তামিম স্মরণীয় হয়ে আছেন যেসব কারণে
ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১০টা বেজে ৩৯ মিনিট। ২৩৮ শব্দের এক বার্তা। যেখানে বলা, লাল-সবুজের জার্সিতে আর দেখা যাবে না ওপেনার তামিম ইকবালকে। সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া তামিমের এমন বিদায়ী বার্তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। ১৭ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে তার অর্জন নেহায়েত কম নয়। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক যেসব কারণে দেশের ক্রিকেটে স্মরণীয় হয়ে আছেন তামিম।
২০০৭ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক। একই বছরের সেপ্টেম্বরে টি-টোয়েন্টি ক্যাপ আর পরের বছর জানুয়ারিতে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে রাজকীয় ফরম্যাট টেস্টে অভিষেক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিরতিহীন ভাবে খেলে গেছেন ১৭ বছর। দীর্ঘ এই ক্যারিয়ারে ৭০ টেস্ট, ২৪৩ ওয়ানডে ও ৭৮টি টি-টোয়েন্টি খেলে করেছেন ১৫ হাজার ২৪৯ আন্তর্জাতিক রান। সেঞ্চুরি ২৫টি ও হাফ সেঞ্চুরি ৯৪টি।
তামিমমের উল্লেখযোগ্য কিছু অর্জন ও কীর্তি :
১. ভাঙা হাতে ব্যাটিং বীরত্ব
সময়টা ২০১৮, নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে ব্যাটিং করতে নেমে ইনিংসের শুরুতে হাতে চোট পান তামিম। সেই চোট এতটাই গুরুতর ছিল যে, মাঠ ছেড়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল তামিমকে। পরবর্তীতে মাঠে ফিরলেও তামিমের সেই ব্যান্ডেজ দেখে হৃদয় ভাঙে দর্শকদের। ভাঙা হাত নিয়ে কীভাবে মাঠে নামবেন তিনি? কিন্তু সবাইকে অবাক করে মাঠে নামলেন তামিম। ভাঙা হাত। কব্জিতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। এমন পরিস্থিতিতে এক হাত দিয়ে মোকাবেলা করেন লঙ্কান বোলারদের। তামিমের এমন দেশপ্রেম, আত্ননিবেদন বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে নতুন এক বীরত্বগাঁথার জন্ম দেয়।
২.লর্ডসে ঐতিহাসিক সেঞ্চুরি
লর্ডসে সেঞ্চুরি আছে অনেক রথী-মহারথীদের। তামিম ইকবাল তাদেরই একজন। ২০১০ সালে লর্ডসে খেলা টেস্টটিতে ক্যারিয়ারের অন্যতম স্মরণীয় এক ইনিংস খেলেছিলেন তামিম ইকবাল। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই টেস্টের প্রথম ইনিংসে ৫৫ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেছিলেন সেঞ্চুরি। ম্যাচ হারলেও সেঞ্চুরির সুবাদে অন্য রকম এক আনন্দে ভেসেছিলেন তামিম। লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম উঠে তার। যেখানে নাম তুলতে পারেননি কিংবদন্তি শচীন টেন্ডুলকারও। তামিমের এই ইনিংস বদলে দেয় বাংলাদেশের চিত্র। দেশীয় গণমাধ্যম তো বটেই, বড় বড় ইংলিশ পত্রিকাগুলোও মুখরিত ছিলো তামিম বন্দনায়।
৩.এক, দুই, তিন, চার
২০১২ এশিয়া কাপটা বাংলাদেশের জন্য বেদনাদায়ক। দেশের মাটিতে ফাইনাল খেলেও পাকিস্তানের কাছে হেরে স্বপ্নভঙ্গ হয় মুশফিকদের। সেই এশিয়া কাপের প্রাথমিক দলে ছিলেন না তামিম। যা হয়ে উঠল 'টক অব দ্যা টাউন'। সর্তীথদের অনুরোধে পরবর্তীতে দলে ফেরানো হয় তামিমকে। এরপর যা ঘটল, তা তো এক ইতিহাস। টানা চার ম্যাচে ফিফটি করে ঐ আসরে বাংলাদেশকে সাফল্যের ভেলায় ভাসিয়েছিলেন তামিম। হাত উচিয়ে তামিমের সেই উদযাপন আজও স্মরণীয় হয়ে আছে।
৪. ভারতের বিপক্ষে আগমনী বার্তা
ওয়ানডেতে অভিষেকের বছরেই বিশ্বকাপ স্কোয়াডে সুযোগ পেয়ে যান তামিম। ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বের ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে নিজের জাত চেনান চট্টগ্রামের এই ক্রিকেটার। জহির খান, অজিত আগারকার, মুনাফ প্যাটেলদের শাসন করেন ব্যাটের ঝলকানিতে। বিশেষ করে জহির খানের বলে ক্রিজ থেকে বেরিয়ে এসে মারা ওভার বাউন্ডারি এখনো জ্বলজ্বল করছে ক্রিকেটপ্রেমীদের চোখে। তামিমের অনবদ্য অর্ধশতকের দিনে ভারত বিদায় নেয় গ্রুপ পর্ব থেকেই। ভারতের বোলিং আক্রমণ ছন্নছাড়া করে তুলে ৫৩ বলে ৭ চার ও ২ ছক্কায় করেন ৫১ রান।
৫.ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া বধে ব্যাটিং নৈপুন্য
টেস্টে বাংলাদেশের পরিসংখ্যান খুব একটা সুখকর নয়। সেই হিসেবে ২০১৬-২০১৭ সালটা বেশ স্মরণীয়। মিরপুরে হোম অফ ক্রিকেটে, বিশ্ব ক্রিকেটের দুই পরাশক্তি ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়ের স্বাদ পায় বাংলাদেশ। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেঞ্চুরি ও অস্ট্রেলিয়া বিপক্ষে দুই ইনিংসেই তামিম করেন ফিফটি। স্পিন সহায়ক উইকেটে যেখানে ব্যাটারদের জন্য টিকে থাকা ছিল চ্যালেঞ্জ, সেখানে তামিমের এমন ইনিংস নিঃসন্দেহে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
রেকর্ড আর পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে একটা বিষয় স্পষ্ট, তামিম দেশের অন্যতম সেরা ব্যাটার এবং সর্বকালের সেরা ওপেনার। তার মতো একজনের হঠাৎ এমন বিদায়, মেনে নিতে পারছেন না সমর্থকরা। তার এই বিদায়েই শেষ হলো ১৭ বছরের বর্ণাঢ্য এক ক্যারিয়ারের, শেষ হলো বাংলাদেশের ক্রিকেটের এক সোনালি অধ্যায়েরও।