প্রথম কিস্তি
ঔপনিবেশিক বুকাননের চোখে চট্টগ্রাম
পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে সম্ভবত সবচেয়ে পুরোনো বিবরণ মিলবে ফ্রান্সিস বুকাননের দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ফ্রান্সিস বুকাননের সফরের অভিজ্ঞতায়। ১৭৯৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির তরফ থেকে একটা দায়িত্ব নিয়ে এই অঞ্চলে আসেন তিনি, ডুলি বা পালকি, ঘোড়া, নৌকা আর পদব্রজে ২ মার্চ থেকে যাত্রা শুরু করে ওই বছরেরই ২০ মে পর্যন্ত এলাকাটিতে তাঁর সফরের বর্ণনা। বিবরণ শুরু করেছেন লক্ষ্মীপুর থেকে ফেনি, নোয়াখালী, মিরশ্বরাই, সীতাকুণ্ডু, রামু, চকরিয়া, বাজালিয়া, শুলক, বরকল- এসব নাম দেখি তাঁর বিবরণে।
প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আদিবাসী জাতিসমূহের সংস্কৃতি, অর্থনীতি ও জীবনযাত্রা তিনি পর্যবেক্ষণ করেন, সাক্ষাৎ পান মারমা ও চাকমা সর্দারদ্বয়েরও। সীমান্ত ভূভাগটি তখন একটা উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তার একটা ছাপ এই সফর-কাহিনীর মধ্যেও আছে। এই সফরের মাত্র ১৪ বছর আগে সম্প্রতি পরাক্রমশালী হয়ে ওঠা বার্মার রাজা দখল করে নিয়েছেন আরাকান রাজ্যটি। সেখান থেকে দলে দলে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসছেন মার্মা ও রাখাইন জনগোষ্ঠী, পেছনে রেখে এসেছেন মর্মান্তিক দমনের অভিজ্ঞতা, দেবমূর্তিসমেত মন্দিরগুলো লুণ্ঠিত হয়েছে, ব্যক্তিগত সহায় সম্পদও দখলদারদের হাতে। ধরা পড়া অভিজাতরা প্রায় সবাই ফাঁসিতে ঝুলেছেন। রামুর আবহাওয়ায় প্রবল পেটের পীড়ায় আক্রন্ত একজন গণ্যমান্য আরাকানী নিজ লোকজনসহ ফেরত যান, অচিরেই তাঁরও প্রাণদণ্ডের খবর আসে। ফলে বিপুল মানুষ সেখান থেকে উদ্বাস্তু হয়ে এসেছে, পাহাড় ও সমতল ভূমিগুলোতে আবাদ ও বসতি গড়েছে। সেখান থেকে পালিয়ে এসেছে বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীও, সম্ভবত বাংলাদেশে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর আগমনেরও সেই প্রথম উল্লেখ। তবে বুকানন যেমন বলেছেন, আরাকানে মুসলমানরা বৃহদাংশে ছিল প্রধানত কৃষিশ্রমিক, জমির মালিক প্রধানত ছিল মার্মা জনগোষ্ঠী। উদ্বাস্তু হয়ে যখন এলো, বহুক্ষেত্রে মালিক আর ভৃত্যের ভূমিকা বদলে গেল, স্থানীয় বাংলাভাষিদের কল্যাণে মুসলমানরা সুবিধাজনক কাজকর্ম করে জীবিকার সন্ধান পেল।
বুকানন উল্লেখ করেছেন, সাবেক মনিব ঘর ছাইয়ে দিচ্ছে সাবেক ভৃত্যের। তবে এখানে আসা মুসলিম জনগোষ্ঠী প্রধানত বসতি করেছিল উপকূলের সমতল অঞ্চলগুলোতে অথবা পাহাড়ের পাদদেশের সমভূমিগুলোতে। মার্মাসহ অন্য জনগোষ্ঠীগুলো পাহাড়ের ওপর, রাখাইনরা উপকূলে। সীমান্তে তখনো হুমকি দিচ্ছে বার্মার সেনাবাহিনী, মাত্র চার বছর আগে তাদের একটা বড় বাহিনী কামান-বন্দুক নিয়ে নাফ নদের সীমানা পাড়ি দিয়ে কয়েকদিন ছাউনিও পেতেছিল, মূলত পরাজিত ও পালিয়ে আসা মানুষগুলোর মাঝে ভীতি ছড়ানো এবং ব্রিটিশদের শক্তির মাপজোক আর মতিগতি বুঝে নেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল। এর আগেই তারা আগ্রাসন চালিয়েছে আসামে, লুট করেছে মনিপুর, হাতিঘোড়া গবাদিপশু সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া মনিপুরের রাজার তীর্থযাত্রার খরচ জুগিয়েছে বৈবাহিক সূত্রে তাঁর আত্মীয় ত্রিপুরার রাজা।
বার্মার রাজা শামদেশেও অভিযান চালিয়েছে, চিয়াংমাই দখলের চেষ্টায়। এমন প্রবল আগ্রাসী শক্তির হামলার আশঙ্কায় নাফ নদের তীরের অনেক জনপদ তখন বলা যায় প্রায় বিরান হয়ে গেছে, সেখানে পাহারা জোরদার করার কথা বুকানন সুপারিশ করছেন— মোটামুটি এই হলো ফ্রান্সিস বুকাননের ভ্রমণের সময়ে অঞ্চলটির ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি।
২.
বলা যায়, আরাকানের ওপর বার্মার এই দখলদারত্বের সূত্রে শরণার্থী মানুষগুলোর উপস্থিতির ফলে দক্ষিণপূর্ব এই অঞ্চলটিতে প্রাচীন অরণ্যে নতুন করে মানুষের হস্তক্ষেপের, কর্মচাঞ্চল্য বৃদ্ধির একটা চিত্র আমরা এখানে পাই। তবে বার্মার এই হস্তক্ষেপজনিত অভিবাসনের আগেই এখানকার পাহাড়গুলোতে আদিবাসী জাতিগুলোর দীর্ঘকালীন বসতি ছিল, ছিল উপকূলেও, তারও উল্লেখ আছে এখানে। এমনকি বুকাননের ফেনি, কুমিল্লা আর মিরশ্বরাই এলাকার বর্ণনাতেও দেখা যাবে বাঙালি কৃষকদের তুলনায় ত্রিপুরা এবং আরো তিনটি জাতির আধিক্য। মাছ ধরা আর নৌচালনায় পারদর্শী রাখাইনদের বসতিও সমুদ্র উপকূলে বার্মার আগ্রাসনের আগে থেকেই ছিল। তবে পাহাড়গুলোতে কৃষিব্যবস্থা প্রধানত জুম চাষ আর তাঁতশিল্পের ওপর নির্ভর হওয়ার কারণে জনসংখ্যা কখনোই খুব বেশি বাড়েনি। এ ছাড়া পানির অভাব বহু পাহাড়ে জনবসতিকে অসম্ভব করেছিল, লবণ আর অন্যান্য অত্যাবশ্যক পণ্যবিরল অঞ্চলগুলোকে তাই বুকাননও জনবিরল বলেই জেনেছিলেন। পাহাড়গুলোর জনসংখ্যা তাই বুকাননের সফরের বহুকাল পরও সীমিতই ছিল।
কিন্তু আরাকান থেকে অভিবাসনের চেয়েও বড় জোয়ার আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কল্যাণে। ব্রিটিশ বন্দোবস্তে অরণ্য সাফ করে জমি পত্তনি, ভূমি বন্দোবস্ত এবং ব্যবসা বাণিজ্য ও কৃষির একটা বিস্তার ঘটে। ব্রিটিশ উপস্থিতি এবং বার্মা থেকে আসা মানুষদের কারণে জনসংখ্যার একটা বৃদ্ধির পরও কিন্তু এই পার্বত্য-প্রকৃতি তার রহস্যঘেরা গাম্ভীর্য নিয়ে অটুট দাঁড়িয়ে ছিল। বরং সেই তুলনায় নোয়াখালি, কুমিল্লা আর রামুর উপকূলে কৃষি, মাছ, নৌবাণিজ্য আর তাঁত শিল্পের বিকাশের কিছুটা বর্ণনা মিলবে। বাড়তি অর্থনৈতিক শক্তি, শস্যের বাড়তি উৎপাদন বৃহত্তর জনসংখ্যাকে পরিপোষণ করতে সক্ষম হওয়ায় উপকূলভাগের জনসংখ্যা পরবর্তী দুই শত বছরে পাহাড়ের তুলনায় অনেকটাই বৃদ্ধি পায়।
বুকাননের এই গ্রন্থটি যেমন তার ঐতিহাসিক আর রাজনৈতিক মূল্যায়নের জন্য, এই এলাকার জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা বোঝার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসূত্র, তেমনিই তা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলটির ভূ-প্রকৃতি আর বাস্তুসংস্থান বোঝার জন্যও। জুম চাষ আর সমতলে ধানের আবাদের কথা তিনি বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন, বলেছেন হাড্ডিসার গরু, ‘অলস’ কৃষকের কথা। তাঁর দেখা প্রায় সব ফসলের বর্ণনা বুকানন দিয়েছেন, বাঙালি-আদিবাসী রেষারেষির কিছু বিবরণ সেখানে আছে, আছে চালাক আর ক্ষমতাঘনিষ্ঠ বাঙালির প্রতি ঠকে যাওয়া সরল মানুষগুলোর অনুভূতির কিছু উল্লেখ, তেমনি তিনি জানিয়েছেন পশু-মাছ-পানির প্রাপ্যতার কথা, স্থানীয় উদ্ভিদের বিবরণও তার বর্ণনায় ভরপুর। নিজে পেশায় চিকিৎসক হলেও উদ্ভিদ বিজ্ঞানে তাঁর বুৎপত্তি ছিল গভীর, পাহাড়ের অন্যতম অর্থকরী উদ্ভিদ গর্জন যে শ্রেণিবিন্যাসকৃত হয়নি, তাও তিনি জানতেন। স্টকল্যান্ড জাত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই জরিপকারী কৌতুকের চোখে লক্ষ করেছেন, পাহাড়ে পানির উত্তম উৎস ঝরনা বা ছড়া থাকতেও বাঙালি বসতকারীরা সেখানে গিয়ে পুকুর কাটছেন, শেষমেশ বদ্ধ অস্বাস্থ্যকর পানি পান করে সংক্রমিত হচ্ছেন নানান পীড়ায়। বাংলাদেশের প্রতিবেশগত ইতিহাস লিখতে গেলে তাই বুকাননের এই বিবরণের কাছে ফিরে যেতেই হবে।
কিন্তু এই ভূপ্রকৃতি অচিরেই বিরান হয়ে যেতে পারত বুকাননের এই সফরেরই কল্যাণে। কেননা, কেবল নিছক পর্যটকই বুকানন ছিলেন না, তাঁর সফরের ভিন্ন একটা উদ্দেশ্যও ছিল।
৩.
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বুকাননকে দায়িত্ব দিয়েছিল এই অঞ্চলে মশলা আবাদের সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য। আধুনিককালে শীতলায়ন যন্ত্রের আবিষ্কার এবং তারও আগে পশুখাদ্যের বৈজ্ঞানিক চাষবাসের কল্যাণে মশলার সেই রমরমা বাণিজ্য বহুকাল আর নাই, কিন্তু এই তিনশ বছর আগেও শীতকালে পশুকে খাওয়াবার মতো কিছু না থাকায় ইউরোপে গরমকাল থাকতে থাকতেই গবাদিপশু জবাই করে ফেলা ছাড়া গত্যন্তর ছিল না এবং এই বিপুল মাংসকে একদিকে সংরক্ষণের জন্য, অন্যদিকে শুঁটকিকৃত মাংসের রান্নায় গন্ধ আড়াল করার জন্য ইউরোপজুড়ে মশলার চাহিদা ছিল প্রচুর। মশলার প্রধান উৎস ইন্দোনেশিয়া-মালয়েশিয়া অঞ্চলে ইংল্যান্ডের তখনো প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখনো বাংলায় তাঁর সদ্য দখল করা দেওয়ানির হিসাব-নিকাষ নিয়ে ব্যস্ত, রাজস্ব বাড়াবার জন্য নতুন নতুন খাত তারা খুঁজছে, মাত্র কয়েক বছর হলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ইজারা দেওয়া হয়েছে বাংলার সিংহভাগ ভূমি, চেষ্টা চলছে আরো নতুন নতুন কী কী রাজস্ব খাত পাওয়া যায়। বুকাননকে তাই বলা হয়েছে বাংলার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অনুসন্ধানে যেতে, যদি মশলা চাষের উপযুক্ত ভূমির খোঁজ মেলে।
ফলে পুরো বইয়েই সতর্ক পাঠক একজন জরিপকারীর নজর দেখতে পাবেন। যেকোনো পাহাড় দেখামাত্র বুকাননের প্রথম চিন্তা এই পাহাড়ে কি মশলার আবাদ সম্ভব! অঞ্চলটিকে তার নিজস্বতা দিয়ে নয়, বুকানন বিচার করছেন মশলার বা এই জাতীয় বাণিজ্যিক উদ্ভিদ আবাদে তাঁর সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যতা দিয়ে। তাই কোন পাহাড়ের মাটির গড়ন কেমন, বাতাস কোন দিক দিয়ে আসে, বৃষ্টির তীব্রতা হাত থেকে পাহাড়ের কোনদিকের ঢালে গাছগুলোকে লাগানো যেতে পারে অথবা কোথায় মাটি উর্বর হলেও পানির উৎস দূরে, সেখানে কিসের আবাদ হতে পারে – বণিকের এই মন নিয়েই বুকানন তাঁর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলার ভ্রমণ কাহিনীটি লিখেছেন, প্রতিটি পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছেন কৃষিবিদের চোখ দিয়ে।
৪.
শুধু মশলাই নয়, জরিপকারীর পেশাদার চোখ দিয়েই বুকানন দেখেছেন পাহাড়ে আর সব আবাদেরও সম্ভাবনা। কৃষি আর বসতির বিস্তারের সুপারিশ তাই তার বিবরণীতে পাতার পর পাতায় বারংবার এসেছে। ৫-৮ মে তারিখে চট্টগ্রামের পাহাড়গুলোর বর্ণনায় বলা হচ্ছে ‘দারুচিনির আবাদের উপযুক্ত পরিস্থিতি এখানে আছে বলে আমার ধারণা, কেননা ঝরনাসমৃদ্ধ বালুময় মাটি এই বৃক্ষটির চাষের জন্য অনুকূল বলে বলা হয়।’
মে ৪ তারিখে রাঙ্গুনিয়ার জুম চাষ দেখে তাঁর মনে হচ্ছে : ‘বিভিন্ন সময়ে এগুলোতে জুম চাষ হয়েছে, ফলে মাটি নিশ্চিতভাবেই উৎকৃষ্ট। দেখে তো মশলা আবাদের চেষ্টা করার জন্য দারুণ উপযুক্ত বলেই মনে হয়। ‘এখানেই তিনি একটা নদীর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন, যেটি ছিল কুমীরে পূর্ণ!
ঊনিশ শতকের উন্নয়নের ধারণাটার দেখা মিলবে ১৫ এপ্রিলের ভুক্তিটিতে :
“পাহাড়ের বড় অংশটিই ঢেকে আছে অপ্রয়োজনীয় ঝোপঝাড়ে; অবশ্য অনেকগুলোকে পরিষ্কার করে কাঁঠাল আর আমের গাছ লাগানো হয়েছে, সেগুলো বেড়েও উঠছে ভালোভাবেই... কোনোই সন্দেহ নেই যে এসব পাহাড় পরিষ্কার করে ফেললে অঞ্চলটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠবে, আর আমার মনে হয় এটা বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, অর্থনৈতিক দিক দিয়েও এটা ভালো সমাধান হবে। এই পাহাড়গুলোর বড় অংশে বর্ষাকালে খুব ভালো গোখাদ্য উৎপাদন করা সম্ভব, আর বিবিধ উপকারী সবজির আবাদও করা যেতে পারে। কোন কোন জায়গায় গর্জন, জারুল আর অন্যান্য কাঠের গাছ লাগানো যেতে পারে, কিন্তু সব ছোটখাট ঝোপঝাড়, যেগুলোতে আশ্রয় পায় ক্ষতিকর প্রাণী, আর স্বাস্থ্যের জন্য যারা ক্ষতিকর বাষ্পনিশ্বাস নির্গত করে, সেগুলোকে সাবধানে অপসারণ করতে হবে। আমার সামান্যই সন্দেহ আছে যে ট্রিফোলিয়াম এম ইনডিকা এই পাহাড়গুলোতে সুপ্রচুর ফলবে, আর ভালো একটা গোখাদ্যের ফলনও মিলবে।’
অর্থাৎ শুধু পাহাড়গুলো চাষের আওতায় আনলেই চলবে না, সব ঝোপঝাড়ও কেটে ফেলতে হবে। কেননা সেখানে স্থান নেয় নানান বুনো জানোয়ার। সেগুলো ফসলে ভাগ বসায়, কিংবা মাংসাশী হলে মানুষ আর গবাদি পশুর ওপরই হামলা চালায়। পাহাড়ে কোনো বুনো প্রাণীর প্রাকৃতিক আশ্রয় থাকা চলবে না।
রামুর উপকূলে বুকানন দেখেছেন “সুন্দুর (সুন্দরী), রুনা এবং অন্যান্য সুন্দরবন্দ (সুন্দরবনীয়) উদ্ভিদের প্রাচুর্য। যদিও জোয়ারের পানি আসা খাঁড়িগুলোর মুখ বন্ধ করে দেওয়াতে এই সামুদ্রিক উৎপন্নগুলো দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এমনকি যেখানে ধানের আবাদ করার জন্য সেগুলো কেটে সাফ করা হয়নি, সেখানেও তারা মরে যাচ্ছে। তারপরও এখনো অনেক চমৎকার সব ভূমি সাফ করা বাকি আছে...”
আবারও ‘(এডগং এ)পাহাড়ের মাটি খুবই অনুর্বর, কিন্তু চমৎকার সব বৃক্ষে ভরা। বেশ কটি ছোট ছোট নির্মল পানির ঝরনা পশ্চিমদিকে গিয়েছে, আর ধলির ছড়া আর খালী ছড়া নামে দুটো ঝরনার তীরে কিছু সমতল ভূমি আছে যেগুলো এখনো সাফ না করা হলেও আবাদের আওতায় আনা সম্ভব।’
পাহাড়র মতোই সেই একই ভাবনার নমুনাই আমরা দেখলাম উপকূলীয় অরণ্যের বেলাতেও। এমনিতেও তারা মারা পড়ছে খাড়ি দিয়ে জোয়ারের লোনা জল বন্ধ করায়, কিন্তু যেটুকু বাকি আছে, সেগুলোও কেটে ফেলার তাগিদ দিচ্ছেন বুকানন।
উর্বর জমি আর লবণচাষ এবং মাছের জন্য তখনো খ্যাত মহেশখালীর কথাও বুকানন বলেছেন, দ্বীপটিতে নাকি এর মাত্র কয়েক বছর আগেও বুনো হাতির বিচরণ ছিল। শেষ হাতির পালটি বুকাননের উপস্থিত হওয়ার মাত্র কয়েকবছর আগেই ধৃত হয়, হাতির বাণিজ্যক মূল্য তখনো ভালোই ছিল বলে আমরা জানি। ফসলের অনিষ্টকারী হাতিরপাল থেকে দ্বীপটি মুক্ত হওয়ার অর্থনৈতিক সুফল নিয়ে বুকাননকে তাই কোনো মন্তব্য করতে হয়নি।
যে জমিগুলো খুব খাড়া, আবাদ কিংবা বসতি সম্ভব নয়, তা নিয়েও বুকাননের ভাবনা আছে, জুম চাষে পাহাড়ের ক্ষয় হয় না এই বোধ তাঁর মতো একজন বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষকের মনে দৃশ্যমান, কিন্তু বাণিজ্যের তাগিদ আরো বেশি। ১৯ এপ্রিল তারিখের বর্ণনায় আমরা দেখি :
‘পাহাড়গুলো যেখানে খুব খাড়া, সেখানে জুম চাষের দুটো সুবিধা আছে : জমি খোড়ার ঝামেলাটা এড়ানো যায়, আর মাটি উপড়াতে হয় না বলে, আর গাছের শেকড়গুলো দ্বারা মাটি সুরক্ষিত বলে বৃষ্টিতে তা ধুয়ে যায় না। কিন্তু জুমে জমির অপচয়ের কথা আর জুমচাষিদের অনিশ্চিত পরিস্থিতির বিপরীতে ভাবলে এই দুটি সুবিধা তুচ্ছ মনে হয়। স্বাভাবিক চাষের পক্ষে পাহাড়ের অবনতি খুব বেশি হলে, আমার মনেই করি সেগুলোকে গোচারণভূমি হিসেবে ব্যবহার করা উচিত।’
(আগামীকাল শেষ কিস্তি)
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন। রাজনৈতিক পরিষদের সদস্য, গণসংহতি আন্দোলন।