বিদায় বাংলাদেশের অকৃত্রিম ক্রিকেট-বন্ধু
১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশ তখন আনন্দের সাগরে ভেসে বেড়াচ্ছিল। টেস্ট ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন একটু একটু করে উঁকিও দিচ্ছিল। তবে স্বপ্নটা যে এত তাড়াতাড়ি বাস্তবের মাটিতে নেমে আসবে, তা বোধ হয় কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমী মানুষকে। পাকিস্তান-বধের বছরখানেক পর, ২০০০ সালের জুনেই আইসিসির পূর্ণ সদস্যপদ লাভের মাধ্যমে টেস্ট মর্যাদা পেয়েছিল বাংলাদেশ। যাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় স্বপ্নটা সম্ভব হয়েছিল, তিনি জগমোহন ডালমিয়া, বাংলাদেশের অকৃত্রিম ক্রিকেট-বন্ধু। তাঁর চিরবিদায়ে এ দেশের ক্রিকেট আজ শোকে স্তব্ধ।
মাড়োয়ারি পরিবারের সদস্য হলেও কলকাতায় জন্ম হওয়ায় বাংলা বলতেন মাতৃভাষার মতো। বাংলাদেশে এলেও অন্য ভাষায় নয়, বাংলা ভাষাতেই কথা বলতে ভালোবাসতেন। সে জন্যই কি বাংলাদেশের প্রতি বাড়তি মমতা ছিল ডালমিয়ার? তিনি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে না দিলে টেস্ট মর্যাদার পথ এত সহজ হতো না। ২০০০ সালের জুনে আইসিসির বার্ষিক সভায় বাংলাদেশের এই সম্মানপ্রাপ্তির পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান ছিল তাঁর।
১৯৯৮ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে ঢাকায় উইলস ইন্টারন্যাশনাল কাপ আয়োজনের নেপথ্যেও ডালমিয়ার বিশাল ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ‘মিনি বিশ্বকাপ’ নামে পরিচিতি পাওয়া সেই টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ প্রাণভরে উপভোগ করেছিল ক্রিকেট-তারকাদের লড়াই। সে সময়ের আইসিসি সভাপতি ডালমিয়ার সৌজন্যেই তা সম্ভব হয়েছিল।
ভারতীয় ক্রিকেটও তাঁর কাছে অশেষ ঋণী। ১৯৮৭ ও ১৯৯৬ সালে পাক-ভারত উপমহাদেশে বিশ্বকাপ আয়োজনের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন ডালমিয়া। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বেই ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই) আজ বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর ক্রিকেট বোর্ডের মর্যাদায় আসীন।
ক্রিকেটকে বিশ্বায়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কৃতিত্বও ডালমিয়ার। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকে ক্রিকেট যে কয়েকটি দলের খোলস থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে, সেটা কিন্তু তাঁরই দূরদৃষ্টির ফসল। তিনি সব সময় চাইতেন, ক্রিকেট যেন ফুটবলের মতোই জনপ্রিয়তা পায়। গোটা দুনিয়ায় না হোক, ক্রিকেট যে আজ আমাদের উপমহাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা, তার পেছনে ডালমিয়ার বিশাল অবদান।
গত মার্চে প্রায় ১০ বছর পর বিসিসিআই সভাপতির পদে ফিরেছিলেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে ক্রিকেট আরো সমৃদ্ধ হতে পারত, বাংলাদেশসহ ক্রিকেট-দুনিয়া আরো এগিয়ে যেতে পারত। কিন্তু তা আর হলো না। রোববার ৭৫ বছর বয়সে জীবনপ্রদীপ নিভে গেল ডালমিয়ার। তবে এই অনন্য ক্রিকেট-ব্যক্তিত্বকে আর যে-ই ভুলুক, বাংলাদেশ কখনো ভুলতে পারবে না। ক্রিকেট-বিশ্বে বাংলাদেশ যে আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, তার পেছনে যে ডালমিয়ার বিশাল অবদান।
এই অকৃত্রিম ক্রিকেট-বন্ধুকে বাংলাদেশ কখনো ভুলবে না।