ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে আসা নেপাল ভলিবল দল
বুকে লেখা ‘প্রে ফর নেপাল’ জার্সি সবার পরনে। সারা বিশ্বের কাছে তাঁরা প্রার্থনা করছেন নেপালের জন্য। গত ২৫ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পে হিমালয়কন্যা আজ ধ্বংসস্তূপে পরিণত। কোনোমতে সেই ধ্বংসস্তূপ পেরিয়ে, বুকে পাথর বেঁধে ঢাকায় এসেছে নেপাল ভলিবল দল। লক্ষ্য অলিম্পিকের মধ্য এশিয়া অঞ্চলের বাছাইপর্বে অংশগ্রহণ।
তবে নেপালের খেলোয়াড়রা ভুলতে পারছেন না দুঃসহ স্মৃতি। অবশ্য রোববার নিজেদের প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত জয় কিছুটা হলেও দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে তাদের। কিরগিজস্তানকে হারিয়ে অনেকদিন পর তারা আনন্দে মেতে উঠতে পেরেছে।
অথচ এই টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার কোনো আগ্রহই ছিল না নেপালিদের। এক মাস কেটে গেলেও ভূমিকম্পের তাণ্ডবে পুরো দেশ এখনো লণ্ডভণ্ড অবস্থার মধ্যে। গুঁড়িয়ে গেছে ক্রীড়া স্থাপনা, অনেক খেলোয়াড়ের মাথা গোঁজার ঠাঁইও। তাই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার প্রস্তাব পাওয়ার পর সরাসরি ‘না’ করে দেয় নেপাল ভলিবল অ্যাসোসিয়েশন। পরে অবশ্য বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের অনুরোধে তারা দল পাঠাতে রাজি হয়, বিমানভাড়া ও ঢাকায় থাকা-খাওয়া পাওয়ার শর্তে।
তবে প্রস্তুতি নিতে পেরেছে ১০ দিনের। তার মধ্যে আবাসিক ক্যাম্প ছিল মাত্র তিনদিনের। অনুশীলন মাঠ ও জিমনেসিয়াম সব কিছুই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। তাই প্রস্তুতি তেমন ভালো হয়নি। নেপালের দলটির বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই সার্ভিসেস দলের। যাঁদের ভূমিকম্পের পর উদ্ধারকাজে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে।
কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে যাওয়ায় অধিনায়ক ইম বাহাদুর নিজেকে ভাগ্যবান মনে করেন। সেই ভয়াবহ ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে এখনো ভয়ে কেঁপে ওঠেন তিনি, ‘ভূমিকম্পের সময় কাঠমান্ডুতে নিজের ঘরে ছিলাম আমি। দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছি। আমাদের পরিবারের কয়েকজন সামান্য আহত হলেও কেউ মারা যায়নি। এটাই যা আমার কাছে সান্ত্বনার। তবে উদ্ধারকাজের সময় ভয়াবহ দৃশ্যগুলো আজও তাড়িয়ে বেড়ায় আমাকে। কত লাশ যে নিজের হাতে তুলেছি তার হিসাব নেই। সে কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে।’ ভূমিকম্পে নেপাল অধিনায়কের কম ক্ষতি হয়নি। কাঠমান্ডুতে তাঁদের বাড়ি একেবারে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।
নেপাল দলের অবশ্য তার চেয়েও বেশি ক্ষতি হয়েছে। ২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পে মারা গেছেন সহকারী কোচ কেশবলাল শ্রেষ্ঠা। যে মৃত্যু কিছুতেই কেউ মেনে নিতে পারছেন না। কেশবলালের কথা বলতে গিয়ে কোচ কিশোর শ্রেষ্ঠার চোখ ভরে গেছে জলে, ‘কেশব শুধু আমার সহকারী ছিল না, ঘনিষ্ঠ বন্ধুও ছিল। তার মৃত্যু আমার জীবনের বিশাল বেদনাদায়ক ঘটনা। তার মতো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। বেঁচে থাকলে এই টুর্নামেন্টে সে আমাদের সঙ্গেই থাকত। তার মতো বহু মানুষের মৃত্যুতে আমরা শোকাহত।’
কেশবলালের করুণ মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না নেপালের সহকারী অধিনায়ক সঞ্জয় আরিয়ালও, ‘আমি ভাবতেই পারছি না কেশবদা আর আমাদের মাঝে নেই। এই টুর্নামেন্ট নিয়ে তাঁর কত স্বপ্ন ছিল! আমাদের সঙ্গে তিনিও ঢাকায় আসতেন। কিন্তু আজ তাঁকে ছাড়াই আমাদের আসতে হয়েছে।’
নেপাল ভলিবল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিতেন্দ্র বাহাদুরও দলের সঙ্গে ঢাকায় এসেছেন। তিনি জানালেন, ‘ভূমিকম্পে নেপালে যে কী বিশাল ক্ষতি হয়েছে তা কল্পনা করাও কঠিন। সব কিছু একেবারে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক দিন লাগবে আমাদের। বেশির ভাগ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা একদম ধ্বংস হয়ে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনেও। ঢাকায় আসার একদমই ইচ্ছা ছিল না। বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের অনুরোধে আমরা এসেছি। আসলে সুসম্পর্কের জন্যই আমাদের এখানে আসতে হয়েছে।’