চরিত্রের একটা খিচুড়ি আমার মধ্যে আছে : সালমান
‘বডিগার্ড’ চলচ্চিত্রের টাইটেল ট্র্যাকের কথা মনে আছে? সেখানে একটা বাক্য ছিল এ রকম, ‘সাবকি আন সাবকি শান, সাবকা এক ভাইজান’। হ্যাঁ, বলছি বলিউডের সবার ভাইজান সালমান খানের কথা। বলিউডের খান রাজত্বের অন্যতম অংশীদার তিনিও। রোমান্টিক থেকে অ্যাকশন—সব ধরনের চরিত্রে মানিয়ে যান সাল্লু মিয়া। বজরঙ্গি ভাইজানের মতো আবেগপ্রবণ ছবি দিয়ে ভক্তদের চোখের পানি ফেলতেও তাঁর জুড়ি নেই। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে তাঁর এমনই একটি চলচ্চিত্র। ছবিটির নাম যে ‘টিউবলাইট’, তা ভক্তদের না বললেও চলবে। এই টিউবলাইটে তাঁর অভিনয়ের অভিজ্ঞতা নিয়েই ডিএনএ ইন্ডিয়ার মুখোমুখি হয়েছিলেন সালমান। এনটিভি অনলাইনের পাঠকের জন্য থাকছে তারই অনুবাদ।
প্রশ্ন : ‘বজরঙ্গি ভাইজান’ থেকে ‘টিউবলাইট’, একজন পরিচালক হিসেবে কবির খানের মধ্যে আপনি কী পরিবর্তন দেখতে পেয়েছেন?
উত্তর : কাবুল এক্সপ্রেসের গল্প বলার জন্য কবির প্রথমবারের মতো আমার কাছে আসেন। আমি তখন তাঁকে বলেছিলাম, আমি তালেবান চরিত্রে অভিনয় করতে চাই। তিনি ভেবেছিলেন, আমি মজা করছি। সত্যি বলতে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত তাঁর মধ্যে আমি কোনো পরিবর্তন খুঁজে পাইনি। ‘এক থা টাইগার’ থেকে ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, তার পর ‘টিউবলাইট’ তিনি একই আছেন।
প্রশ্ন : শুটিংয়ে কি সব সময় আপনার একমত হতেন?
উত্তর : আমি তাঁকে যদি কিছু বলতাম, তিনি বলতেন ‘নেহি ইয়ার’। আবার তিনি যদি কিছু বলতেন, আমি বলতাম ‘নেহি ইয়ার’। তবে মাঝেমধ্যে আমাদের দুজনের বোঝাপড়া ঠিক হতো। তাই তাঁর পরিচালনায় আমার চলচ্চিত্রের সংখ্যা বেশি।
প্রশ্ন : এই প্রথম আপনি সংখ্যার কথা বললেন। আমার মনে হয় না, আপনার চলচ্চিত্রের আয়ের দিকে আপনি খুব বেশি নজর দেন।
উত্তর : আমি আপনাকে বলতে পারি সংখ্যাটা আসলে খুব বড় একটি বিষয়। ‘বাহুবলি’র সাফল্যের বড় কারণ হচ্ছে হিন্দি ছবির দর্শকও একে সাদরে গ্রহণ করেছে। তাঁরা জানেন না, এর আগেও ‘বাহুবলি’র মতো বড় বাজেটের তেলেগু চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। এমনকি তাঁরা দু-তিনজন দক্ষিণের নায়ক ছাড়া আর কোনো নায়কের নামও জানেন না। তবে দক্ষিণের দর্শক আমাদের ভালোভাবেই চেনে। তবুও আমাদের চলচ্চিত্রগুলো সেখানে খুব ভালো ব্যবসা করতে পারে না। এর কারণ হচ্ছে, দক্ষিণের দর্শকদের তাঁদের অভিনেতাদের প্রতি এক ধরনের ভক্তি কাজ করে। তাঁদের এই ভক্তিটা খুব মজবুত। যদি কেউ কমল হাসানের ভক্ত হয়, তাহলে সে আজীবন কমল হাসানের ভক্ত হয়েই থাকবে। যদি কেউ রজনীকান্তের ভক্ত হয়, তাহলে সে সারাটা জীবন রজনীকান্তের ভক্ত হিসেবেই কাটিয়ে দেবে। আমাদের এখানে পাইরেসি আছে। কিন্তু দক্ষিণে কোনো পাইরেসি নেই। তাঁদের দর্শক পাইরেসির বিরুদ্ধে বেশ কঠোর।
প্রশ্ন : এখানে বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে এমন লোকজনও তো বাসায় বসে অন্য অভিনেতাদের পাইরেডেট চলচ্চিত্র দেখে।
উত্তর : হ্যাঁ। এ জন্য হিন্দি চলচ্চিত্রের দর্শকদের প্রতি আমার সম্মান জানাই। তাঁরা চলচ্চিত্র পছন্দ করেন। তাঁরা ইংরেজি, চীনা, দক্ষিণ সব ধরনের চলচ্চিত্র দেখেন। একজন সালমান খানের ভক্ত আমির খান বা শাহরুখ খানের চলচ্চিত্র দেখবে এবং ছবিটি যদি ভালো হয়, তাহলে তাঁরা তারিফ করবে।
প্রশ্ন : আপনি বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন ২৫ বছর হয়ে গেল। আপনি কি কখনো অনুভব করেছেন যে এই ইন্ডাস্ট্রিতে পাকাপাকিভাবে একটা জায়গা দখল করতে পেরেছেন, নাকি ইন্ডাস্ট্রির এই প্রতিযোগিতা আপনার পা মাটিতেই রেখেছে এবং আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
উত্তর : আমি সব সময় আমার পা মাটিতে রেখেছি। এটা অন্য কারো সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য নয়। এই প্রতিযোগিতাটা আসলে নিজের সঙ্গেই। যদি আপনি চলচ্চিত্রের আয়ের এ কথা বলেন, এটা আপনার আয়, আর আয়ের দিক দিয়ে আপনাকে কেউ হারাতে পারবে না। এটা ভুল। আমি বিশ্বাস করি, অন্যকে ছোট করা উচিত নয়, তবে প্রত্যেককে নিজের জায়গা থেকে উন্নতির চেষ্টা করা উচিত। আপনি যখন এটা করবেন, তখন অন্যরাও নিজেদের জায়গা থেকে উন্নতি করার চেষ্টা করবে। কিছু লোকজন অন্যকে ছোট করার চেষ্টা করে। অন্যের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রচারণা চালায়। আমি মনে করি, এটার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আমার প্রবীণদের কাছ থেকে এটাই শিখেছি।
প্রশ্ন : প্রতিটি চলচ্চিত্রেই অভিনেতা হিসেবে আপনি নিজেকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। ‘বজরঙ্গি ভাইজানে’ আপনি আপনার মারকুটে ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। ‘সুলতান’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে আপনি দেহের গঠন বদলান। ‘টিউবলাইটে’ আপনি এমন একজনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, যার একটু বিশেষ যত্নের প্রয়োজন। এটা কি আপনি সচেতনভাবেই করেন?
উত্তর : আমার মনে হয়, এ মুহূর্তে ভাগ্য আমার সহায় আছে। তাই বিভিন্ন ধরনের স্ক্রিপ্ট আমার কাছে আসছে। আমার পরবর্তী চলচ্চিত্র ‘টাইগার জিন্দা হ্যায়’ একটি অ্যাকশনধর্মী চলচ্চিত্র। পরবর্তী চলচ্চিত্রের স্ক্রিপ্ট অনুযায়ী আমাকে একজন নৃত্যশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করতে হবে। পাশাপাশি আমার চরিত্রটির নয় বছর বয়সী একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। এটি একটি ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র। আমার চরিত্রটি নৃত্যশিল্পী হতে চায়নি। তবে তার কন্যা একজন নৃত্যশিল্পী। স্ত্রীর মৃত্যুর আগে সে তার স্ত্রীকে ওয়াদা করে, তার ছোট মেয়েটি যা চায় তাই সে পূরণ করবে। তাই আমার চরিত্রটি বলে বসে আমার মেয়ে আমাকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেখতে চায়, তাই আমাকে সঠিকভাবে নাচ শিখতে হবে।
প্রশ্ন : ‘টিউবলাইটে’র জন্য আপনাকে কি আলাদাভাবে কোনো প্রস্তুতি নিতে হয়েছে? আপনি বলেছিলেন এটা যতগুলো ছবি করেছেন, তার মধ্যে এটা সবচেয়ে কঠিন চরিত্র ।
উত্তর : এটা নিষ্পাপ একটি চরিত্র। যখন আমি টিউবলাইটের স্ক্রিপ্ট পড়ি, মহেশ মাঞ্জেকরের ছেলে সত্যের কথা আমার মাথায় আসে। তার মধ্যে সরলতা রয়েছে। আমি আমার শারীরিক ভাষা বদলেছি এবং এটা খুবই সাধারণ একটি চরিত্র। আমার হাতগুলো সে অঙ্গভঙ্গিতে নাড়িয়েছি এবং আমার হাঁটার ভঙ্গিমাও আলাদা ছিল। তবুও আমার মনে হয়েছে, আমি চরিত্রটি পর্দায় সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারব না। তাই আমি মহেশকে (মহেশ মাঞ্জেকর) বলি তার ছেলে সত্যকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে।
আমি তাকে লক্ষণ সিংয়ের চরিত্রটি পড়তে বলি। সে একপৃষ্ঠা পড়ে। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করে, স্যার এটা কী? আমি তাকে বলি এটা একটি চরিত্র, যাতে আমি অভিনয় করব। সে বলে, স্যার আপনি আমাকে এটা যখন পড়তে বলেছিলেন, তখন আমার মনে হয়েছে আমাকে এই চরিত্রে অভিনয় করতে হবে। আমি তাকে বলেছিলাম, এটা খুবই সাধারণ একটি বালকের চরিত্র, যেটাতে আমি অভিনয় করতে চলেছি এবং আমি সে বালক নই, তবে তুমি সেই সাধারণ বালক। তাই আমি তোমাকে সে চরিত্রটিতে একবার দেখতে চাই। এরপর আমার বডি ডাবল পারভেজ, সেও একজন সরল চরিত্রের ছেলে। চলচ্চিত্রের লং শটে সে আমার পরিবর্তে অভিনয় করেছে। টিউবলাইট করার জন্য এ দুজনকে আমার অনুপ্রেরণা বলা যায়।
প্রশ্ন : টিউবলাইটে আপনার এই শারীরিক ভাষাটা কোথায় পেলেন?
উত্তর : (হাসি) টিউবলাইটের শরীরের এই ভাষাটা এসেছে ‘সুলতান’ থেকে। সুলতান করার সময় আমার পেছনে ব্যথা ছিল। লিগামেন্টে ছিঁড়ে গিয়েছিল। কাঁধে ব্যথা ছিল।
তখন মনটাও ভালো ছিল না। টিউবলাইটের জন্য আমি সেই অবস্থাকেই আবার ফিরিয়ে এনেছি। সেই শারীরিক ভাষাটাকেই আমি টিউবলাইটে ব্যবহার করেছি।
প্রশ্ন : যখন আপনি এ ধরনের চরিত্রে অভিনয় করে বাসায় ফেরেন, তখন কি চরিত্র আপনার সঙ্গে বাসায় ফেরে?
উত্তর : এ ধরনের চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে চরিত্ররাও আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরে।
প্রশ্ন : কেন?
উত্তর : কারণ এ ধরনের চরিত্রেরা চমৎকার। এখানে আমি চরিত্রকে নয়, বোঝাতে চাইছি চরিত্রের ব্যক্তিত্বকে, তাদের হাঁটা-চলাকে নয়, বোঝাতে চাইছি তাদের হৃদয়ের অনুভূতিগুলোকে। হোক সেটা বজরঙ্গি, ওয়ানটেড, দাবাং বা টিউবলাইট। এখন সবগুলো চরিত্রের একটা খিচুড়ি আমার মধ্যে আছে। তারা সকলেই মহৎ চরিত্র। তাদের কথার প্রতিটি লাইন, পরিস্থিতিকে সামলানোর ক্ষমতা। বাস্তব জীবনে আপনি এগুলোর ২০ থেকে ২৫ শতাংশ প্রয়োগ করতে পারবেন। এ ছাড়া আপনার বয়স যত বাড়বে, আপনি তত বেশি পরিপক্ব হয়ে উঠবেন। আপনি হুট করে আর রেগে যাবেন না বা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়বেন না। আপনি প্রতিক্রিয়া দেখাতে সময় নেবেন। যতক্ষণ না পর্যন্ত কোনো সংকট তৈরি হয়। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে কেউ উপস্থিত হয়। ওই মুহূর্তে আপনি ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেন।
প্রশ্ন : টিউবলাইট আপনাকে আর সোহেলকে (সোহেল খান) আবারও একসঙ্গে দেখা গেছে। ছবিটিতেও সোহেল আপনার ছোট ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয় করছে। ছবিটির চিত্রায়ণ করতে গিয়ে কোনো আবেগপ্রবণ মুহূর্ত আছে কি?
উত্তর : যখন আমি স্ক্রিপ্ট পড়ি, তখন কোনো না কোনোভাবে সোহেলের কথা আমার মনে পড়েছে। আমি মনে মনে সোহেলকে দেখতে পেয়েছি এবং আমি জানতাম, চরিত্রটির জন্য হয়তো তারা মনে মনে বড় কোনো তারকার কথা চিন্তা করেছে। তাই এ ব্যাপারটি নিয়ে একটি বেগতিক অবস্থা তৈরি হয়। আমি চিন্তা করতে থাকি, কীভাবে আমি সোহেলের নামটি বলব, যখন তারা চরিত্রটির জন্য বড় কোনো তারকার কথা চিন্তা করছে। ছবিটিকে একটি আলাদা মাত্রা দিতে এই একটি বাধা ছিল, যা আমাদের অতিক্রম করা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছিল। প্রথম থেকেই এই চরিত্রে আমি সোহেলকে কল্পনা করে আসছি। তাকে ছাড়া যেকোনো অভিনেতাকে আমার সামনে দাঁড় করানো হোক না কেন, আমি এই চরিত্রটি করতে পারতাম না।
প্রশ্ন : এর কারণে হয়তো শুটিংয়ের সেটেও আপনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন?
উত্তর : অবশ্যই। সাধারণত শুটিংয়ে আমি ‘শট রেডি টু টেক থেকে কাট, ওকে, পরবর্তী দৃশ্য কী?’ ধরনের। তবে এই ছবির ক্ষেত্রে আমি কেঁদেছি। শুটিংয়ে তো বটেই, এমনকি ডাবিং করতে গিয়েও আমার কান্না পেয়েছে। আমি স্ক্রিপ্টটা পড়েছি। তাই আমি জানি কোন দৃশ্যের পর কোন দৃশ্য আসবে। ছবিটির কাহিনী নিয়ে চিন্তা করতে গেলেও আমার কান্না পেত এবং সারা দিনই আমি আবেগপ্রবণ দৃশ্যে অভিনয় করছি। যখন আপনি কারো সঙ্গে ব্রেকআপ করবেন, আপনি বড়জোর ১৫ মিনিট কাঁদবেন।
এরপর থেকে আপনার অন্য কাউকে ভালো লাগা শুরু হবে। কিন্তু এখানে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ধরে শুটিং। এই শট সেই শট। ট্রলি শট এবং আবার আপনার কাঁদা শুরু। এ ছাড়া শব্দেরও কিছু ব্যাপার ছিল। যদি একটা কাকও শটের মাঝখানে ডেকে উঠত, তাহলেই কাট আবার নতুন করে শুরু কর। আবার কাঁদো। তাই যতগুলো ছবি আমি করেছি, তার মধ্যে এটাই সবচেয়ে ক্লান্তিকর চলচ্চিত্র ছিল।
প্রশ্ন : সোহেলের (সোহেল খান) জন্যও কি বিষয়টা এমন ছিল?
উত্তর : না।