কিছু স্মৃতি, কিছু কথা ও এনটিভি
২০০৪ সালের ১৩ মে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ভৈরব প্রতিনিধি হিসেবে নিউজ পাঠানোর অনুমতিপত্র পাই আমি। তখন পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন রাশিদুন্নবী বাবু ভাই। এনটিভির তৎকালীন সহকারী প্রযোজক, বন্ধু নঈম তারিক সাথে করে নিয়ে গিয়ে বাবু ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি তাৎক্ষণিক পত্রিকাটির মফস্বল সম্পাদক আমিনুর রশীদ সেন্টু ভাইকে ডেকে আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করতে বলেন। এর আট মাস পর ২৯ জানুয়ারি ২০০৫ সালে নিয়োগ হয় আমার।
এনটিভি সপ্তম তলায়। আমার দেশ দশম তলায়। আমার দেশে গেলে আগে সপ্তম তলায় যেতাম। নঈমকে নিয়ে দশম তলায় যেতাম। বাবু ভাইয়ের রুমে বসে কথাবার্তা হতো আমাদের সে সময়। ওই বছরেই জুন মাসের মাঝামাঝি আমার দেশ অফিসে ফাহিম ভাইয়ের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয় নঈম তারিক। ফাহিম ভাই তখন এনটিভির ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ ছিলেন।
পরিচয় শেষে তিনি আমাকে এনটিভিতে কাজ করার আমন্ত্রণ জানালেন। আমি তখন বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দিইনি। মাঝেমধ্যে নিউজ পাঠাতে থাকলাম। কিন্তু আমার পাঠানো নিউজ অনএয়ার হচ্ছিল না।
সেই বছরের ২১ আগস্ট (২০০৪ সাল) ঢাকার পল্টনে তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলের সন্ত্রাসবিরোধী দলের সভায় গ্রেনেড হামলা হলে আওয়ামী লীগ নেত্রী বেগম আইভী রহমান গুরুতর আহত হন। এরপর গুরুতর আহত হয়ে ২৪ আগস্ট মারা যান তিনি। সে দিন ভৈরবে উত্তেজিত জনতা আন্তঃনগর সুবর্ণ এক্সপ্রেসে আগুন দেয়।
এই ঘটনার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ফাহিম ভাই আমাকে ফোনে বলেন, দ্রুত ঘটনাস্থলে যেতে এবং নিউজ পাঠাতে। ওই দিন সারা দিন আমার নিউজ এনটিভিতে যেতে থাকে। টিভিতে আমার নামে নিউজ যায়। আমার মাঝে তখন অন্যরকম এক অনুভূতি কাজ করতে থাকে। সে দিনের পর থেকে আমার নিউজ নিয়মিত যেতে থাকল।
কিছুদিন পর সাপ্তাহিক ছুটিতে নঈম তারিক বাড়ি আসলে আমাকে সাথে নিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর একটি প্যাকেজ তৈরি করল। ফুটেজ করা, ভক্সপপ ও সিঙ্ক ধারণ করা ইত্যাদি শিখে নিলাম ওর কাছ থেকে।
২০০৫ সালের ১ জুলাই এনটিভির অফিসে দিনব্যাপী প্রতিনিধি সম্মেলন শেষে বিকেলে নিয়োগপত্র, উপহার, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি আমাদের হাতে তুলে দিলেন এনটিভির চেয়ারম্যান আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলী স্যার। সে দিন সারা দেশ থেকে আমরা ৩০ জনের মতো নিয়োগ পাই।
২০০৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর আমিসহ ১৪ জনকে স্টাফ করেসপনডেন্ট হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে পর্যায়ক্রমে অনেকেই স্টাফ করেসপনডেন্ট হয়েছেন পরবর্তীতে। আমার জানামতে দেশের গণমাধ্যম জগতে এনটিভিই সর্বপ্রথম মফস্বলের কর্মীদের এই মর্যাদায় ভূষিত করার প্রক্রিয়া শুরু করে নিয়মিত বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধার ব্যবস্থা করে।
২০০৪ সাল; হিসেবে প্রায় দেড় যুগ অর্থাৎ ১৮ বছর যাবৎ প্রিয় কর্মস্থল এনটিভিতে কাজ করছি। শুরু থেকে আজ পর্যন্ত আমরা সবাই একই পরিবারের সদস্য হিসেবে আছি। আর্থিক সুবিধা ছাড়াও চেয়ারম্যান স্যারের মহানুভবতায় আমরা চায়ের কাপ থেকে শুরু করে ল্যাপটপ পর্যন্ত উপহার পেয়েছি। আর ভালোবাসা, মর্যাদা? অপরিসীম। যা কোনও কিছুর মাপকাঠি দিয়ে পরিমাপ করা যাবে না।
এখনও আমি অফিসে যাই। সবার ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ। তখন মনেই হয় না, আমি বা আমরা মফস্বল সাংবাদিক।
প্রতিটি প্রতিনিধি সম্মেলন আমাদের মহা উৎসবের দিন। সে দিন আমরা সারা দিন একসাথে থাকি, শিখি। আমরা একে অপরের সাথে অভিজ্ঞতা বিনিময় করি। নতুন করে আরও ভালো কাজের অনুপ্রেরণায় উদ্ভাসিত হই।
যদিও বিরতি পড়েছে আমাদের প্রতি বছরের ফ্যামিলি ডেতে। তার পরেও অতীতে আমাদেরসহ পরিবারের সদস্যদের কাছে সুখের স্মৃতি হয়ে আছে, থাকবে। ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্র, সাভারের রোজা গার্ডেনের ফ্যামিলি ডে, যেগুলো সুখস্মৃতি হয়ে আছে।
২০১২ সালের ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের হোটেল কক্স টুডেতে আমাদের প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমরা ২৫ থেকে ২৯ তারিখ পর্যন্ত আমরা কক্সবাজারে অবস্থান করি। সম্মেলন চলাকালে দুদিন চেয়ারম্যান স্যার সন্ধ্যা হলে আমাদের নিয়ে সমুদ্র সৈকতে চলে যেতেন। আমরা হৈচৈ করতাম। ছবি উঠাতাম স্যারের সাথে। সে বছর চেয়ারম্যান স্যার আমাদের প্রত্যেককে একটি করে ল্যাপটপ উপহার দেন।
তবে সুখের স্মৃতির মাঝেও একটি কষ্টের স্মৃতি আমাদের সবাইকে সারা জীবন তাড়িয়ে বেড়াবে। সেই দুঃসময়টুকু হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটাবে। সেটি হলো ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি আমাদের প্রিয় কর্মপ্রতিষ্ঠানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। সে দিন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আমাদের ভবনে আগুন লাগে। দাউদাউ করে পুড়ে ছাই হয়ে যেতে থাকে আমাদের ভালোবাসার সূতিকাগার। জীবন-মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়েন আমাদের প্রিয় সহকর্মীরা।
সে দিন সকালে আমি ভৈরবের কালিপুর এলাকায় একটি প্যাকেজের কাজ করছিলাম। কাজের মাঝেই বর্তমান পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ভিপি মুজিব ভাই আমাকে কল করে আগুন লাগার বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, বাংলাভিশন লাইভ দেখাচ্ছে। জানার পর সাথে সাথে দৌড়ে কাছের একটি চায়ের দোকানে ঢুকে বাংলাভিশন টেলিভিশনে চোখ রাখলাম। দেখি আগুন আর ধোঁয়াতে একাকার পুরো ভবন। এনটিভির সাথে জ্বলছে আমার দেশ, আরটিভি।
আমি সেখানে দাঁড়িয়ে টিভির সামনে থেকেই একে একে হাসনাত খুরশীদ ভাই, ফাহিম ভাই, আনিস ভাই, লিটন ভাই, মিজান ভাইকে কল দিলাম। কিন্তু কেউ রিসিভ করছেন না। ভেতরটা কেমন করে উঠল। শেষে কল দিলাম মনিরা আপুকে (বর্তমানে ন্যাশনাল ডেস্ক ইনচার্জ)। তিনি রিসিভ করলেন। কিন্তু কাঁদছেন। জানালেন, অনেকের সাথে ভবনের ছাদে আছেন তিনি। পায়ের নিচে আগুনের উত্তাপ, পা রাখাই দায়। চারদিকে ধোঁয়া আর ধোঁয়া। শ্বাস নেওয়ার মতো অবস্থা নেই। আর মাথার ওপর রোদের উত্তাপ। তিনি দোয়া চাইলেন।
তখন আমার নিজের কী অবস্থা, আমি যেন বুঝতে পারছি না। কী করব, কোথায় যাব—কিছুই ঢুকছে না মাথায়। এক সময় সেখানকার লোকজন আমাকে একটা রিকশায় উঠিয়ে দিলে বাসায় আসি। অনেক চেষ্টার পর আগুন নেভে। কিন্তু এই ভয়াবহ স্মৃতি এনটিভির কোনও কর্মী কোনও দিনই ভুলতে পারবেন না।
মহান রব আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আলহাজ্ব মোহাম্মদ মোসাদ্দেক আলীর নেকহায়াত ও সুস্থতা দান করুন।
লেখক : স্টাফ করেসপনডেন্ট, ভৈরব