বেড়ায় ঝুঁকিতে প্রতিরক্ষা বাঁধ
পাবনার বেড়া উপজেলায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে যমুনা নদীর স্থায়ী ভাঙনরোধ প্রতিরক্ষা বাঁধের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৮ সালে ওই বাঁধের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছিল।
সরেজমিনে দেখা যায়, বেড়ার মোহনগঞ্জ এলাকায় তিনটি পয়েন্টে নদীভাঙন প্রতিরক্ষা বাঁধে দুই থেকে তিন ফুট করে দেবে গেছে। সিসি ব্লক আলগা হয়ে পড়েছে। মোহনগঞ্জের ভাটিতে মালদাহপাড়ায় দুটি পয়েন্টে ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের টপের পাঁচ থেকে ছয় ফুট দেবে গেছে। সামান্য দূরে বাঁধের উপরিভাগ থেকে ঢালের নিচ পর্যন্ত প্রায় ৫০ ফুট এলাকাজুড়ে চুরি হয়ে গেছে ব্লক। এতে মাটি বেরিয়ে পড়েছে। এ ছাড়া প্রতিরক্ষা বাঁধের নিচে নদীতে ফেলা ব্লক অনেক জায়গা থেকে চুরি হয়ে গেছে।
এদিকে, মোহনগঞ্জ ও মালদাহপাড়ায় প্রতিরক্ষা বাঁধের সঙ্গে লাগানো দুটি ইটভাটায় ব্যবহৃত ট্রাক চলাচল করে। ট্রাক চলাচলের সময় ঝাঁকুনিতে প্রতিরক্ষা বাঁধের সিসি ব্লক ধসে পড়ছে।
এ ছাড়া মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা বাঁধের কোল ঘেঁষে বিভিন্ন পয়েন্টে ১৫টি বোমা মেশিনের (দেশি প্রযুক্তিতে তৈরি ড্রেজার) সাহায্যে যমুনা নদী থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। নদীর যে স্থান থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে, তার চারপাশের এলাকার বাঁধ ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদীর স্রোতের মূল ধারাটি সরাসরি মোহনগঞ্জ ও মালদাহপাড়ায় আঘাত করে। আগামী বর্ষা মৌসুমের আগে প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত পয়েন্টগুলো সংস্কার না করা হলে স্রোতের টানে ও ঢেউয়ের আঘাতে বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন।
এলাকাবাসী জানান, ১৯৯৭ সালে বেড়া মোহনগঞ্জ থেকে কাজীরহাট পর্যন্ত ২৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে যমুনা নদীতে ভয়াবহ ভাঙন শুরু হয়। হাজার হাজার বসতভিটা, ফসলি জমি, হাটবাজার, স্কুল-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির নদীতে বিলীন হয়ে যায়। ওই বছরের ২৭ এপ্রিল নাকালিয়ায় পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে প্রকল্পের ভেতরে পানি ঢুকে যায়। স্রোতের টানে প্রকল্প অভ্যন্তরে দুই যুগ ধরে গড়ে ওঠা গ্রামীণ অবকাঠামো, আটটি ব্রিজ-কালভার্ট, কাঁচা-পাকা সড়কসহ প্রায় পাঁচ হাজার একর জমির উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি টাকা বলে উল্লেখ করা হয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের করা ২০০০ সালে এক জরিপ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাবনার বেড়ায় গত ৪০ বছরের অব্যাহত নদীভাঙনে যমুনা ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে সরে আসে। এ সময়ে যমুনার ভাঙনে ৭২টি গ্রাম, ১০ হাজার একর ফসলি জমি, ১২টি হাটবাজার, ৩৫টি স্কুল-মাদ্রাসা, ১৫টি মসজিদ-মন্দির, অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ নদীতে বিলীন হয়ে যায়।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, নদীভাঙনে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়। এর মধ্যে প্রায় ১০ হাজার মানুষ অন্য এলাকায় বাড়ি করেছে, সহায়-সম্বল হারিয়ে ১৫ হাজার মানুষ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নেয়। নদীভাঙনে ভূমিহীন হয়ে পাঁচ হাজার মানুষ শহরে বস্তিবাসী হয়। ওই প্রতিবেদনে যমুনা নদী স্থায়ী ভাঙন রোধের সুপারিশ করা হয়। এই সুপারিশের আলোকে তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার বেড়ার মোহনগঞ্জ থেকে কৈটোলা পর্যন্ত প্রায় ১৩ কিলোমিটার যমুনা নদীর পশ্চিম তীর স্থায়ী ভাঙন রোধ প্রকল্প হাতে নেয়।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ২০০৪ সালে ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে যমুনা-মেঘনা রিভার ইরোশন মিটিগেশন প্রকল্পের আওতায় বাঁধ তৈরির কাজ শুরু হয়। যমুনা নদীর সবচেয়ে বেশি ভাঙনপ্রবণ পাবনার বেড়া উপজেলার মোহনগঞ্জ থেকে রাকশা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার স্থায়ী ভাঙন রোধ প্রকল্পের কাজ ২০০৪ সালে শুরু হয়ে ২০০৮ সালে শেষ হয়।
যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে (ডান তীর) প্রায় ১৩ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধ তৈরি করা হয়। প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণের ফলে মোহনগঞ্জ থেকে রাকশা পর্যন্ত যমুনা নদীর ভাঙন বন্ধ হয়ে যায়। নদীর পশ্চিম পাড়ে চর জেগে উঠতে থাকে। এই কাজে প্রচলিত পদ্ধতি অনুসরণ না করে গ্লোবাল পজিশনিং পদ্ধতি (জিপিএস) প্রয়োগ করা হয়।
সফলভাবে জিপিএস পদ্ধতি প্রয়োগ করে স্থায়ী ভাঙনরোধ প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ করায় গত ১০ বছর বেড়াবাসী যমুনা নদীভাঙনের তাণ্ডবলীলা থেকে রক্ষা পেয়েছে। এর ফলে প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাবনা সেচ ও পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, কৈটোলা পাম্পিং স্টেশনসহ ৩০টি গ্রাম ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা পেয়েছে। এতে যমুনা নদীতীরবর্তী এলাকাবাসীর মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। কিন্তু প্রতিরক্ষা বাঁধ সংস্কার না করা, সিসি ব্লক চুরিসহ যমুনা নদীর পাড় ঘেঁষে অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলনের ফলে যমুনা নদীতীরবর্তী পাঁচটি গ্রামে আবারও ভাঙন দেখা দিয়েছে।
পানি উন্নয়ন বিভাগের কৈটোলা নির্মাণ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানান, প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। আগামী অর্থবছরে টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেলে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে সংস্কারকাজ করা হবে। এলাকার মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি ছাড়া ব্লক-জিও ব্যাগ চুরি ও প্রতিরক্ষা বাঁধের ক্ষতিসাধন ঠেকানো সম্ভব নয় বলে তিনি জানান।