বায়ু দূষণের শীর্ষে গাজীপুর, পরিচ্ছন্ন মাদারীপুর
দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে বায়ু দূষণের শীর্ষে রয়েছে গাজীপুর। একই সঙ্গে ভালো বাতাস বইছে মাদারীপুরে। দূষিত বাতাসের দিক দিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ঢাকা জেলা। আর ভালোর তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী।
বাতাসের মান নিয়ে করা স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও ক্যাপস-এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক ড. আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদারের গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে।
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে জহুর হোসেন চৌধুরী হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন ড. কামরুজ্জামান। গবেষণায় রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও সংস্কারকাজ, মেগাপ্রকল্প, আশপাশের ইটভাটা, ছোট-বড় কয়েক হাজার শিল্প কারখানা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া এবং ময়লা-আবর্জনা পোড়ানোকে বায়ু দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়। আর মাদারীপুর, পটুয়াখালী ও মেহেরপুরে বায়ু দূষণ কম হওয়ার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে প্রচুর গাছপালা ও প্রাকৃতিক জলাধারকে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে, এসব এলাকায় সংস্কার কাজের পরিমাণও কম বলে দূষণ কম।
৬৪ জেলার বাতাসের মান নিয়ে গত বছর করা ওই গবেষণা বলছে, গাজীপুর জেলার বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে ক্ষতিকর বস্তুকণা পিএম-২.৫-এর মাত্রা ছিল গড়ে ২৬৩.৫১ মাইক্রো গ্রাম। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ঢাকা জেলার (সিটি করপোরেশনের আওতাবহির্ভূত এলাকা) বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে এই ক্ষতিকর বস্তুকণার মাত্রা ছিল ২৫২.৯৩ মাইক্রো গ্রাম। পিএম-২.৫-এর মাত্রা বেশি নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে নারায়ণগঞ্জ; যেখানে পিএম-২.৫ মাত্রা ছিল ২২২.৪৫ মাইক্রো গ্রাম।
সংবাদ সম্মেলনে আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ক্যাপস ৬৪ জেলার বায়ুমান বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পর্যালোচনা করে। গবেষণা থেকে দেখা যায়, ২০২১ সালে দেশের ৬৪ জেলার সর্বমোট ৩ হাজার ১৬৩টি স্থানের গড় হিসেবে অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ১০২.৪১ মাইক্রোগ্রাম, যা দৈনিক আদর্শ মানের (৬৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় ১.৫৭ গুণ বেশি। আর গাজীপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে বায়ুমান ছিল বাংলাদেশের আদর্শমানের চেয়ে ৪-৫ গুণ বেশি।
সংবাদ সম্মেলনে গবেষণার ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়, সবচেয়ে কম দূষিত শহরের মধ্যে রয়েছে মাদারীপুর। এ জেলার বাতাসে পিএম-২.৫-এর মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৪৯.০৮ মাইক্রোগ্রাম। মাদারীপুরের পরের অবস্থানে রয়েছে পটুয়াখালী ও মেহেরপুর।
সংবাদ সম্মেলনে আরও বলা হয়, ৬৪টি জেলার মধ্যে শুধুমাত্র ১০টি জায়গায় বায়ুর মান ভালো পাওয়া যায় (প্রতি ঘনমিটারে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম নিচে)। সে জায়গাগুলো হলো- কুড়িগ্রাম (৬৩.৩৩ মাইক্রোগ্রাম), নাটোর (৬৩.১৯ মাইক্রোগ্রাম), জয়পুরহাট (৫৮.২৪ মাইক্রোগ্রাম), রাজবাড়ী (৫৮.২২ মাইক্রোগ্রাম), রাজশাহী (৫৬.৪১ মাইক্রোগ্রাম), পাবনা (৫৬.২২ মাইক্রোগ্রাম), সিরাজগঞ্জ (৫৫.২ মাইক্রোগ্রাম), মেহেরপুর (৫৩.৩৭ মাইক্রোগ্রাম), পটুয়াখালী (৫১.৪২ মাইক্রোগ্রাম) ও মাদারীপুর (৪৯.৩৮ মাইক্রোগ্রাম)।
বায়ুদূষণ রোধে তিনটি মেয়াদে ১৫ দফা সুপারিশ জানানো হয় সংবাদ সম্মেলন থেকে। সুপারিশগুলো হচ্ছে-
ক. স্বল্পমেয়াদী পদক্ষেপ: শুষ্ক মৌসুমে সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, ওয়াসা এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয়ে দূষিত শহরগুলোতে প্রতি দিন ২-৩ ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা; নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঘেরাও দিয়ে রাখা ও নির্মাণ সামগ্রী পরিবহণের সময় ঢেকে নেওয়া; রাস্তায় ধূলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাকের ব্যবহার করা; অবৈধ ইটভাটাগুলো বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, বিকল্প ইটের প্রচলন বাড়ানো এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা।
খ. মধ্যমেয়াদি পদক্ষেপ: সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে প্রচুর পরিমাণ গাছ লাগানো ও ছাদ বাগান করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করা, আলাদা সাইকেল লেনের ব্যবস্থা করা; দূষিত শহরগুলোর আশপাশে জলাধার সংরক্ষণ করা; আগুনে পোড়ানো ইটের বিকল্প হিসাবে স্যান্ড ব্লকের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ানো এবং সিটি গভর্নেন্সের প্রচলনের মাধ্যমে উন্নয়নমূলক কার্যকলাপের সমন্বয় সাধন করা।
গ. দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ: নির্মল বায়ু আইন-২০১৯ বাস্তবায়ন করা, পরিবেশ সংরক্ষণ ও সচেতনতা তৈরির জন্য পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক বাজেট বরাদ্দ বাড়ানো ও বায়ু দূষণের পূর্বাভাস দেওয়ার প্রচলন করা, গণপরিবহণসহ ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা, সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন মাধ্যমে বায়ু দূষণ সম্পর্কে আরও বেশি তথ্যনির্ভর অনুষ্ঠান প্রচারের ব্যবস্থা করা, পরিবেশ ক্যাডার সার্ভিস এবং পরিবেশ আদালত চালু ও কার্যকর করা।
সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকি, পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক কাজী সারওয়ার ইমতিয়াজ হাশমি, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল প্রমুখ।