগাড়ী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কুঠিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সকালে ৬০ বছর বয়সী এক নারীকে কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেখা যায়। অল্প কিছুক্ষণ পর তিনি বের হয়েই আঙুল দেখান। আঙুলে কালির দাগ। তিনি বললেন, ‘ব্যাটা নৌকায় জোর করে ভোট দিয়া দিল এক ছেলে। আমি দিতে চাইনি। এখন এই কথা কী বলা যায়? ভোট দিতে পারলাম না ব্যাটা।’
গোদাগাড়ী পৌর নির্বাচনে সকাল থেকে কোথাও কোনো লাইন দেখা যায়নি। নৌকা প্রার্থীর সমর্থকেরা বলেকয়েও ভোটারদের কেন্দ্রে আনতে পারেননি। একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর বলেন, এখানে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা নৌকাকে ভোট দেবেন না। কারণ, তাঁরা জান্নাতুল ফেরদৌসকে ভালোবাসেন। কিন্তু ভোট দিতে পারছেন না। ভোট সুষ্ঠু হলে ভোটকেন্দ্রে লাইন থাকতো। প্রার্থীদের সঙ্গে ভোটাররাও ভোট বর্জন করেছেন।
একটি কেন্দ্রে নৌকা প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাঁরা তীর্থের কাকের মতো ভোটারের অপেক্ষায় আছেন। কিন্তু পাচ্ছেন না। অনেককে বাড়ি বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। তবু তাঁরা আসছেন না। মূলত সব প্রার্থীর বর্জনের কারণে এটা হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
ইভিএমে ভোট গ্রহণ শেষে গোদাগাড়ী পৌরসভা নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ মশিউর রহমান জানান, নির্বাচনে ৩২ হাজার ৯০৫ ভোটারের মধ্যে ভোট প্রদান করেছেন সাত হাজার ১৭১ জন। এর মধ্যে ছয় হাজার ২৮৫ ভোট পেয়ে বেসরকারিভাবে মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. অয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পৌর নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পয়ে ‘বিদ্রোহী’ হয়ে মেয়র নির্বাচিত হন মনিরুল ইসলাম। সেই নির্বাচনে তাঁর কাছে পরাজিত হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী অয়েজ উদ্দিন বিশ্বাস। এরপর এপ্রিলে ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে মনিরুল মারা যান। সে কারণেই এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।