চিন্তা-উন্মাদ বদরুল
পরীক্ষা দিতে এসে ধারালো চাপাতির উপর্যুপরি কোপ খেয়ে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে পতিত কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসের পরিণতি আমাদের ক্ষয়িঞ্চু মূল্যবোধ, নীতিবোধ আর অন্ধকারের পথ নির্দেশ করে।
গত ৩ অক্টোবর সিলেটের এমসি কলেজ যে বর্বরোচিত ঘটনার সাক্ষী হয়েছে সেটা অমানবিক, এবং একই সঙ্গে ক্ষমতাবানদের কৃত অপরাধের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে উদ্ভূত একটা উদাহরণ। প্রকাশ্য দিবালোকে একটা কলেজ ক্যাম্পাসে এমন ঘটনা ঘটবে এ ধরনের চিন্তা আসেনি কারো থেকে। তবে এটা অনাগত ভবিষ্যতের জন্য এক কালো উদাহরণ।
আক্রান্ত খাদিজা কলেজছাত্রী ছিল, আর আক্রমণকারী বদরুল ছিল অস্থির, উন্মাদ মানসিক চিন্তার অধিকারী। কিন্তু তার মাধ্যমে সবচেয়ে করুণ ও হৃদয়বিদারক এক ঘটনার সাক্ষী হলো সারা দেশ। আক্রান্ত হলো খাদিজা নামের এক মেয়ে।
পড়াশোনা, শিক্ষকতা ও ছাত্ররাজনীতি সবখানেই ছিল বদরুলের সক্রিয় অংশগ্রহণ। অন্যদিকে, খাদিজা আক্তার নার্গিস সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের ছাত্রী ছিলেন এবং এমসি কলেজে তাঁর যাওয়ার কারণ ছিল ডিগ্রি পরীক্ষা। তাদের দুজনের মধ্যে আগে থেকেই পরিচয় ছিল, বদরুল খাদিজাদের বাড়িতে লজিং মাস্টারও ছিল; যা এরই মধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে এবং সন্ত্রাসী বদরুল আদালতে তার দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সেটাও বলেছে। বদরুলের দাবি, খাদিজার সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল এবং প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়েই সে তার প্রাণ হরণ করতে চেয়েছে।
কলেজছাত্রী খাদিজা আক্তার নার্গিসকে হত্যার নিমিত্তে ধারালো চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যাচেষ্টার পর সন্ত্রাসী বদরুলের পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এরপর নানামুখী আলোচনার প্রেক্ষিতে অনেকের মনে প্রশ্ন জেগেছে? প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক কারণ আর যাই হোক কোনো সাধারণ শিক্ষার্থী প্রকাশ্য দিবালোকে একটা কলেজ ক্যাম্পাসে চাপাতি দিয়ে মানুষ খুনের চেষ্টার মতো এত বড় সন্ত্রাসী কাজ করার সাহস পেত না। বদরুল পেরেছে, কারণ সে নিজেকে একজন ক্ষমতাবান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এর আগে একবার এই খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টার পর গণপিটুনি খেয়েছিল এবং সে গণপিটুনিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা হয়েছিল।
লজিং শিক্ষক হিসেবে খাদিজাদের বাসায় থাকার সময় স্কুলপড়ুয়া খাদিজা আক্তার নার্গিসকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে বদরুল আলম। সোমবারের (৩ অক্টোবর) হামলার আগে গত ২০১২ সালের ১৩ জানুয়ারি খাদিজার স্কুল জাঙ্গাইল সফির উদ্দিন স্কুল অ্যান্ড কলেজে গিয়ে খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করে বদরুল। তখন খাদিজার স্বজনরা তাকে ধরে গণপিটুনিও দিয়েছিল। এরপর খাদিজা সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তির পর নিয়মিত খাদিজাকে উত্ত্যক্ত করে আসছিল বদরুল। খাদিজার কলেজে গিয়েও উত্ত্যক্ত এবং সর্বশেষ হত্যার উদ্দেশ্যে নৃশংসভাবে চাপাতি দিয়ে কোপানোর ঘটনার পর আবার নতুনভাবে গণমাধ্যামে উঠে আসে।
চিন্তা-উন্মাদ দুর্বৃত্ত বদরুল আলম চাপাতি দিয়ে খাদিজা আক্তারকে হত্যাচেষ্টার পর থেকে তাকে কেবল অস্বীকারই করছে না ছাত্রলীগ, যারা খাদিজাকে উদ্ধার করে তাদেরকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দাবিও করে বসেছে তারা। এমন অবস্থায় উদ্ধারকারী হিসেবে পরিচিতি পাওয়া সিলেট সরকারি কলেজ থেকে সদ্য এইচএসসি উত্তীর্ণ ইমরান কবির নিজে কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন বলে জানিয়েছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, ‘আমি কোনো দলের সাথেই জড়িত নই, আমাকে রাজনীতির সাথে জড়াবেন না।’
উদ্ধারকারী ইমরান কবির কোনো ছাত্রসংগঠনের নেতা কিংবা কর্মীও নন। এটা কোনোভাবেই সঠিক রাজনীতি হতে পারে না।
বদরুল ছাত্রলীগ নেতা নন- এ দাবি করলেই কি ছাত্রলীগ তার দায় এড়াতে পারে? তবে হ্যাঁ, যেকোনো অপরাধ যেকোনো ছাত্র সংগঠনের নীতি, আদর্শ ও লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, সংগঠনের কাউকে সেটা করতে উৎসাহিতও করা হয় না; কিন্তু এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটলে পদস্থ কেউ ‘আমাদের নয়’ এমন দাবি স্রেফ ঘটনাকে আড়াল করার নামান্তর।
বদরুলের এ নৃশংসতার পর তার সংগঠন থেকে আনুষ্ঠানিক বহিষ্কার না করে উল্টো তার পদ আগে থেকেই বাতিল হয়েছে বলে দাবি করেছে ছাত্রলীগ। তবে এটা তাদের কৌশলী অবস্থান। অথচ বদরুলের ব্যাপারে এসে গঠনতন্ত্রের প্রসঙ্গে অতি-উল্লেখ লক্ষণীয়।
খাদিজার ওপর নৃশংস হামলার কারণে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে এবং এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বদরুলের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমানে কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছে। এদিকে বদরুল যে প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত সেখান থেকেও তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে।
চাপাতির উপর্যুপরি কোপে গুরুতর আহত খাদিজা শেষ পর্যন্ত বাঁচবে কি না জানি না, তবে বেঁচে থাকলেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবে কি না সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ভাগ্যিস উদ্ধারকারী ইমরান কবির জানিয়েছেন তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নন।
ছাত্রলীগ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠন। গৌরবময় অতীত ইতিহাস আছে তাদের। কিন্তু সাম্প্রতিক ছাত্রলীগ যেন সেই ছাত্রলীগের অর্জনকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতে মরিয়া। এতে করে যে ছাত্রলীগ একটা সময়ে সম্মানের প্রতিশব্দ ছিল, সেটা ক্রমে প্রশ্নের দিকে ধাবিত হচ্ছে; এটা দুঃখজনক।
খাদিজার ওপর নৃশংস হামলার পর ছাত্রলীগ পারত বদরুলকে স্বীকার করে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি বিচারের দাবিকে জোরালো করতে। এতে করে সংগঠনটির মধ্যে থাকা অপরাপর বদরুলরা সতর্ক হতো, কিন্তু তারা তা না করে অস্বীকারতত্ত্বে মরিয়া হয়ে ওঠে। এতে করে সংগঠনটি ভাবমূর্তিজনিত ক্রম-সংকটের পালে আরো জ্বালানি জোগাল। জানি না বিষয়টি তারা অনুধাবন করতে পেরেছে কি না, তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় তারা পারেনি। এমন অবস্থায় স্বভাবপ্রশ্ন- কবে পারবে তারা?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, সিলেটটুডে টোয়েন্টিফোর ডটকম