সাহিত্যে বাঙালির ঈদ
সর্বজনীন বর্ষবরণের পর ঈদ উৎসবই এখন বাংলাদেশের প্রধানতম সাংস্কৃতিক প্রথা। ঈদ বাঙালি মুসলমানের বড় উৎসব। নানা পেশার নানা বয়সী মানুষ ঈদের জন্য যেমন সারা বছর অপেক্ষা করে থাকেন, তেমনি ঈদ সামনে রেখেই তাঁদের নতুন কাজের পসরা সাজান। ঈদ সামনে রেখে চিত্রশিল্পী ছবি আঁকেন, শিল্পী বাঁধেন নতুন গান। অভিনেতা অভিনয় করে দর্শককে তাক লাগিয়ে দেন। নির্দেশক সর্বোচ্চ দিয়ে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র। ঔপন্যাসিক গল্প লিখে ফেলেন দেশের জাতীয় দৈনিকে ছাপাবেন বলে। টেলিভিশন ও রেডিওতে চলে সাত দিনব্যাপী ভিন্ন স্বাদের অনুষ্ঠানমালা। পণ্য উৎপাদনকারীরাও তাঁদের নতুন পণ্যের প্রমোশনাল চালান ঈদকে ঘিরে। ঈদে নিজের অবয়ব বা গৃহে বাঙালি প্রস্তুতি নেয় নিজেদের সাধ্যমতো।
ঈদ উৎসবের এই সাংস্কৃতিক জাগরণ একদিনে হয়নি। অষ্টম শতকে আরব ও তুরস্ক থেকে মুসলমান সুফি-দরবেশদের আগমন ঘটে এই বঙ্গে। তাঁদের মাধ্যমেই এতদাঞ্চলে রোজা, নামাজ ও ঈদের প্রচলন হয়। সেকালে ঈদ ছিল বহিরাগত ধর্মসাধক ও ব্যবসায়ীদের কৃত্য বা পার্বণ। কালক্রমে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শারদীয় দুর্গোৎসবের মতো ঈদ উৎসবকেও বড় জাতীয় উৎসবে পরিণত করেছে এখানকার মুসলমানরা। প্রায় সহস্র বছরের পথপরিক্রমায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণে এই দেশে ঈদ এখন বহুমাত্রিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক উপাচার। বর্ণিল আয়োজন ও নান্দনিক বোধে জীবনঘনিষ্ঠ এক মানবিক আচার-অনুষ্ঠান। ঈদের আবহে তাই ধর্মীয় আধ্যাত্মিক ভাবগাম্ভীর্যের পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে ইহজাগতিক নানা লোকাচার। আর এভাবেই বাঙালির ঈদ উৎসবের সংস্কৃতি জায়গা করে নিয়েছে শিল্প-সাহিত্যের নান্দনিকতায়ও।
পত্রিকাওয়ালারা ঢাউস সাইজের ম্যাগাজিন বের করেন ঈদেই। সেখানে দৈনন্দিন এমন কোনো বিষয় নেই, যা অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। আজকাল সাহিত্য বা শিল্পচর্চার প্রধানতম সময় ভাষার মাস ফেব্রুয়ারির বইমেলা আর ঈদ উৎসব। কবি বা লেখকরা কাব্য-গল্প-উপন্যাস বা রম্য সাহিত্যের নান্দনিকতায় মাতিয়ে তোলেন ঈদের আনন্দ।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/ তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে শোন আসমানি তাগিদ’ গানটি ঈদ উৎসবের প্রধান সংগীতের রূপ পরিগ্রহ করেছে। এই গানের সুর না বাজলে ঈদ আনন্দের যেন পূর্ণতা পায় না। এ ছাড়া নজরুল ‘ঈদের চাঁদ’, ‘কৃষকের ঈদ’ ও ‘ঈদ মোবারক’ শিরোনামে কবিতা রচনা করেছেন। তাঁর ঈদবিষয়ক ১৬টিরও অধিক কাব্যকর্মে মানবিক মূল্যবোধের চেতনা মূর্ত হয়ে উঠেছে সার্থকভাবে। ‘ঈদ মোবারক’ কবিতায় কবি লিখেছেন :
শত যোজনের কত মরুভূমি পারায়ে গো,
কত বালুচরে কত আঁখি-ধারা ঝরায়ে গো,
বরষের পরে আনিলে ঈদ!
হাজার বেদনা আর মানুষে মানুষে হিংসা-ভেদাভেদ পেরিয়ে আনন্দের অশ্রুসজল ঈদ এসেছে মানুষের দ্বারে, কবি যেন এমনটাই বলতে চেয়েছেন। গ্রামীণ প্রান্তিক মানুষের ঈদ নিয়ে কবি যথার্থ প্রশ্ন তুলেছেন, ‘কৃষকের ঈদ কবিতায়’ :
জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ
মুমূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?
সাহিত্যতাত্ত্বিকরা বলেন, বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা কবিতায় ঈদ নিয়ে লেখালেখির শুরু। সৈয়দ এমদাদ আলীর ‘ঈদ’ কবিতাটিকেই বলা হচ্ছে বাংলা ভাষায় রচিত প্রথম ঈদবিষয়ক কবিতা। ১৯০৩ সালে তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক ‘নবনূর’ পত্রিকার ঈদসংখ্যায় কবিতাটি ছাপা হয়। তিনি লিখেছিলেন :
ধর্ম ও কর্মরে জীবনের মাঝে
প্রতিষ্ঠিত করি আজ জীবনের আবহে হও অগ্রসর,
নাহি তাতে কোন লাজ।
এ ছাড়া কবি কায়কোবাদ ‘ঈদ আবাহন’, কবি ফররুখ আহমদ ‘ঈদগা হবে দুনিয়াটাই’, কবি সৈয়দ আলী আহসান ‘এক ঈদের দিন’ এবং সুফিয়া কামাল ‘ঈদের চাঁদ’ শিরোনামে কবিতা লিখেছেন। এসব কবিতায় ঈদ মানে খুশি, ঈদ মানে ভ্রাতৃত্ব, ঈদ মানে সকল মানুষের সম্মিলিত আনন্দকেই তুলে ধরবার প্রয়াসী হয়েছেন কবিরা।
‘আজ ঈদ। মদিনার ঘরে ঘরে আনন্দ। দলে দলে লোক ঈদগাহে চলেছে।’ ছেলেবেলায় এমন গল্প পড়তে পড়তেই বড় হয়েছি আমরা। শিশুসাহিত্যের সেই ঈদ আনন্দ আজ জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালির প্রধানতম উৎসবগুলো ধর্মভিত্তিক হলেও কবি-সাহিত্যিকরা এসব উৎসবকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার না করে সর্বমানুষের উৎসব হিসেবে ভাবতে চেয়েছেন। ঈদকে মানুষে মানুষে আনন্দের বৈচিত্র্য ও মিলনের প্রতীকরূপে কল্পনা করেছেন। ‘বিশ্বনবী’ গ্রন্থের রচয়িতা কবি গোলাম মোস্তফা ‘ঈদ উৎসব’ কবিতায় যেমনটা বলেছেন :
আজই সকল ধরা মাঝে বিরাট মানবতা/মানবতা মূরতি লোভিয়াছে হর্ষে। আজিকে প্রাণে প্রাণে যে ভাব জাগিয়েছে, রাখতে হবে সারা বর্ষে/এই ঈদ হোক আজ সফল ধন্য নিখিল মানবের মিলনের জন্য/শুভেচ্ছা জেগে থাক, অশুভ দূরে যাক/ খোদার শুভাশিস পর্শে।
মহানবীর (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছর থেকে ঈদ উৎসবের সূচনা হয়। ইসলাম-পূর্ববর্তী যুগে আরবের মক্কায় ‘উকাজ মেলা’ এবং মদিনায় ‘নিরোজ’ ও ‘মিহিরগান’ নামে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। সেসব অনুষ্ঠানের অশ্লীল আনন্দ উল্লাসের পরিবর্তে ধর্মচর্চার সঙ্গে নির্মল আনন্দের উপলক্ষ সৃষ্টি করতে রোজার শেষে ঈদুল ফিতর এবং জিলহজ মাসের ১০ তারিখে কোরবানির মহিমায় ঈদুল আজহা চালু করেন। প্রথম ঈদে রোজার ধৈর্য এবং দ্বিতীয় ঈদে ত্যাগের শিক্ষায় উজ্জীবিত হন মুসলিমরা।
মূলত মানুষে মানুষে হিংসা-দ্বেষ ও ভেদাভেদহীনতা ভুলে সহমর্মিতা, ভ্রাতৃত্ব, মমত্ব, প্রেম, ভালোবাসা জাগ্রত করাই ঈদ উৎসবের মূল লক্ষ্য। আর এ লক্ষ্য প্রাধান্য দিয়ে প্রায় শত বছর ধরে বাংলা সাহিত্যের কবি ও নিবন্ধকাররা ঈদ নিয়ে তাঁদের প্রিয় অনুভূতির উৎসারণ করে চলেছেন। আধুনিক কবিরাও ঈদের মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছেন। ঈদকে ঘিরে কাব্যচর্চা করতে গিয়ে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অভেদ মানুষের জয়গানেই মুখরিত হয়ে উঠেছেন কবিরা। ভালোবাসা আর সাম্যের পঙক্তি রচনাতেই তাঁরা সিদ্ধহস্ত থেকেছেন। এভাবেই বাংলা সাহিত্যে শত কবির কবিতায় বিষয় হিসেবে ঈদ উৎসব হয়ে উঠেছে মানুষের সমান অধিকারের আসল রূপকল্প।
আর ঈদ উৎসবের সেই সাম্যের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবি সুফিয়া কামাল যথার্থই বলেছেন :
কাল ঈদগাহে ধনী-দরিদ্র মিলবে যে বুকে বুকে
কাল ঈদগাহে ধনীর ধনের দীনও হবে ভাগীদার
পুরাতে হইব কত দিবসের খালি অঞ্জলি তার।