ফুটবলে বিদেশি কোচ উপাখ্যান
বরাবরই অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে জাতীয় ফুটবল দলের জন্য বিদেশি কোচ নিয়ে আসা হয়; কিন্তু তাঁদের বিদায়ের সময় পাল্টে যায় প্রেক্ষাপট। বেশির ভাগ সময় বিদেশি কোচকে বিদায় নিতে হয় নানা নাটকীয়তা আর তিক্ততার ভেতর দিয়ে।
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সঙ্গে কখনো চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে হয় কাউকে, কেউ বা দলকে ভালো ফল এনে দিয়েও চুক্তি নবায়ন করার সুযোগ পান না।
স্বাধীনতার পর থেকে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ফাবিও লোপেজের আগ পর্যন্ত ১৬ জন বিদেশি কোচ বাংলাদেশ দলের দায়িত্বে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে খুব কম কোচই বাফুফের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রেখে বিদায় নিতে পেরেছেন।
জার্মান কোচ অটো ফিস্টারের কথাই ধরা যাক। তাঁর হাত ধরেই বাংলাদেশের ফুটবলে প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপার আগমন—১৯৯৫ সালে মিয়ানমারের গ্র্যান্ড রয়েল চ্যালেঞ্জ কাপ। ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৭ পর্যন্ত দুই বছর দায়িত্ব পালন করা এই কোচ তবু চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে পারেননি।
চুক্তি শেষেই স্বদেশে ফিরে যেতে হয়েছে ফিস্টারকে। অথচ আফ্রিকার দেশ টোগোকে তিনি নিয়ে গেছেন ২০০৬ বিশ্বকাপে। কিন্তু এমন গুণী কোচকে বাংলাদেশ ধরে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশের আরেক সফল কোচ ইরাকের সামির শাকিরের বিদায় ভালোভাবে হয়নি। সাফ গেমস ফুটবলের অধরা শিরোপা তাঁর হাত ধরেই আসে। কিন্তু ১৯৯৯ কাঠমান্ডু সাফ গেমসে বাংলাদেশকে প্রথম সোনার পদক জিতিয়ে নেপাল থেকেই দেশে ফিরে যান তিনি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে খেলা সামির ঠিক কী কারণে চলে যান, তা আজও অজানা। তবে জনশ্রুতি আছে, তখনকার বাফুফে কর্মকর্তাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় না বলেই চলে যান তিনি।
এসএ গেমস ফুটবলে (সাবেক সাফ গেমস) বাংলাদেশকে দ্বিতীয় সোনার পদক এনে দেওয়া সার্বীয় কোচ জোরান দর্দেভিচের বিদায় ছিল আরো নাটকীয়। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে দায়িত্ব নিয়ে মাত্র এক মাসের মাথায় বাংলাদেশকে সফলতা এনে দেন তিনি। কিন্তু এসএ গেমস শেষ হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে বাফুফে জানায়, বেতন-ভাতা নিয়ে কিছু ‘অযৌক্তিক’ দাবি করছেন দর্দেভিচ। তাই দায়িত্ব নেওয়ার মাসখানেকের মধ্যে তাঁকে বরখাস্ত করে বাফুফে।
বিদেশি কোচদের এমন আসা-যাওয়াকে অবশ্য স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন, ‘কোচ আসবে, কোচ যাবে এটাই স্বাভাবিক। সারা দুনিয়ার ফুটবলেই এমন চিত্র। একে ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার অবকাশ নেই। বনিবনা হলে তিনি থাকবেন, আর না হলে তাঁকে চলে যেতে হবে।’
তবে এই যাওয়া-আসার গল্পে ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। অস্ট্রিয়ান কোচ জর্জ কোটানকে তিক্ততা নিয়ে বিদায় নিতে হয়নি। ২০০০ সালে দায়িত্ব নেওয়ার তিন বছর পর বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা এনে দেন তিনি। কিন্তু কোটান থাকার আগ্রহ দেখালেও বাফুফে তাঁকে রাখেনি। ঢাকা আবাহনী অবশ্য এই দুর্দান্ত ‘টেকটিশিয়ান’কে ভোলেনি। অনেক দিন পর আবার তাঁকে দেখা যাবে ঢাকার মাঠে। এ মৌসুমে আবাহনীর কোচের দায়িত্বে আছেন কোটান।
বাংলাদেশের ফুটবলের উজ্জ্বল নাম কোটানের এনে দেওয়া সাফল্য আজও আপ্লুত করে গোলাম সারোয়ার টিপুকে। জাতীয় দলের এই সাবেক কোচের বিশ্বাস, ভালো ফল পেতে হলে একজন কোচকে অবশ্যই সময় দিতে হবে। তাঁর মতে, ‘দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া ভালো ফল আশা করা যায় না। আর বিদেশি কোচ হলে তো খেলোয়াড়দের চিনতেই অনেকটা সময় পার হয়ে যায়। তাই একজন বিদেশি কোচকে দীর্ঘ মেয়াদে দায়িত্ব দেওয়া উচিত। তাহলেই সম্ভব সুফল পাওয়া।’
এ ক্ষেত্রে কোটানের উদাহরণ টানলেন দেশের ফুটবল-অঙ্গনের প্রিয় মুখ টিপু, ‘যেমনটা হয়েছে কোটানের বেলায়, তিনি সময় পেয়েছেন বলেই সফলতা দিতে পেরেছেন। তা ছাড়া কোচ নিয়োগের ক্ষেত্রে বাফুফের কিছু বিধি মেনে চলা উচিত। বড় দেশের হলেই যে তিনি বড় কোচ হবেন, তা ঠিক নয়। পূর্ব অভিজ্ঞতা দেখে এবং সবকিছু বাছ-বিচার করেই নিয়োগ দেওয়া উচিত।’
ডাচ কোচ লোডভিক ডি ক্রুইফকে অবশ্য অনেক যাচাই-বাছাই করেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। বাংলাদেশ দলের সর্বশেষ বিদেশি কোচের পেছনে বাফুফে অনেক টাকা ঢাললেও কোনো সফলতা আসেনি; বরং তাঁর অধীনে ২০১৩ কাঠমান্ডু সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল লজ্জাজনক।
শুধু মাঠের ব্যর্থতা নয়, মাঠের বাইরে ক্রুইফের কিছু আচরণও মেনে নিতে পারেনি বাফুফে। গত জুনে দুই বছরের চুক্তি শেষ হওয়ার পর টুর্নামেন্ট ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বিশ্বকাপ বাছাই পর্বে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৫-০ গোল এবং ঘরের মাঠে জর্ডানের কাছে ৪-০ গোলে হারের পর গত বুধবার অনেকটা সমঝোতার ভিত্তিতে তাঁকে বিদায় করে দেওয়া হয়েছে। পরদিনই তাঁর জায়গায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ইতালিয়ান কোচ ফাবিও লোপেজকে।
লোপেজকে চার মাসের জন্য নিয়োগ দিয়েছে বাফুফে। তাঁর চুক্তির মেয়াদ ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত।
বাফুফে যে ‘ভেবেচিন্তে’ কাজ করে না, তার একটা প্রমাণ হতে পারে বর্তমান কমিটির কর্মকাণ্ড। এই কমিটির প্রায় ছয় বছরের মেয়াদে চারজন বিদেশি কোচ বিদায় নিয়েছেন। এমনকি একজন নিয়োগ চূড়ান্ত হওয়ার পরও আসেননি!
সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি দায়িত্ব নেওয়ার কিছুদিন পর, ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ব্রাজিলের এডসন সিলভা ডিডোকে কোচ করা হয়। কিন্তু একসঙ্গে জাতীয় দলের আটজন খেলোয়াড়কে বাদ দিয়ে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ ডিডো বরখাস্ত হন সে বছরের নভেম্বরেই।
২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে দর্দেভিচকে বরখাস্ত করার পর সে বছরের সেপ্টেম্বরে এক বছরের চুক্তিতে ক্রোয়েশিয়ার রবার্ট রুবচিচকে কোচের দায়িত্ব দেয় বাফুফে। কিন্তু পরের বছরের জুনে কাউকে কিছু না বলেই নিজের দেশে ফিরে যান তিনি।
মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে ফিরে গেলেও কয়েক মাসের বেতন-ভাতা নেননি রুবচিচ। পরে তার বকেয়া টাকা-পয়সা পাঠিয়ে দেয় বাফুফে।
রুবচিচ চলে যাওয়ার পর কয়েক দিনের মধ্যেই মেসিডোনিয়ার জর্জি ইয়োভানোভস্কির সঙ্গে কথাবার্তা পাকাপাকি করে ফেলে বাফুফে। কিন্তু ২০১১ সালের ২০ জুন বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব নেওয়ার কথা থাকলেও তিনি আর আসেননি।
ইয়োভানোভস্কির কাছে ‘ধোঁকা’ খাওয়ার দুদিন পর তারই স্বদেশি নিকোলা ইলিয়েভস্কিকে অনেকটা তাড়াহুড়া করে নিয়োগ দেয় বাফুফে। তিনিও পুরো মেয়াদে থাকতে পারেননি। এক বছরের চুক্তিতে আসা ইলিয়েভস্কিকে ছয় মাস পরই বিদায় করে দেওয়া হয়। তাঁর মেয়াদ ছিল ২৪ জুন থেকে ২১ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
অথচ জাতীয় ফুটবল দলে বিদেশি কোচের যাত্রা শুরুর সময়ে ভাবাই যায়নি এই অধ্যায় এতটা বিতর্কিত হবে। বাংলাদেশ দলে প্রথম বিদেশি কোচ জার্মানির ওয়ার্নার বেকেনহফট। তিনি দায়িত্বে ছিলেন তিন বছর, ১৯৭৮ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত। পরের বছরেই কোচের গুরুভার পড়ে বেকেনহফটের স্বদেশি গেরহার্ড স্মিথের কাঁধে। স্মিথও বেশিদিন ছিলেন না।
এরপর দীর্ঘদিন জাতীয় দলে বিদেশি কোচ দেখা যায়নি। ১৯৮৯ সালে এই তালিকায় তৃতীয় সংযোজন ১৯৭৮ বিশ্বকাপে গোলরক্ষক হিসেবে ইরানকে প্রতিনিধিত্ব করা নাসের হেজাজি। ১৯৮৭-তে কোচ-খেলোয়াড় দুই ভূমিকায় ঔজ্জ্বল্য ছড়িয়ে ঢাকার লিগে মোহামেডানকে শিরোপা এনে দিলেও জাতীয় দলে হেজাজি তেমন সুবিধা করতে পারেননি।
এরপর সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়াব (১৯৯৩), দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যান ইয়াং ক্যাং (১৯৯৪), ইংল্যান্ডের মার্ক হ্যারিসন (২০০০), আর্জেন্টিনার আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি (২০০৪-২০০৬), ভারতের সৈয়দ নাঈমউদ্দিনকে (২০০৭) কোচের দায়িত্বে দেখা গেলেও কারো অধীনেই বলার মতো সাফল্য আসেনি।
গত ৩৬ বছরের এত বিদেশি কোচ জাতীয় দলে এলেও সাফল্য খুবই কম; বরং বাংলাদেশের ফুটবল যেন পেছনের দিকে হাঁটছে! মালদ্বীপের উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা বোঝা যাবে। ঢাকায় ১৯৮৫ সাফ গেমসে বাংলাদেশ মালদ্বীপকে ৮-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ এখন এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রের কাছে আমাদের তিন-চার গোলে হারতে হয়।
তবে সে জন্য কোচদের দায়ী করতে রাজি নন সাবেক তারকা ফুটবলার সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালী সাব্বির, ‘আসলে বাংলাদেশের ফুটবল পিছিয়েছে কর্মকর্তাদের অদূরদর্শিতার কারণে। মাঝে নিয়মিত খেলা হয়নি। মেধাবী ফুটবলার খুঁজে বের করার কোনো পরিকল্পনাও কর্মকর্তাদের ছিল না। তাই বাংলাদেশের ফুটবল ধীরে ধীরে এ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে।’
বাফুফে সভাপতি এবং এ দেশের ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকার অবশ্য দাবি, তাঁদের চেষ্টার কোনো কমতি নেই। নিজের কমিটির সাফল্যের চিত্র তুলে ধরে সালাউদ্দিনের বক্তব্য, ‘আমরা ফুটবল নিয়মিত মাঠে রাখতে পেরেছি। ফুটবলাররাও ভালো পারিশ্রমিক পাচ্ছে। সেই পরিবেশ আমরা তৈরি করে দিয়েছি। এখন ভালো খেলা ও ফল এনে দেওয়া ফুটবলারদের দায়িত্ব।’
বাংলাদেশের ১৭ বিদেশি কোচ
জার্মানির ওয়ার্নার বেকেনহফট (১৯৭৮-১৯৮১)
জার্মানির গেরহার্ড স্মিথ (১৯৮২)
ইরানের নাসের হেজাজি (১৯৮৯)
সুইজারল্যান্ডের ওল্ডরিখ সোয়াব (১৯৯৩)
দক্ষিণ কোরিয়ার ম্যান ইয়াং ক্যাং (১৯৯৪)
জার্মানির অটো ফিস্টার (১৯৯৫–১৯৯৭)
ইরাকের সামির শাকির (১৯৯৮-১৯৯৯)
ইংল্যান্ডের মার্ক হ্যারিসন (২০০০)
অস্ট্রিয়ার জর্জ কোটান (২০০০-২০০৩)
আর্জেন্টিনার আন্দ্রেস ক্রুসিয়ানি (২০০৪-২০০৬)
ভারতের সৈয়দ নাঈমউদ্দিন (২০০৭)
ব্রাজিলের এডসন সিলভা ডিডো (২০০৯)
সার্বিয়ার জোরান দর্দেভিচ (২০১০)
ক্রোয়েশিয়ার রবার্ট রুবচিচ (২০১০-২০১১)
মেসিডোনিয়ার নিকোলা ইলিয়েভস্কি (২০১১)
নেদারল্যান্ডসের লোডভিক ডি ক্রুইফ (২০১৩-২০১৫)
ইতালির ফাবিও লোপেজ ( ২০১৫ সেপ্টেম্বর ..)