‘সাজানো হত্যাকাণ্ডে’র খেলা চীনের তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে
চীনের শহরগুলোতে তরুণেরা নতুন এক ধরনের খেলা খেলতে ক্লাবগুলোতে ভিড় করছে। যা শুরু হয় ‘স্ক্রিপ্টেড হোমিসাইড’ বা ‘সাজানো হত্যাকাণ্ড’-কে ঘিরে। আর, ওই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনে তারা দলবদ্ধ হয়ে অনুসন্ধান করে এবং হত্যাকারী শনাক্ত করে। সম্পূর্ণ নতুন ধাঁচের এ খেলা থেকে এ বছর প্রায় ২০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি উপার্জন হবে বলে আশা করছেন ক্লাব মালিকেরা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
খেলাটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা চীনের নীতিনির্ধারকদের কপালে চিন্তার বলিরেখা ফেলে দিয়েছে। কারণ, এ খেলা তরুণদের মনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। তা ছাড়া খেলাটির জন্য যে স্ক্রিপ্ট লাগে তা নিয়েও শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা।
চীনের সাংহাইয়ের যুবক ঝাং ই (২৮) বলেন, ‘ভালো স্ক্রিপ্টের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু, কোনোভাবেই পর্যাপ্ত ভালো স্ক্রিপ্ট খুঁজে পাওয়া যায় না। স্ক্রিপ্টই হলো এই খেলার মূল। একটি সফল, নাটকীয় চিত্রনাট্যে হত্যাকাণ্ড, উত্তেজনা, হাসি, এমনকি কান্নাও থাকে। যারা খেলায় অংশ নেয়, তাদের সত্যিকারে কাঁদতে হয়। কারণ, সেখানে তেমন বাস্তবতা ফুটিয়ে তোলা হয়। আর, ভালো স্ক্রিপ্ট না হলে খেলোয়াড়েরা ভালো পারফর্ম করতে পারে না। ফলে সেখানে স্ক্রিপ্টই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসর্গ।’
বেইজিংয়ের একটি ক্লাব ঘুরে দেখে যায়, সেখানকার খেলোয়াড়েরা পরী ও ড্রাগনের সাজে সজ্জিত হচ্ছেন। কারণ, তাদের স্ক্রিপ্টে চরিত্রগুলোকে সেভাবেই সাজানো হয়েছে। একটি দলে অনেক খেলোয়াড়। সবাইকে সবার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হলো। আর গোপনে একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তাদের মধ্যে একজনকে হত্যা করতে। আর বাকিদের কাজ হলো সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে প্রকৃত হত্যাকারীকে বের করা। যাদের সঙ্গে নিয়ে অনুসন্ধান চালানো হবে, হত্যাকারীও তাদের মধ্যে থাকায় খেলাটি দারুণ উন্মাদনা তৈরি করে। ফলে তরুণেরা খেলাটির প্রতি দারুণভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে।
চীনা গবেষকেরা জানান, দেশটির ১০০ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বেশির ভাগ সময় তাদের ফোনেই ব্যয় করে থাকে। অতিরিক্ত এই স্ক্রিন টাইমের ফলে সরকার ও বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে সরকারের বেশি উদ্বেগের কারণে তাদের জন্য ভিডিও গেমের সময়সীমাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
ফলে, এমন বাস্তবতায় নতুন এই খেলাটি স্ক্রিন আসক্তি কমাতে সহায়তা করতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এর সমর্থনে দ্য চাইনিজ ইউনিভার্সিটি অব হংকং-এর স্কুল অব জার্নালিজম অ্যান্ড কমিউনিকেশনের সহকারী অধ্যাপক কে চেং ফ্যাং বলেন, ‘খেলাগুলো তরুণদের জন্য অন্যের সঙ্গে মিশে যাওয়ার একটা সুযোগ তৈরি করে দেয়। অথচ চীনে তা বিরল। খেলাটি তরুণদের মধ্যে একটি অংশগ্রহণমূলক অভিজ্ঞতা ও সামাজিকীকরণের একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করছে। অথচ গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়টি চীনের যুবকদের জীবনে একেবারেই অনুপস্থিত।’
খেলাটিতে অংশগ্রহণকারী একজন তরুণী মুন জা ইয়েং জানান, তিনি একটা সময় একাকিত্বে ভুগতেন। কিন্তু নতুন এই খেলাটিতে অংশগ্রহণ করে তিনি নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে মিশছেন। সমস্যা সমাধানে তাদের সহযোগিতা করছেন, নিজেও পাচ্ছেন৷ ফলে তার একাকিত্ব দূর হয়ে পরিচিত অনেক নতুন বন্ধুও পেয়ে গেছেন তিনি। ইয়েং বলেন, ‘আমি এমনও লোকদের সঙ্গ পেয়েছি, যাদের সঙ্গে পুরো সপ্তাহ কাটিয়ে দিয়েছি। এখন আমরা প্রতি সপ্তাহে দেখা করি। এটি আমার জীবনকে সুন্দর ও উপভোগ্য করে তুলেছে। এখন আর আমি একাকিত্বে ভুগি না!’
এদিকে, চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বার্তা সংস্থা সিনহুয়া জানিয়েছে, সব স্ক্রিপ্ট বাস্তবতার নিরিখে তৈরি হয় না। কিছু স্ক্রিপ্টে বেআইনি ও রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও বর্বরতার মতো বিষয়গুলোও থাকে। যেগুলো অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তরুণেরা বিপথে যেতে পারে।
চীনের সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম উইবোতে একটি পোস্টে সিনহুয়া বলেছে যে, স্ক্রিপ্টগুলোকে অবশ্যই সংশোধিত হতে হবে৷ ইতিবাচক বার্তা সম্বলিত কোনো স্ক্রিপ্ট ছাড়া কেউ সেন্সরশিপ পার হতে পারবে না। এর ধারাবাহিকতায় দেশটির প্রশাসন সম্প্রতি ১৬টি স্ক্রিপ্ট বাজেয়াপ্ত করেছে।
তবে অনেকেরই অভিযোগ—শাসকদের অন্যায়ের ফিরিস্তি দেওয়ায় অনেক স্ক্রিপ্ট বাজেয়াপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। কারণ, চীনের কমিউনিস্ট সরকার কোনোভাবেই চায় না, তাদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড নিয়ে কেউ কথা বলুক কিংবা সেগুলো নিয়ে কথা বলার অধিকার চর্চা করুক। তবে চীন সরকারের যুক্তি, যেহেতু খেলার স্ক্রিপ্ট ছবি ও চলচিত্রের মতোই, তাই সেখানে নৈতিক মান নিশ্চিতে সেন্সরশিপ আরোপ বৈধ।
তবে, কর্তৃত্ববাদী যেকোনো সরকারের জন্যই এই ধরনের অভিযান নতুন কিছু নয় উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস স্টেট ইউনিভার্সিটির ধর্মীয় গবেষণার সহযোগী অধ্যাপক জোসেফ লেকক বলেন, “খেলাটির সঙ্গে কল্পনা জড়িত। বিতর্কিত ইস্যুতে আপনি কল্পনা করতে পারলে বা তার চর্চা শুরু হলে তা শাসকের জন্য হুমকিস্বরূপ। আর তাই চীনা প্রশাসনের এই সেন্সরশিপ আরোপ। তা না হলে চীনের তরুণেরা প্রশ্ন করে ফেলবে—‘বাক্স্বাধীনতা প্রশ্নে বিশ্ব কোথায়, আর আমরা কোথায়?’”