নারী ফুটবলে হাহাকার, নিশ্চুপ বাফুফে
সুখের সাগরে ভেসে যখন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল স্বপ্ন দেখছিল উড়ে বেড়ানোর, তখন কে যেন কেটে দিল ঘুড়ির সুতো। সাফজয়ী যে নারীদের নিয়ে আনন্দের জোয়ারে ভাসছিল দেশের ফুটবল, সেখানে এখন শুধুই হাহাকার।
বাংলাদেশের নারী ফুটবলটা ভালোই যাচ্ছিল। এক সপ্তাহ আগেও যে মেয়েদের দেখা গিয়েছিল চনমনে, সপ্তাহের ব্যবধানে চেহারায় ক্লান্তি। কী যেন হারানোর ভয়!
কদিন আগে এসে ঘুরে গেলেন বিদেশি দুই কোচ। নারী ফুটবলারদের প্রশিক্ষণ দিতে বাংলাদেশ সফরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন কোচ। তবু হঠাৎ করেই সেই দিনগুলো হয়ে গেল সোনালি অতীত।
সাফজয়ী বাংলাদেশের নারীদের ট্রেনিং করাতে এসে বেশ সন্তুষ্ট দেখা গিয়েছিল কোচদের। দুই দেশের উদ্যোগে বাংলাদেশের মেয়েদের সুযোগ আছে বৃত্তি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার। তাহলে কিসের এত দুঃখ, অভিমান নিয়ে একে একে সরে যাচ্ছে মেয়েরা। যে কোচ বটবৃক্ষ হয়ে আগলে রেখেছিলেন মেয়েদের, সেই গোলাম রব্বানী ছোটন করে বসলেন পদত্যাগ।
সিরাত জাহান স্বপ্না, অনুচিং মগিনি, সাজেদা খাতুনরা অবসর নিলেন। আঁখি খাতুন ক্যাম্প ছেড়ে দিলেন। মায়ের অসুস্থতার কথা বলে বাফুফে থেকে চলে গেলেও মূল কারণ তিনি চায়না যাবেন খেলতে। নিজেই করেছেন নিজের ব্যবস্থা। কারণ, এর আগে ভারতসহ একাধিক দেশের লিগে খেলার সুযোগ পেলেও কেন, কী কারণে বাফুফে তাকে যেতে দেয়নি, তিনি জানেন না। এমনকি দেশে থেকে যাওয়াতে যে খুব বেশি টাকা দেবে এমনটিও নয়।
২০২২ সালের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে দেশকে দক্ষিণ এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের গৌরব এনে দিয়েছিলেন মেয়েরা। বয়ে এনেছিলেন স্বর্ণালি সাফল্য। ইউরোপিয়ানদের মতো ছাদখোলা বাসে সম্মাননা পাওয়ার মতো বিশেষ কিছু তো দেশকে এর আগে কেউ এনে দিতে পারেননি। তাহলে মাত্র আট মাসের ব্যবধানে কী এমন হলো ফুটবলে, প্রশ্নটা উঁকি মারবেই মনের গহীনে।
শিরোপাজয়ী দলকে যেখানে আরও বেশি করে ম্যাচ খেলার ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিৎ, সেখানে মেয়েরা খেলার সুযোগ পাচ্ছে খুব কম। রয়েছে বেতন বকেয়া। মাসে ১০ হাজার টাকা করে পায় বাফুফের তালিকাভুক্ত নারী ফুটবলাররা। সেটিও পাচ্ছেন না ঠিকমতো। ব্যাপারটা এমন, অবহেলায় ওলট-পালট হয়ে গেছে দলটি। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও কোচ ছোটন এই মেয়েদের নিয়ে লড়ে গেছেন।
ভারতের একটি চলচ্চিত্র আছে— ‘চাক দে ইন্ডিয়া।’ সেই সিনেমায় নারী হকি দলের কোচ কবির খানের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন শাহরুখ খান। যিনি সাদামাটা এক দল নিয়ে হকির বিশ্বসেরা হন। এখানেও একজন কবির খান আছেন। বাংলাদেশের কোচ গোলাম রব্বানী ছোটন কি মেয়েদের দেখিয়েছিলেন সেই সিনেমাটা? ছেলেদের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই সেখানে খেলেছিল মেয়েদের হকি দল, এখানে মুখোমুখি না হলেও ছেলেদের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে বাংলার মেয়েরা।
জীবন কখনও কখনও সিনেমাকেও হার মানায়। এই মেয়েদের দেখে যেখানে আর দশটা মেয়ে ফুটবলে এগিয়ে আসবে বলে এক কদম পা ফেলেছে, তখনই এমন অবসর আর চলে যাওয়ার মিছিলে নিশ্চয়ই তিন কদম পিছিয়েছেন তারা! দায়টা আসলে কার?
বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাজটা আসলে কী? বাফুফেকে নিয়ে সর্বশেষ দুটো আলোচনাই নেতিবাচক। একটি দুর্নীতির দায়ে ফিফা থেকে বহিষ্কৃত সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগ, আরেকটি সভাপতি কাজী সালাউদ্দীনের সাংবাদিকদের পবিবার নিয়ে গালি দেওয়া।
বাংলাদেশ ক্রীড়ালেখক সমিতির পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান ছিল গতকাল রোববার (২৮ মে)। সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর বাফুফের বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। বিশেষত, ২০২২ সালের সাফজয়ী নারী ফুটবল দলের কোচ ও একাধিক খেলোয়াড়ের অবসরে যাওয়াকে ‘দুঃখজনক’ বলেছেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী বলেন, “কোচ চলে যাচ্ছেন, খেলোয়াড়রা থাকছেন না। ফেডারেশনের আন্তরিকতার অভাব আছে। বাফুফের উচিত বিষয়গুলোতে আরও গুরুত্ব দেওয়া।”
এদিকে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দীনের সঙ্গে বৈঠক করেছেন নারী ফুটবলাররা। কয়েক দফা দাবি ছিল তাদের। যার মধ্যে সবার আগে প্রিয় কোচ ছোটনকে ফেরানো, বকেয়া বেতন দ্রুত মিটিয়ে দেওয়া, সাফজয়ী নারীদের বেতন বৃদ্ধিসহ সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি ছিল, সেটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ— বেশি বেশি খেলার আয়োজন করা।
এসব বিষয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে বাংলাদেশ নারী দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুনের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। আরেক সদস্য সানজিদা আক্তারকে একাধিকবার কল দিলেও তা তোলেননি তিনি। হয়তো কোনো সদুত্তর নেই বলেই।
সালাউদ্দীন সেসব শুনেছেন, মেয়েদের চলে যাওয়াটাকে তার কাছে স্বাভাবিক বলেই মনে হয়েছে। এত বছর ধরে ফুটবল প্রধানের গন্ডিতে থেকে ফুটবলকে অধঃপতনে নিয়ে যাওয়া অস্বাভাবিক কাণ্ড ঘটানো সভাপতির কাছে এসব স্বাভাবিক লাগতেই পারে। কিন্তু দেশের ফুটবলে মেয়েরা সামনের দিনগুলোতে যে বিশাল স্বর্ণালি সময় আনতে পারতো, একটু পরিচর্যায় যে চারাগাছ হতে পারতো বৃক্ষসম, তার অপমৃত্যু ঘটছে চোখের সামনেই।