উপন্যাস পর্ব ১০
বাবা আছে, বাবা নেই
দুই মাসের কাছাকাছি সামিয়াদের বাসায় গিয়ে পড়ালাম। দিন দিন তলপেট ভারী হয়ে আসছে। তাই যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। কয়দিন ধরে ওরা এ বাসায় এসে পড়ছে। তুষার বিষয়টা জেনেছে। তার আচরণেই সেটা বোঝা গেল। গত দুই মাসে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। দরজা খুলে দিয়েছে। কিন্তু তেমন কোনো কথা হয়নি। কেমন আছি। কী অবস্থা। এই যা। আমাকে নিয়ে তুষারের উৎসাহ-উদ্দীপনা, অনুভূতি সবকিছুই ভাটা পড়ে গেছে। সংবাদটা শুনে বেচারা নিশ্চয় হোঁচট খেয়েছে।
ভালোই হয়েছে।
বাস্তবতা বড়ই নিষ্ঠুর। কখনোই জীবনকে ষোলোআনা ইচ্ছামতো সাজানো যায় না। তুষারের জন্য আমার কষ্ট হচ্ছে। প্রাকৃতিকভাবে হোক আর হৃদয় থেকে হোক, তুষারের মনে যে ভালোবাসার বীজটি জেগে উঠেছিল, তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। সে তো বলেছিল, সে অনেক বাস্তববাদী। তাহলে কি বাস্তববাদী মানুষদেরই বেশি হোঁচট খেতে হয়। জানি না, নিয়তি ভালো জানে।
দেখতে দেখতে মার্চ-এপ্রিলও পেরিয়ে গেল, মে মাস ঢুকল। ডাক্তার মে মাসের প্রথম সপ্তাহ ডেলিভারির ডেট দিয়েছিল। সে মতেই আমার শারীরিক অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে। কখনো কখনো খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছি।
আমাকে নিয়ে খালাম্মা, টিনা, কাকা সবার ভোগান্তি। প্রথমবারের মতো মাতৃসদনে এলাম। টিনাও আমাদের সঙ্গে এসেছে। বিশাল একটি ওয়ার্ড। ২০-২৫টি বেড থরেথরে সাজানো। তেমন একটা খালি নেই। মাঝখানে দু-একটা খালি থাকলেও সেগুলোতে রোগীদের আত্মীয়স্বজনই দখল করে নিয়েছে।
জানালার পাশে একটি বেডে এনে আমাকে রাখল। এক কোনায় কাপড় আর ছোট্ট কাঁথার ব্যাগ দুটো স্তূপ করা।
কয়েকটা বেডে মায়েরা সদ্য জন্ম নেওয়া শিশু নিয়ে শুয়ে আছেন। এক-দুদিনের শিশুও আছে, যারা তেমন নড়াচড়া করতে পারছে না। তাদের আত্মীয়স্বজনই পরিবারে নতুন সদস্য পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। তলপেটের ব্যথাটা ধীরে ধীরে কমছে।
ডাক্তারের চেম্বারে গিয়ে খালাম্মাসহ ডাক্তার দেখিয়েছি। টিনা বেডেই বসেছিল। ডাক্তার বলেছে, ব্যথা বাড়লে লেবার রুমে নিয়ে যেতে হবে।
লেবার রুম শুনে চমকে উঠলাম। লেবার রুমে তো শ্রমিকরা থাকবার কথা। আমি কেন সেখানে যাব? মুখ ফসকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলাম না। খালাম্মা আমাকে হাত ধরে বেডে নিয়ে এলো। প্রথমে ভেবেছিলাম, এত বড় একটা পেট নিয়ে হাসপাতালের করিডরে হাঁটতে বেশ লজ্জা পাবো। কিন্তু এখানে এসে দেখি, ব্যাপারটা একেবারেই স্বাভাবিক। আমার মতো অনেকেই ডেলিভারির অপেক্ষায় আছে, যারা বড় বড় পেট নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে।
বেডে ফিরে দেখলাম, টিনা বিমর্ষ মনে বসে আছে। আমাকে টিনার কাছে রেখে খালাম্মা বাথরুমের দিকে গেল। দ্যাখো দ্যাখো, ওই বাবুটা খুব সুন্দর। তাই না? দেয়ালের পাশে একটি বেড লক্ষ করে বলল টিনা।
বললাম, হ্যাঁ।
টিনার চেহারাটা চুপসে গেল। বুঝতে পারলাম, টিনা কেন বিমর্ষ হয়ে বসে আছে। ওর খুব আশা ছিল, নিজের ফুটফুটে সুন্দর একটা বাবু থাকবে। রাতদুপুরে বাবুকে নিয়ে খেলবে। রংবেরঙের জামা পরাবে। মেয়ে হলে এটা পরাবে। ছেলে হলে ওটা পরাবে। কোলে, কাঁধে নিয়ে হাঁটবে। নরম তুলতুলে গাল ধরবে। কচি কচি হাত-পাগুলো টানবে। হামাগুড়ি দিলে ওরা পিছু পিছু দৌড়াবে। আরো কত স্বপ্ন, কত আশায় বুক বেঁধেছিল টিনা। কিন্তু সে সব আশাই গুড়ে বালি হয়ে গেল। ডেলিভারির সময় বাচ্চাটা মারা গিয়েছিল।
টিনা বাবুটির দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ধ্যানে মগ্ন।
টিনা। ডাকলাম।
টিনা। দ্বিতীয়বারও শুনল না।
অ্যাই টিনা।
সম্বিত ফিরে পেল।
হুঁ।
আমার বাবু হলে সেটা তোমাকে দিয়ে দেব। তোমার সব স্বাদ-আল্লাদ ওই বাবুকে নিয়ে করো। বললাম আমি।
তোমার বাবু আমাকে মা ডাকবে? হঠাৎ করেই প্রশ্নটি করল টিনা।
আমি বাকহীন। কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
নিজ সন্তানের মুখে মা ডাক শোনা কত যে মধুর, তা একমাত্র মা-ই উপলব্ধি করতে পারবে। নারীর জীবনের পূর্ণতা মা হয়ে।
মা হতে গিয়েও হতে পারল না টিনা। তাই তার মনে খুব দুঃখ। বেদনায় ভরে আছে মন।
খালাম্মা ও টিনা বাসায় ফিরে গেল। দুপুরের খাবার নিয়ে আসবে খালাম্মা। বেডে শুলাম, চিৎ হয়ে। বর্ধিত পেটটা উঁচু টিবির মতো মনে হচ্ছে। জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা। তাই সবকিছুই নতুন এবং অন্য রকম মনে হচ্ছে।
মাকে খুব মনে পড়ছে। এ সময়ে মা থাকলে আমার পাশ থেকে নড়তই না। দেখভাল সবকিছু মা-ই করত। খাইয়ে দিত। ঘুম পাড়াত।
আর বাকিউল হারামজাদা যদি জানত আমি মা হচ্ছি। তাহলে? সে কি ছুটে আসত? হয়তো আসতো। হয়তো বা আসত না। এমনও হতে পারে, সে বাচ্চাই নষ্ট করে ফেলতে বাধ্য করত। এত দিনে হয়তো অন্য মেয়ের পিছু নিয়ে আমাকে সে রাস্তায় ছুড়ে ফেলত। যেমন ফেলেছে আরো অনেক মেয়েকে। যারা লম্পট, যাদের চরিত্র মেয়েদের জীবন নষ্ট করা, তারা কখনোই আত্মতৃপ্তি পেতে পারে না। নিরীহ মেয়েদের অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে না বাকিউল। জীবনের একটি সময় এসে যখন যৌবনের জোয়ার কমে যাবে, বার্ধক্যের পরশ গায়ে হাত বোলাবে, তখন ডাস্টবিনের কীটের মতো আবর্জনা খেয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
বাকিউলের মতো অসভ্যকে নিয়ে ভাবতে ভালো লাগছে না। ঘুম পাচ্ছে। সদ্য প্রসূত বাচ্চাদের কান্নায় ঘুম আসবে না। তারপরও ঘুমানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছি।
রাত তিনটে। তলপেটের ব্যথা বাড়ছে। খালাম্মা বেডের নিচে চাদর বিছিয়ে শুয়ে আছে। ব্যথা সহ্য করার চেষ্টা করছি। জিবে দাঁত খিচে হাত-পা নাড়াচাড়া করছি। ব্যথা কমার কোনো লক্ষণ নেই। বেড়েই চলেছে। ওয়ার্ডের কোনার দিকের বিছানাটায় বাবু কান্না করছে। মা বাবুটিকে দুধ পান করাতে ব্যস্ত। বাচ্চাটিকে দুধে মুখ দিয়ে আবার ফিরিয়ে নিচ্ছে। মনে হয় দুধ পাচ্ছে না। বাবুর কান্না থামাতে মা অনেক চেষ্টা করছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।
এদিকে আমার ব্যথাও কমছে না।
খালাম্মা। খালাম্মা। ডাকলাম কবার। খালাম্মা আড়মোড়া দিয়ে ঘুমোলেন। ঝিম ধরে আরো কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলাম। চারদিকে বেশ নীরবতা। কিন্তু নীরবতা বেশি সময় স্থায়ী থাকে না।
কোনো বেডে বাচ্চা চিৎকার দিয়ে কান্না করে উঠছে আর কোনো বেডে প্রসব বেদনায় অস্থির মেয়েদের আহাজারি। আমার ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে। নিশ্চয় সন্তান প্রসব অনেক কষ্টের। শুনেছি অনেকের পেট কাটতে হয়। টিনারও তো পেট কেটেছে। তার পরও শেষ রক্ষা হয়নি।
প্রসব বেদনা বেড়ে গেলে রোগীকে সোজা লেবার রুমে নিয়ে যায়। রাত ২টার দিকে দুজনকে নিয়ে গেছে। তাদের কী অবস্থা, জানি না। এখনো ফিরে আসেনি। তাদের সঙ্গের লোকজন নিশ্চয় বাইরে অপেক্ষা করছে।
আমার তলপেটে ব্যথা তীব্রতর হচ্ছে। অসহনীয় হয়ে পড়ছে। খালাম্মাকে ডাকলাম।
ঘুম জড়ানো চোখে উঠে বসল। কী? ব্যথা বেড়েছে? বলল খালাম্মা।
হুঁ।
তাহলে চলো। ব্যথা বাড়লে ডাক্তার লেবার রুমে নিয়ে যেতে বলেছে।
বিছানা থেকে নামতেও কষ্ট হচ্ছে। পেটটা যেন আরো ফুলেফেঁপে উঠেছে।
নেমে খালাম্মার কাঁধে ভর করে দাঁড়ালাম। তারপরও পড়ে যাব যাব মনে হচ্ছে। পাশের বেডের এক মহিলা এসে ধরল। আমাকে লেবার রুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। পা যেন সামনে এগোতেই পারছি না। ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। ওটুকু পথ যেতে দু-তিনবার বসে পড়লাম। খালাম্মা আর পাশের বেডের মহিলা আমাকে লেবার রুমের সামনে নিয়ে এলো।
আমার আগে যে দুজনকে লেবার রুমে নিয়ে এসেছিল, তাদের আত্মীয়স্বজন দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভেতর থেকে দুজন নার্স এসে আমার হাত ধরল। খালাম্মা আর মহিলা বাইরে দাঁড়ানো।
নার্সরা আমার দুই বাহুতে ধরে একটি ঘরে নিয়ে এলো। ঘরটি বড়। চারটি বেড। চার বেডে চারজন শুয়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। আমাদের ওয়ার্ডে থেকে যে দুজনকে নিয়ে এসেছিল, তারাও দুই বেডে শুয়ে আছে। ব্যথায় চিৎকার করছে। আর কেউ গোঙাচ্ছে। তারপরও ডাক্তার-নার্সদের হুশ নেই। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
নার্স আমাকে একটি মেয়ের পাশে শুয়ে দিল। ব্যথায় সে নিজেই কাতরাচ্ছে। আমি শোয়াতে সে আর নড়াচড়া করতে পারছে না। দুজনের কেউ এপাশ-ওপাশ করতে পারছি না, কিছুক্ষণ পর আরো একজনকে নিয়ে এলো নার্সরা। তাকেও অন্য বিছানায় আর একজনের সঙ্গে শুইয়ে দিল। লেবার রুমের বেডে অতি বেদনায় সবাই অস্থির। কেউ চিৎকার করছে, আর কেউ হুঁ হা মাগো আল্লাহ গো বলে চিৎকার করছে। ক্ষাণিক পর একজন নার্স এসে আমার কোমরে একটা ইনজেকশন ঢুকিয়ে দিল। পরক্ষণই তলপেটের ব্যথা কয়েকগুণ বেড়ে গেল। এপাশ-ওপাশও করতে পারছি না। ঘেমে পরনের কাপড় ভিজে গেল। পাশের মেয়েটির ব্যথা মনে হয় কমেছে। সে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। আমি ব্যথায় বেডের রড, বালিশ খামছে ধরছি। এই বুঝি প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। অন্য বেডের মেয়েরা ব্যথায় গোঙাচ্ছে। এখানে কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুরসত নেই। জ্ঞান নেই। নার্সরা আসছে। যাচ্ছে। তাদের সেদিকে কর্ণপাত নেই।
ব্যথায় যেন আমি জ্ঞান হারালাম। মাথার ওপরে পাখা ঘুরছে। তারই সঙ্গে যেন ঘুরছে বেড। দেয়াল। নার্স। সবই। দুজন নার্স এসে আমাকে হাত ধরে নামাল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে আমাকে নিয়ে গেল পাশের ঘরে। এ ঘরেই ডেলিভারি হয়। দুদিকে দুটি বেড পর্দা সাঁটানো। সেখান থেকে চিৎকার আসছে। নার্সদের ছোটাছুটি হচ্ছে। ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। ওরা আমাকে একটি বেডে শুইয়ে দিল। ব্যথায় হাত-পা ছোড়াছুড়ি করছি। দুজন আয়া এসে আমার হাত-পা চেপে ধরেছে। এই বুঝি আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে। মাকে ডাকছি। আল্লাহকে ডাকছি। কেউ বুঝি কাছে নেই। কেউ সাড়া দিচ্ছে না।
দোয়া পড় মা। দোয়া পড়। একজন আয়া বলল।
দোয়া। কোনো দোয়াই তো মুখে আসছে না।
পরনের কাপড় অবিন্যস্ত। বেশ কষ্ট হচ্ছে। তলপেটে নাড়চড়া বাড়ছে। কিছু একটা যেন দেহ থেকে বেরিয়ে যেতে চাইছে। যুদ্ধ চলছে দেহের ভেতর। যে যুদ্ধ বোঝানোর কোনো ভাষা নেই। স্বাভাবিক হতে বেশ কিছু সময় লাগল। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন দেখি বেডের পাশে একজন আয়া আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। স্যালাইন চলছে।
(চলবে)