জীবন তো কবিতা নয়, কবিতা করে তুলতে হয় : রফিক আজাদ
বাংলা ভাষার প্রথম সারির কবিগণের মধ্যে রফিক আজাদ অন্যতম। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্যে বহু উচ্চারিত এই নাম। সেই সত্তরের দশক থেকে নিবিষ্ট হয়ে আছেন কবিতায়। অসম্ভবের পায়ে, সীমাবদ্ধ জলে, সশস্ত্র সুন্দর, হাতুড়ির নিচে জীবন, বর্ষণে আনন্দে যাও মানুষের কাছে, মৌলবীর মন ভালো নেইসহ অসংখ্য কাব্যের রচয়িতা তিনি। তাঁর কবিতা বিভিন্ন সময় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের চিত্তে দোলা দিয়েছে। প্রেম-বিরহে, আনন্দ-বিষাদে, শান্তি-বিপ্লবে এবং ভাবে তাঁর কবিতা বার বার এ দেশের মানুষের সামনে এসেছে। ‘ভাত দে হারামজাদা, নয় মানচিত্র খাবো’ তাঁর কবিতার বহু বিশ্রুত পঙ্ক্তি। ধানমণ্ডির বাসভবনে বসে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে কবিতা, কথাসাহিত্য, রাজনীতি, বিশ্বায়ন, যুদ্ধ, পরিবেশ, প্রকৃতি, প্রেম, জীবন ও মৃত্যু-ভাবনাসহ নানা প্রসঙ্গে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ মতামত ব্যক্ত করেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত নোমান
প্রশ্ন : আপনার আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘কোনো খেদ নেই’ প্রথম খণ্ডটি আমরা পেলাম। এর দ্বিতীয় খণ্ডটি লিখছেন না যে?
রফিক আজাদ : আসলে ‘কোনো খেদ নেই’ লেখার কোনো পরিকল্পনাই আমার ছিল না। এর শুরুটা হয়েছিল অনন্যা পত্রিকার মাধ্যমে। আমার খুব প্রিয় একজন নাট্যকর্মী ওখানে কাজ করত। তার তাগাদা বলি, কি প্ররোচনায় বলি, আমি এটা শুরু করি। সত্যিকারার্থে সে-ই তাগিদ দিয়ে এটা লিখিয়েছে এবং কখনো কখনো সে আমার কাছ থেকে শুনে অনুলিখনও করে নিয়েছে। এভাবেই বইটির কাজ শুরু হয়। প্রথমে সেটা ছিল আড্ডার ওপরে একটি লেখা, কিন্তু পরে সেটা এতটাই বড় হয়ে যায় যে তখন একজন বলল, এটাকে যেন আমি আত্মজীবনীতে রূপান্তরিত করে ফেলি বা করতে পারি। তখন আমার অনুজ কবি ফারুক মাহমুদ, তারই তাগাদায় আবার লেখা শুরু করি।
প্রশ্ন : বলছিলাম যে, ওই বইটিতে আপনি শৈশব থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ পর্যন্ত সময়টাকে তুলে এনেছেন, এর পরের জীবন নিয়ে না লেখার কথা বলছি।
রফিক আজাদ : হ্যাঁ, ‘কোনো খেদ নেই’-এর প্রথম খণ্ডটিতে ওসব ছাপা হয়ে গেছে। অর্থাৎ শৈশব-কৈশোর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ পর্যন্ত। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ডটি লেখার কথা ভাবছি না যে তা নয়। ভাবছি। কারণ, আমি বোধ করেছি যে, ছাত্রজীবন এবং তার পর কর্মক্ষেত্র নিয়ে মোট তিনটি খণ্ডের আত্মজীবনী হতে পারে। বিশেষ করে ষাটের পুরো দশক নিয়ে একটা খণ্ড । আমি মনে করি, ১৯৬০-এর দশকটা পুরো পৃথিবীর জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে সারা বিশ্বময় তারুণ্যের উত্থান ঘটে। মুরুব্বিশাসিত যে কনজারভেটিভ জগৎ ছিল, সেটা ভেঙে পড়ে সেই সময়টাতে। ভেঙে পড়ে তরুণদের কারণেই। তরুণদের বিপুল পরিমাণে উত্থান ঘটে তখন। ‘প্যারিস সম্মেলনে’র যে বীজ, জাঁ পল সার্ত্র সব সময় তরুণদের পক্ষে ছিলেন, তাদের পক্ষে থেকে নতুন চিন্তার পক্ষে বীজটা তিনি প্যারিসের রাস্তায় রাস্তায় বিক্রি করেছেন। এটাও অনুপ্রেরণার একটা উৎস ছিল। সেই দশকটা আমাদের দেশের জন্যও খুব মূল্যবান ছিল। ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ’৬৯-এর গণআন্দোলন পর্যন্ত যে ব্যাপ্তি, ওটা অসাধারণ একটি সাফল্যের ব্যাপার, অনেক ত্যাগের, অনেক রক্তের ঘটনা সেইসব। এই সময়টা নিয়ে একটা পুরো খণ্ড রচনা করার ইচ্ছে আছে আমার এবং সেটার জন্য কিছু লাইব্রেরি ওয়ার্কের প্রয়োজন আছে। শুধু স্মৃতি থেকে লেখাটা ঠিক হবে না। স্মৃতি থেকে লিখতে গেলে, বিশেষ করে তারিখগুলো ভুল হয়ে যায়। কিন্তু সেই লাইব্রেরিওয়ার্ক করাটা আমার পক্ষে হয়ে উঠছে না। কারণ, বেঁচে থাকার জন্য আমাকে একটা চাকরি করতে হচ্ছে। যতদিন বেঁচে আছি, ততদিন সেটা করতে হবে। যা-ই হোক, তবুও দ্বিতীয় খণ্ডটি আমি অবসরের মধ্যে লিখব বলে ভাবছি। কাজেই লিখব না বা লেখা হয়নি, এটা বলা যায় না। আমারই কারণে লেখা হয়নি বা হচ্ছে না।
প্রশ্ন : আপনি নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন। জীবনের এই পড়ন্ত সময়ে এসে পেছনে ফিরে তাকালে কি নিজেকে একজন পরিপূর্ণ মানুষ বলে মনে হয়?
রফিক আজাদ : না, আমি আসলে তেমন বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবনযাপন করিনি। যা করেছি, তা আমাদের সমাজের জন্য বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়তো বা। আমাদের সমাজের যে অচলায়তনিক অবস্থা, যে কনজারভেটিভ সমাজ, তাতে আমার জীবনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ বলা হচ্ছে আর কী। কিন্তু আমার এই একটু উল্টাপাল্টা জীবনকে বৈচিত্র্যপূর্ণ বলা যায় না। বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবন আমাদের লেখকদের মধ্যে খুব কম লেখকই যাপন করেছেন। আর তৃপ্ত তো কোনোভাবেই নই। তৃপ্ত হওয়ার কোনো অবকাশই নেই। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই অসফল একজন মানুষ।
প্রশ্ন : কিন্তু কবি হিসেবে আপনি নিজের কাছে কতটা সফল?
রফিক আজাদ : নিজের মূল্যায়ন করা খুবই কঠিন। আত্মসমালোচনা করা সহজ, বরং সেটি আমার জীবনে অনেক আছে, সেগুলো আমি বলতে পারব। কিন্তু নিজের মূল্যায়ন করাটা কঠিন। তবে এ কথা বলতে পারি যে, আমি চেষ্টা করেছি আমার যতটুকু শক্তি, যতটুকু মেধা আছে, সবটুকু দিয়ে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি পদ্য লিখতে। কী হয়েছে বা কী হয়নি, সেটা সম্পূর্ণই পাঠকের কাছে। কাল তো নিরবধি। কাজেই কালের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। তবে সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে একটু পক্ষপাত তো থাকেই নিজের প্রতি। যেমন নিজের ব্যবসার প্রতি কার না পক্ষপাত থাকে? সে হিসেবে হয়তো দু-চারটা পদ্য আমার কখনো কখনো ভালো লাগে, কখনো বা তেমন কিছু মনে হয় না। তবে আমি চেষ্টা করেছি, যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাংঘাতিকভাবে চেষ্টা করেছি। কাজেই সফল-অসফলের কথা আমার দিক থেকে না বলাটাই ভালো।
প্রশ্ন : ব্যক্তিজীবনে অনেক দুর্যোগ-দুর্বিপাক গেছে আপনার। পারিবারিক বিষয়ে অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কেটেছে। পারিবারিক এই জটিলতা আপনার কবিতায় প্রভাব ফেলেছে কি না?
রফিক আজাদ : প্রভাব পড়েছে কি পড়েনি, তা তো আমার কবিতা-ই বলবে। কিছু না কিছু প্রভাব তো পড়েই। মানুষের জীবন বলে কথা। যতই আমরা চেষ্টা করি আমাদের মেধা দিয়ে, মস্তিষ্ক দিয়ে কোনো একটা জিনিস তৈরি করতে, সেটাই হয় শেষাব্দি। কিন্তু পুরো বাস্তবের ওপর ভর করে তো আর কবিতা হয় না। জীবন তো আসলে কবিতা নয়, কবিতা করে তুলতে হয়। অনেক সময় ছোট্ট একটা পরিপ্রেক্ষিত লাগে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভর করে বাকিটা তৈরি করে নিতে হয়। সেই ছোট্ট পরিপ্রেক্ষিতটাই বাস্তবতা। সেটুকুই ভিত্তি। ভিত্তি তো একটা লাগেই। তো, সেটুকু আমার কোনো কোনো পদ্যে আছে। সেটা পাঠেই বোঝা যাবে। আমি তো মনে করি, আমার আত্মজীবনী লেখার কোনো প্রয়োজন নেই। আমার কবিতার মধ্যেই ধারাবাহিকভাবে আমার জীবন আছে। সন্বিষ্ঠ পাঠক কষ্ট করে, চেষ্টা করে আমার জীবন ওখান থেকে বের করে নিতে পারবে। দুঃখ-কষ্ট তো জীবনে আছে। হতাশা-হাহাকার, হৃদয় বিদীর্ণ করা বেদনাও আছে জীবনে। সেইসবের ছায়াপাত তো কবিতায় পড়বেই। আমার ক্ষেত্রে নয় শুধু, সবার ক্ষেত্রেই, সবার কবিতাতেই পড়ে।
প্রশ্ন : প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি ইত্যাদি বিষয়ে কবিতা লিখেছেন। আসলে আপনার কোন বিষয়ের কবিতা টিকে থাকবে বলে আপনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন?
রফিক আজাদ : রাজনীতি বা সমসাময়িক যেসব প্রসঙ্গ সেটা হলো, আসলে একজন শিল্পী যতই চেষ্টা করেন না কেন, তিনি সময়ের বাইরে বাস করতে পারেন না। এ যুগে, আর্টস ফর আর্টসের এ যুগে সেটা তাঁর পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কাজেই আমাদেরকে সমাজ, সংসার, নিজের যে সময়কাল, সময়, পরিবেশ, সময় পরিধি বা যে সময়টাতে যে বাতাসে আমি নিঃশ্বাস নিচ্ছি, সেই নিঃশ্বাসে তো এসব থাকবেই। সেটাকে ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়।
কাজেই এক অর্থে আমাদের কবিতায়, গোটা বাংলাদেশের কবিতায়, সবার কবিতার ক্ষেত্রেই বলি, এগুলো আমাদের দেশের সমাজতত্ত্ববিদদের জন্য, তাঁদের গবেষণার জন্য একটা বড় সহায়ক। আমাদের সে জন্য অনেক সময় তারিখ দিয়ে কবিতা লিখি, যাতে সময়টা বোঝা যায় যে কোনো সময়ে কবিতাটা লিখেছি। কিন্তু কোনো কোনো সময় হয়তো পত্রপত্রিকায় যাঁরা কবিতাটি ছাপেন, তাঁরা তারিখটা মুছে ছাপেন। তাই অনেক সময় সব কবিতায় তারিখ পাওয়া যায় না। কিন্তু কবিতার বই যখন ছাপা হয়, তখন লেখা থাকে যে এত থেকে এতকাল পরিধিতে কবিতাগুলো লিখিত। একটু যাঁরা খেয়াল করে পড়েন, যাঁরা কবিতা পড়ে কিছু পাওয়ার চেষ্টা করেন, তাঁরা এগুলো পড়ে অনেক উপাদান পাবেন। সমাজ, দেশ, কালের নানা উপাদান পাবেন। বিশেষ করে আমাদের দেশটি স্বাধীনতার পরে এতভাবে ওলটপালট হয়েছে যে বারবার আমরা বিড়ম্বনার মধ্যে, দুঃসময়ের মধ্যে কাটিয়েছি। এসবের ছাপ তো পড়বেই; যতই ছাপ না ফেলানোর চেষ্টা করি না কেন। তবে যতদূর সম্ভব সাহিত্যমূল্য যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। ছাপ ফেলতে গিয়ে আবার যাতে সাহিত্যমূল্য হারিয়ে না যায়।
প্রশ্ন : অর্থাৎ শিল্পোত্তীর্ণ ঘটানোর ব্যাপারটার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
রফিক আজাদ : হ্যাঁ, তাই। আসলে কোনটা শিল্পোত্তীর্ণ হলো আর কোনটা হলো না, সেটা তো নিজ থেকে বোঝা যায় না। তবে চেষ্টা থাকতে হবে আর কী।
প্রশ্ন : কবিতায় প্রকৃতি ও নারীপ্রেম কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
রফিক আজাদ : আমি মনে করি, কবিতায় শতকরা ৮০ ভাগই প্রকৃতি ও নারীপ্রেম প্রয়োজন। আজ আমরা যদি চারদিকে তাকিয়ে দেখি তাহলে দেখব, যে প্রকৃতি আমাদের মায়ের মতো লালন করে, সেই প্রকৃতিকে আমরা নষ্ট করছি। যেমন—বৃক্ষ। বৃক্ষের সঙ্গে মানুষের জন্ম থেকেই সম্পর্ক। বৃক্ষ যা পরিত্যাগ করে, সেটা আমার নিঃশ্বাসের বায়ু। আমরা অক্সিজেন পাই গাছের কাছ থেকে। গাছের কাছ থেকে জীবন ধার করেই আমরা চলছি। অথচ আমরা বৃক্ষের প্রতি কত বৈরী! কত সহজেই আমরা বৃক্ষ নিধন করি নির্বিবেকভাবে। সেটা আমার কবিতার প্রধান প্রতিপাদ্য দীর্ঘদিন ধরেই যে, আমি ১৯৬৬ সাল থেকে...
প্রশ্ন : ‘বিরিশিরি পর্ব’ কবিতাগুচ্ছ থেকে...
রফিক আজাদ : ‘বিরিশিরি পর্বে’র আগে, অর্থাৎ ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ থেকে আমি নানাভাবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, প্রকৃতির পক্ষে লিখছি। আসলে আমাদের দেশে যতটুকু বনভূমির প্রয়োজন, ততটুকু নেই। কমপক্ষে ২৭ শতাংশ বনভূমি দরকার। কিন্তু আমাদের ২০-এর নিচে চলে গেছে বহুদিন আগেই। তবু এখনো আমরা বৃক্ষ নিধন করে চলেছি। এটা অন্যায়। কোনো কারণে যদি আমাকে একটা গাছ কাটতে হয়, তাহলে দশটা গাছ রোপণ করে তার পর কাটতে হবে। এটাই করা উচিত। কারণ, প্রকৃতি বা বৃক্ষ আমাদের বাঁচিয়ে রাখছে, আমাদের আয়ু দিচ্ছে। কী সুন্দর একটি দেশ আমাদের। এই নদী-নালা, গাছপালা আমাদের সন্তানের মতো লালন-পালন করছে। অথচ আমরা এগুলোকে হত্যা করছি।
প্রশ্ন : বিশ্বজুড়েই তো প্রকৃতি নিধনের মহোৎসব চলছে বলা যায়।
রফিক আজাদ : হ্যাঁ। পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার নামে পৃথিবীর ওপর অত্যাচার চলছে। মাটির নিচে, আকাশে, সমুদ্রের জলে যে পরিমাণে পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা চলছে, তাতে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। সুনামির কথা আমরা জীবনে শুনিনি। কিন্তু এখন হচ্ছে, এখন দেখছি। হাজার চেষ্টা করেও পারমাণবিক স্থাপনাগুলো অক্ষত রাখতে পারছে না জাপান। এটা একটা অশুভ ব্যাপার সবার জন্য। কী করে এই পৃথিবীকে রক্ষা করবে? মানুষ নিজেকে নিজেই মারছে। মানুষের হাতে এত পারমাণবিক অস্ত্র আছে যে, তাতে পৃথিবীটাকে বহুবার ধ্বংস করতে পারে। এটা মারাত্মক অন্যায়। আমি বলি, তোমাদের যুদ্ধ যদি করতেই হয়, তবে তরবারির যুগে ফিরে যাও। তরবারি দিয়ে যুদ্ধ করো। এই জগৎ-বিধ্বংসী অস্ত্র বিসর্জন দাও। কোথায় নিয়ে এসব অস্ত্র নষ্ট করা যায়, সেখানে গিয়ে নষ্ট করে ফেল। কিন্তু এই পৃথিবীতে নয়। এই ধরিত্রীকে কোনোক্রমে আর রেপ করা চলবে না। তোমরা তোমাদের মাকে রেপ করছ। এর জন্য আমার চরম ঘৃণা।
প্রশ্ন : আপনি একজন বন্ধুবৎসল মানুষ। অনেক খ্যাতিমান মানুষের সান্নিধ্যে কাটিয়েছেন সারা জীবন। এসব সান্নিধ্য আপনার জীবনে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে?
রফিক আজাদ : না, আমি অত খ্যাতিমান বন্ধুবান্ধব যে পেয়েছি, তা নয়। তবে যাঁদের সঙ্গে চলেছি, তাঁদের একটাই গুণ, তাঁরা কর্মপ্রিয় মানুষ। যেমন—উইলিয়াম রাদিচে। তিনি আমার বাড়িতে এসেছেন। আর ক্লিন্ট বুথ সিলির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। এঁরা দুজনই বাংলা ভাষার প্রেমিক, বাংলা কবিতার প্রেমিক। ক্লিন্ট বুথ সিলি কাজের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন বরিশালে। এসে তিনি বরিশালের ভাষা শিখেছিলেন, বাংলা ভাষা লিখতে-পড়তে শিখেছিলেন। তিনি আবিষ্কার করেন, জীবনানন্দ দাশের মতো কবি সারা বিশ্বে বিরল। তিনি জীবনানন্দকে সারা বিশ্বে পরিচিত করার জন্য একটা ব্রত নিয়েছিলেন। সেই ব্রতের ফসল আমরা পাচ্ছি। তিনি শেষ পর্যন্ত অধ্যাপনায়ও বাংলা ভাষাকে নিয়েছেন। তিনি এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যাপনা করেন প্রাচ্য ভাষা বিভাগে, বাংলা ভাষা বিষয়ে। এটা আমাদের গর্ব করার ব্যাপার। কবি বেলাল চৌধুরীর বন্ধু তিনি। আমি অল্প দিন তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। আমি মনে করি, বাংলাদেশের উচিত তাঁকে এ দেশের নাগরিকত্ব দেওয়া এবং তাঁকে কোনো না কোনো গৌরবোজ্জ্বল পদকে ভূষিত করা। বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর যে প্রেম, এ জন্য তাঁকে একুশে পদক দেওয়া যেতে পারে।
আরেকজন হচ্ছেন উইলিয়াম রাদিচে, আপনারা নিশ্চয়ই জানেন তাঁকে। তিনি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ এবং সমসাময়িক কবিদের কবিতাও অনুবাদ করেছেন। সংকলন করেছেন ভারত-বাংলার কয়েকজন কবির কবিতা নিয়ে। এঁরা ছাড়াও আছেন আমার কবিতার অনুবাদক। এবং বিশ্বে আরো যাঁরা আমার বন্ধু আছেন, তাঁদের কাছ থেকে একটা জিনিস পেয়েছি, সেটা হচ্ছে নিষ্ঠা। যে কাজে তাঁরা নিয়োজিত, সেই কাজ তাঁরা নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। সেটাকে তাঁরা ব্রত হিসেবে নেন। আমিও কবিতাকে জীবনে হালকাভাবে নিইনি। ছোটকাল থেকে, নয়-দশ বছর বয়স থেকে কবিতা লিখি। হয়তো তখন কবিতা হতো না। কিন্তু সারা জীবন আমি এই কবিতাকে ব্রত হিসেবেই নিয়েছি। হয়তো লিখি কম। কিন্তু যা লিখি, তা বুঝে-শুনে লিখি। আমার দেশের বন্ধুদের কাছ থেকেও আমি ‘নিষ্ঠা’কে নিয়েছি। আমার অগ্রজদের মধ্যেও এই নিষ্ঠা দেখেছি। যেমন—শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক। আমার সমসাময়িক যাঁরা—আসাদ চৌধুরী, মোহাম্মদ রফিক—এঁদের মধ্যেও আমি নিষ্ঠা দেখেছি। নিষ্ঠা দেখেছি আমার পুত্রতুল্য বন্ধু সেলিম আল দীনের মধ্যে। তার কাছ থেকেও আমি নিষ্ঠাকে নিয়েছি। সে আমাদের নাটকের জগৎ পাল্টে দিয়েছে। তার কাজকে স্বীকৃতি দিতেই হবে আমাদের। সে যে এত দ্রুত ফুরিয়ে যাবে, তা ভাবতে পারিনি আমি। এই বয়সে আমি মনে করি, যে-কজন অমরত্বের দরজায় পৌঁছেছেন, সেলিম তাদের মধ্যে একজন। যতদিন পৃথিবীতে নাট্যপ্রয়াস থাকবে, ততদিন তার নাম থাকবে; যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ততদিন তার নাম থাকবে।
তো, আসলে নিষ্ঠাটাই সবচেয়ে বড়। আমি আমার অগ্রজ, অনুজদের কাছ থেকে এই নিষ্ঠাটাকে নিয়েছি, শিখেছি।
প্রশ্ন : বাঙালি সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? এই জাতির মধ্যে ঈর্ষা, প্রতিহিংসা, পরশ্রীকাতরতা প্রবলভাবে বিদ্যমান। সংঘবদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না, এটাও বাঙালির দুর্বলতা। আপনি কীভাবে দেখেন ব্যাপারগুলোকে?
রফিক আজাদ : আমি নিজেও হয়তো পুরোটা বাঙালি নই। বাঙালি তো আসলে একটা শঙ্কর জাতি। একটু একটু রক্ত সবার মধ্য থেকে পেয়েছে। আমার মধ্যে হয়তো মঙ্গোলীয় রক্ত বেশি। যার জন্য আমার চোখ ছোট, নাক ছোট। রক্তের মিশ্রণের ফলেই হয়তো বাঙালির এসব দুর্বলতা। মিশ্রণ হলে তো শুধু সৎ গুণগুলো একত্র হয় না, কিছু বদগুণও তো থাকবে। তাই এগুলোকে ক্ষমার চোখে দেখাই ভালো। কারণ, এগুলো আমাদের চরিত্রের মধ্যে ঢুকে গেছে। ভালো-খারাপ সব সমাজেই আছে। আমাদেরটা হয়তো একটু বেশি। আমাদের ভাষায় দু-একটা শব্দ আছে, যা পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষায় নেই। যেমন—‘পরশ্রীকাতরতা’। অর্থাৎ অন্যের শ্রী দেখে নিজে কাতর হওয়া। এটা পৃথিবীর কোনো জাতির মধ্যে নেই এবং পৃথিবীর কোনো জাতির ভাষার মধ্যেও এ শব্দ নেই। এটা লজ্জাকর একটা ঘটনা। এটা হয়তো পরবর্তীকালে ‘পরস্ত্রী’ কাতরতাতেও পর্যবসিত হতে পারে (এ সময় কবি রফিক আজাদ খুব হাসছিলেন)। যাই হোক, পরশ্রীকাতরতাটা খুবই খারাপ এবং ক্ষতিকর।
তো, এগুলো থাকবে। দোষে-গুণেই বাঙালি। বাঙালি আসলে মহৎ জাতি। বাঙালির আবেগ আসলে মহৎ আবেগ। এই আবেগ না থাকলে অনেক কিছুই হতো না। বাঙালির সৎ গুণের একটি হলো, হাজার হাজার বছর আগের এই জাতি বিপুলভাবে আবেগে জেগে উঠেছিল বলে একটি দেশ তৈরি করতে পেরেছিল। দেশ তৈরি করার নেতৃত্ব দেওয়ার মতো লোক ছিল। টোটাল নেতৃত্ব দেওয়ার মতো এক ব্যক্তি, যাঁর মধ্যে সব গুণই ছিল, তিনি সেই নেতৃত্বটা দিতে পেরেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সবার আবেগ তাঁর মধ্যে পেয়েছিল সবাই। সবার হয়ে তিনি কথা বলেছিলেন। তাঁর কথাতেই তাঁর অনুপস্থিতিতেও নয়টি মাস তাঁর নামে, তাঁর একটি বক্তৃতায়, তাঁর আদর্শে মানুষ যুদ্ধ করেছে। এই যে বিপুল আয়োজন, এটা তো বিশাল ব্যাপার। তখন দেখা গেল, এক কোটির বেশি লোক যুদ্ধে চলে গেল। বাড়িঘর, সংসার সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে। কদ্দিন থাকতে হবে, তা তাঁরা জানতেন না। এটা একটা বিস্ময়কর জাতি। কাজেই এ জাতির বিরুদ্ধে আমার কোনো অভিযোগ নেই। এই জাতিতে আমি জন্মগ্রহণ করেছি বলে আমার কোনো খেদ নেই। আমি নিজেকে গর্বিত বাঙালি বলে মনে করি। বাংলা ভাষাটা খুব ভালোভাবে শেখার চেষ্টা করি।
প্রশ্ন : ভাষা প্রসঙ্গে বললেন। বাংলা ভাষা নিয়ে সাম্প্রতিককালে একটা নৈরাজ্য চলছে। কেউ ভাষার ক্ষেত্রে সংরক্ষণবাদী, কেউ বা উদারবাদী। অর্থাৎ কেউ আগেকার ধারা বজায় রাখতে চান, কেউ বা এক্সপেরিমেন্ট করতে চান। আপনার কী অভিমত?
রফিক আজাদ : ভাষা হলো একটি নদীর মতো। প্রবহমান। মনে করে দেখুন, যখন আমাদের প্রথম লেখ্য রূপ শুরু হয়, তখনকার ভাষা ছিল একরকম। রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর এঁদের আমলে যদি যাই, তাহলে দেখতে পাবো তখনকার ভাষা একরকম। তার পর বঙ্কিমচন্দ্র হয়ে, রবীন্দ্রনাথ হয়ে মাঝখানে মাইকেল হয়ে ভাষা এগিয়েছে। মাইকেলের গদ্য অবশ্য অনেক আধুনিক। কিন্তু যখন তিনি কবিতা লিখেছিলেন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, সেটা কিন্তু অনেকটাই অভিধাননির্ভর। ওই ভাষায় কোনো বাঙালি বোধ হয় তখনো কথা বলত না। বাঙালির দুটো ভাষা হয়ে গিয়েছিল। একটা কথ্য, অপরটি লেখ্য। শেষ পর্যন্ত কথ্যের দিকেরই জয় হতে বাধ্য। কারণ, এটা তো বহমান একটা ব্যাপার। নদী যেমন উপর থেকে নিচের দিকে নেমে আসে, ভাষাও তেমনি। মানুষের স্নেহও তাই। ভাষার গতিও নিম্নাভিমুখী। নিচের দিকে নেমে যাবে। গড়াবে। সংরক্ষণবাদী যাঁরা, তাঁরা এই জায়গায় ভুল করেন। তাহলে তো বঙ্কিমচন্দ্রের ওই ভাষাই আমাদের লেখ্য ভাষা হওয়া উচিত। কেউ কেউ এখন আবার শুরু করেছেন প্রমিত সাধু ভাষার চর্চা। সেটাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন তাঁরা। যাঁরা করছেন, তাঁদের নাম বলতে চাই না। তাঁরা এভাবে লেখেন যে, ‘ইহা অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হইতেছে যে, আমরা এখন এইভাবে কথা বলিতে শিখিতেছি।’ এই সাধু ভাষা আমদানির চেষ্টা করছেন তাঁরা। আমি জানি না, সেটা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।
প্রশ্ন : এটা তো নৈরাজ্যের একটা ব্যাপার। যে যেভাবে ইচ্ছা ভাষা নিয়ে নৈরাজ্যের সৃষ্টি করছে? একটা স্ট্যান্ডার্ড তো রাখতে হবে ভাষার?
রফিক আজাদ : হ্যাঁ, নৈরাজ্যই বলতে হবে এটাকে। একটা লেখ্য রূপ অলরেডি আছে, চলছে। যে ভাষায় আমি কথা বলি, সেই ভাষাতেই আমি লিখব, তাতে অসুবিধা কোথায়? ‘ওহে মৎস্য বিক্রেতা, উহার কত দাম হইতেছে’—এভাবে তো কেউ কথা বলে না। ভাষার আঞ্চলিক একটা রূপ থাকবে, সেটা আলাদা কথা। একেবারে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাটা মোটেই উচিত নয়। আমাদের একটা ইনস্টিটিউট যেহেতু আছে, বাংলা একাডেমি, আমাদের মনন ও মেধার প্রতীক এই একাডেমি। এই একাডেমির যে প্রমিত বাংলা, সেটাই আমার মনে হয় মান্য হওয়া উচিত।
প্রশ্ন : বাংলা ব্যাকরণের ব্যাপারে বাংলা একাডেমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছে?
রফিক আজাদ : হ্যাঁ, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আসলে কিন্তু তেমন মানসম্পন্ন ব্যাকরণ আমাদের নেই, যেটা অন্য সব ভাষায় আছে। আমাদের আগের যেসব ব্যাকরণ আছে, সেগুলো যাঁরা রচনা করেছেন, তাঁরা মান্য মানুষ, তাঁদের ব্যাকরণও আমাদের থাকবে, সে সঙ্গে বাংলা একাডেমিরটাও থাকবে। ভাষা নিয়ে যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁদের প্রত্যেকের ব্যাকরণই আমি সংগ্রহ করি। বাংলা একাডেমি যে প্রমিত ব্যাকরণ তৈরি করছে, সেটা হলে আমরা একধাপ এগোব বলে মনে করি।
প্রশ্ন : আপনাদের সময়ে আপনারা কলকাতাপ্রবণ সাহিত্যের মধ্যে বেড়ে উঠেছিলেন। এখন দুই বাংলা। এ দুই বাংলার সাম্প্রতিক সাহিত্যের মধ্যে ফারাক কী?
রফিক আজাদ : ফারাক তো অবশ্যই আছে এবং থাকবে। ইংল্যান্ড-আমেরিকা তো একই ভাষায় লেখে। আবার ইংল্যান্ডের ইংরেজি আর আমেরিকান ইংরেজি যেটা, তাতে কিন্তু তফাৎ আছে। যেহেতু জীবনযাত্রা আলাদা, ইকোনমিক্যাল কন্ডিশন আলাদা, রাজনৈতিক কন্ডিশন আলাদা। তার পর আবহাওয়া, আমার অবস্থান, আমার লোকালিটি, আমার নদী-নালা, খাল-বিল যখন আলাদা, তখন তাদের সঙ্গে আমাদের ফারাক তো থাকবেই। তাদের একটু রাঢ়ীয় আবহাওয়া আছে। আমাদের নদীগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পরও আমাদের যে নদী-নালা আছে, তা বিপুল। তাতে আমাদের মনমানসিকতা এইভাবে গড়া, এই আবহাওয়ায় গড়া। আমার জিহ্বাও এই রকম, আমার জীবনযাত্রাও অন্য রকম, আমার সমস্যা তার সমস্যা আলাদা। আমি যখন একটা জীবন লিখব, তখন পূর্ব বাংলার জীবন পূর্ব বাংলার জীবনের মতোই হবে, পশ্চিম বাংলার জীবন পশ্চিম বাংলার জীবনের মতোই হবে। যেমন—তারাশঙ্করের লেখায় ‘ঊষর ধূসর’ শব্দটা দেখি। কারণ, পরিবেশটা ও রকম। আবার বিভূতিভূষণ বনভূমি খুঁজে বেড়াতেন। স্বাভাবিক পল্লীর জীবন, সেটা আরেক মাধুর্যময়। আমাদের এখানে যাঁরা কথাসাহিত্য নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা যে জীবনযাপন তুলে ধরবেন সেটা তো আলাদাই হবে। সম্পূর্ণ আলাদা হবে। তাঁদের শিক্ষা-দীক্ষা সবকিছুই আলাদা হবে।
প্রশ্ন : দুই বাংলার কবিতাতেও তো একই ফারাক দেখা যায়।
রফিক আজাদ : আমাদের যে জীবনযাপন পদ্ধতি আর তাদের যে জীবনযাপন পদ্ধতি, দুটো তো আলাদা। কবিতা পড়লেই বোঝা যায় সেটা। নাম মুছে দিলেই কবিতার পাঠকরা আলাদা করতে পারবে যে, এটা বাংলাদেশের কবিতা আর ওটা পশ্চিম বাংলার কবিতা। ওটা উচ্চারণেই বোঝা যায়। ওদের উচ্চারণটাই তো ভিন্ন রকম। পুরুষ মানুষের লেখা পড়ে মনে হয় যেন কোনো মহিলা লিখছে। ‘হ্যাঁ গো’-‘ম্যা গো’ লিখে ভরিয়ে রাখে। অন্যদিকে, আমাদের পুরুষ মানুষের কবিতা পুরুষ মানুষের কবিতাই। সোজা কথা এটা। মেয়েলি ভাব থাকবে কেন? মেয়েলি কথাটার মধ্যেই তো এক ধরনের প্রচ্ছন্ন ব্যঙ্গ আছে। মেয়েলি ভাষায় আমি কবিতা লিখব কেন? পুরুষ মানুষ পুরুষ মানুষের মতোই কবিতা লিখব। সোজা কথা আমার।
প্রশ্ন : বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ কী?
রফিক আজাদ : বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করতে হলে আমাদের সব দিকে দাঁড়াতে হবে। প্রধানত অর্থনৈতিকভাবে দাঁড়াতে হবে। যদ্দিন আমাদের অর্থনীতি বড় না হবে, যদ্দিন বৈশ্বিক পটভূমিতে আমাদের অর্থনীতি না দাঁড়াবে, তদ্দিন পর্যন্ত বাইরের জগতের কোনো উৎসাহ আমাদের সাহিত্যের প্রতি হবে না। আমরা যদি সত্যিকারার্থে আমাদের সাহিত্যকে তুলে ধরতে চাই, তাহলে আমাদের যাঁরা দেশ চালান এবং যাঁরা ভাষা সাহিত্যের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে আছেন, তাঁদের দৃষ্টি দিতে হবে।
সত্যিকারার্থে আমাদের দেশে প্রচুর ভালো কবিতা, প্রচুর ভালো উপন্যাস আছে। এখনকার তরুণরা প্রচুর ভালো লিখছেন। নবীন-প্রবীণরা মিলে গভীর চর্চা করতে হবে। বিদেশিদের এই দেশে এনে, স্কলারশিপ দিয়ে এনে, তাদের খেতে-থাকতে দিয়ে, তাদের বাংলা শিখিয়ে তার পর বাংলা ভাষা অনুবাদ করে বাইরে পাঠাতে হবে। এটা যদ্দিন না হবে, যদ্দিন এদিকে দৃষ্টি না দেবেন আমাদের কর্তা-কর্ত্রীরা, তদ্দিন এই দেশের শিল্প-সাহিত্যের উন্নতি হবে না। এটা না করে বড় বড় কথা বলে, আকাঙ্ক্ষা করে কোনো লাভ হবে না। শোনা যায়, ব্যক্তিগত উদ্যোগে অনেকেই নোবেল পুরস্কার পাওয়ার জন্য অনুবাদ করিয়ে এদিক-ওদিক পাঠায়। এতে কোনো লাভ নেই। নিজে ভালো লেখার চেষ্টা করো, তারপর অন্যের পুরস্কারের আশা করো। তদবির করে, হাতে-পায়ে ধরে পুরস্কার আনার পরিণতি খুব খারাপ হয়।
প্রশ্ন : নোবেল পুরস্কারও তাহলে তদবিরে হয়?
রফিক আজাদ : হ্যাঁ, হয়-ই তো। সারা পৃথিবীতে যারা অশান্তি ক্রিয়েট করে, তারা শান্তি পুরস্কার পায়। আশ্চর্য! মিসরে এক অশান্তি সৃষ্টিকারী পেয়েছিল। অধিকাংশই অশান্তি সৃষ্টিকারী শান্তি পুরস্কার পেয়েছে।
প্রশ্ন : তার মানে কি আপনার দেশের কথাও বলছেন? ড. মুহাম্মদ ইউনূস?
রফিক আজাদ : না, আমি আমাদের দেশের কথা বলছি না। আমি নিজের দেশের বদনাম কেন নিজে করব?
প্রশ্ন : শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী—এই তিন কবি সম্পর্কে আপনার তুলনামূলক বিচার?
রফিক আজাদ : তিনজনই অনেক বড় কবি। আলাদা করে বলার কিছু নেই। এতই বড় যে, এর মাপকাঠি দেওয়া চলবে না।
প্রশ্ন : সাম্প্রতিক বাংলা কবিতার গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে যদি বলতেন।
রফিক আজাদ : আমার মনে হয়, এত সহজে এটা বলা যাবে না। আজকের যে কবিতা, সেটার গতিপ্রকৃতি ধরতে হলে চিন্তা করতে হবে। তাদের চিন্তা-চেতনা বুঝে উঠতে আমারও তো সময় লাগবে। তবে আমি পজিটিভ কথাই বলতে চাই। পৃথিবীতে তরুণদের অপচয় করার মতো শক্তি আছে, আবার সাহসও আছে। এক্সপেরিমেন্টের জন্য তাদের জীবন থেকে সামান্য কিছু সময় অপচয় করলে ক্ষতি নেই। তারাই তো চেষ্টা করবে একটা পথ বের করতে, অজানা কোনো বাঁকে আলো না পড়ে থাকলে সেখানে আলো ফেলার দায়িত্ব তো তাদেরই। আমি সব সময়ই আশাবাদী মানুষ। নিজের জীবন আর নিজের লেখা সম্পর্কেই শুধু আমি আশাবাদী নই, আমি আশাবাদী এই দেশের তরুণদের ব্যাপারেও। তাদের ভবিষ্যৎ খুব উজ্জ্বল হবে।
প্রশ্ন : এই দেশ সম্পর্কে আপনি কতটা আশাবাদী?
রফিক আজাদ : খুবই আশাবাদী। একদিন আমাদের অর্থনীতিও দাঁড়াবে। তখন আমাদের যাঁরা শিল্প-সাহিত্য চর্চা করবেন, তাঁরা অনেক বেশি অগ্রগামী হবেন।
প্রশ্ন : আমাদের সাহিত্যচর্চা বর্তমানে দৈনিক পত্রিকাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
রফিক আজাদ : এইটা হলো কি, আমাদের এখানে সব সময়ই তরুণদের চর্চার জায়গা হলো লিটল ম্যাগাজিন। আসলে লিটল ম্যাগাজিন যাঁরা প্রকাশ করেন, তাঁদের অনেক রক্ত দিতে হয়; তাঁদের রক্ত বেচা টাকা দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে অনেক তরুণ বিভিন্ন পত্রিকার সাহিত্য পৃষ্ঠার সরাসরি সম্পাদক না হলেও ওই পাতার সঙ্গে সম্পৃক্ত। আমাদের লেখা তারা সাধারণত কম পায়। এ ছাড়া গদ্যের প্রচুর অভাব। সব কাগজে গদ্যের জোগান দেওয়ার জন্য আরো প্রচুর পরিমাণ লেখক আসা উচিত। যেমন—পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনো বিষয় নেই, যে বিষয়ে ৫০ জন লেখক নেই। আমি মনে করি, লিটল ম্যাগাজিনই হলো নতুন লেখার জন্য প্রধান ধাত্রী। অনেক সময় দৈনিক পত্রিকা অনেক কনজারভেটিভ হয়। অনেক কথা জনসমক্ষে প্রচার করা যায় না ওসব পত্রিকার মাধ্যমে। নানা বাধা আসে। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনে সেই বাধা থাকে না। আমার কথা হচ্ছে, থাক না পাশাপাশি দুটো। দৈনিক পত্রিকায়ও তো চাকরি-বাকরির একটা সুযোগ পাচ্ছে তরুণরা। প্রতিভাবান ছেলেমেয়েরা চাকরি করতে পারছে সেখানে। একসময় পরিবর্তন হয়ে যাবে। যেসব কিছু আজকে দৈনিকে ছাপানো যাচ্ছে না, একসময় তরুণরাই তা ছাপবে। প্রতিবাদ করবে যে, কেন এসব ছাপানো যাবে না। তারা এসব বাধা ভেঙে ফেলবে।
প্রশ্ন : কিন্তু আমাদের দেশে কি আদৌ শক্তিমান ছোট কাগজনির্ভর সাহিত্য চর্চা হচ্ছে?
রফিক আজাদ : আমি তো আর সব লিটল ম্যাগাজিন দেখতে পারি না, দেখার সুযোগ পাই না। করতে করতে আস্তে আস্তে তাদের চর্চাটা শক্তিশালী হয়ে উঠবে বলে আমি মনে করি। আমি এ ব্যাপারে আশাবাদী। তরুণরাই আমাদের সাহিত্যের স্রোতধারাকে বয়ে নিয়ে যাবে। তরুণদের এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ দিতে হবে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। এই করে যথার্থ সাহিত্য চর্চা অব্যাহত রাখতে হবে।
প্রশ্ন : কথাশিল্পী আবদুশ শাকুর আমাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে একটা কথা বলেছেন যে, লিটারারি জার্নালিজম বাংলা সাহিত্যে একটা প্রাচুর্য এনেছে। আপনার কী মনে হয়?
রফিক আজাদ : তাঁর সঙ্গে আমিও একমত। তিনি যথার্থই লক্ষ করেছেন ব্যাপারটা। তিনি আসলেই একজন গুণী মানুষ, গবেষক এবং সৃজনশীল লেখক। তাঁর প্রথম গল্পের বই আমি কিনে পড়েছিলাম অনেক আগে। তাঁর উক্তিটা ঠিক। এখন ক্রিকেটের যেসব লেখক, তাঁরা খুব সুন্দরভাবে লেখেন। একেবারে কাব্যিক উপাদানে ভর্তি থাকে তাঁদের লেখাগুলো।
প্রশ্ন : দৈনিক পত্রিকার যে উপ-সম্পাদকীয়গুলো থাকে আমার মনে হয়, সেগুলোও লিটারারি জার্নালিজমের মধ্যে পড়ে।
রফিক আজাদ : হ্যাঁ হ্যাঁ। উপ-সম্পাদকীয় আসলে এ উদ্দেশ্যেই করা হয়। এটা আগেও ছিল। এগুলোও সাহিত্যরসে ভরপুর থাকে। আবদুশ শাকুর এই লিটারারি জার্নালিজম সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর এই আবিষ্কারের জন্য তাঁকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাই।
প্রশ্ন : মুক্তবাজার অর্থনীতি আমাদের সাহিত্যে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে বা আদৌ ফেলেছে কি না?
রফিক আজাদ : না, প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয় না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আপনার বিবেচনায় বাংলা ভাষায় সেরা সাহিত্য কোনটি?
রফিক আজাদ : না, এভাবে তো বলা যাবে না। কমবেশি সবারই আছে। এককভাবে বলাটা উচিত হবে না।
প্রশ্ন : কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন যুদ্ধ নিয়ে বড় বড় কাজ হয়েছে। সে তুলনায় আমাদের তো নেই।
রফিক আজাদ : সময় তো এখনো আছে। বড় সাহিত্য এখনই হবে না। কারণ, বাঙালি এখনো আবেগমুক্ত হতে পারেনি। আবেগটাই বাঙালির মহামূল্যবান, একমাত্র সম্পদ। এখন লিখতে গেলেই ‘আহা মুক্তিযুদ্ধ’-‘বাহা মুক্তিযুদ্ধ’—এসব এসে যাবে আবেগের কারণে। আর ‘আহা মুক্তিযুদ্ধ’-‘বাহা মুক্তিযুদ্ধ’ দিয়ে কথাশিল্প হবে না।
প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধের চার দশক অতিক্রান্ত হলো। কী কী পরিবর্তন হয়েছে আমাদের?
রফিক আজাদ : প্রথমত, আমাদের দৃষ্টি প্রসারিত হয়েছে অনেক। বিশ্বাভিমুখে তাকানোর যে ব্যাপারটা, সেটা উন্নত হয়েছে। যে যা-ই বলুক, শিক্ষার দিক কিন্তু অনেক উন্নত হয়েছে। আজ-কালকার বাচ্চাকাচ্চারা যা পড়ে, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক ভালো পড়ানো হয়। কিছু বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলো বিশ্বমানের।
আসলে যুদ্ধ কতগুলো মূল্যবোধ ভেঙে কিছু মূল্যবোধ তৈরি করে। অবক্ষয় যেটা হয়, সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয় না। তার পর আমাদের যে কয়টা বছর গেছে, এটা একটা রাষ্ট্রের জন্য তেমন বয়স নয়। এখন থেকে আমরা যদি সমঝে চলতে পারি, পরিকল্পনামতো এগোতে পারি, তবে একটা সম্ভাবনা আমাদের আছে।
প্রশ্ন : জীবনকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনার মৃত্যু-ভাবনা কী?
রফিক আজাদ : জীবন খুবই উপভোগ্য। বেঁচে থাকটাই আনন্দের। মৃত্যু নিয়ে আমি ভাবি না। এটা একটা অবধারিত ব্যাপার। ক্রমে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়া মানেই যে ম্যাচুয়েরিটির দিকে যাওয়া তা-ও আমি মনে করি না।
প্রশ্ন : প্রেম সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
রফিক আজাদ : প্রেম জীবনের রসায়ন। প্রেম ছাড়া মানুষ হয়? প্রেম ছাড়া শুধু মানুষ না, কোনো প্রাণীই হয় না। এই যে আমার মাথার ওপর আমার সারমেয় কন্যা, (কবি রফিক আজাদ একটি কুকুর পালন করেন, যেটি সব সময় তাঁর বাড়ির ছাদে থাকে) আমার মেয়ের মতো সেই কুকুর। আপনি বিশ্বাস করবেন না, একদিন আমি তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। ফিরে এসে ভাবলাম, আজকে আর তাকে আমি উপরে উঠাব না, সে নিচেই থাকবে। ভাবলাম, আমি সারা রাত এখানে বসেই কাটাব। ও সারা রাত আমার পায়ের কাছে বসেছিল আর মুখের দিকে তাকিয়েছিল। একপর্যায়ে তার দিকে তাকিয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। এই যে আমার পায়ের কাছে সে শুয়ে থাকল, সেটা তো প্রেম ছাড়া অসম্ভব। তার ভেতরেও প্রেম আছে। প্রেম বেঁচে থাকার রসায়ন।
প্রশ্ন : নারী-পুরুষের প্রেম কি শরীরকেন্দ্রিক? শরীর ছাড়া প্লেটোনিক প্রেম কি আদৌ সম্ভব?
রফিক আজাদ : অবশ্যই সম্ভব। শরীর তো অবশ্য একটা ব্যাপার প্রেমের ক্ষেত্রে। কিন্তু শরীরেরও বয়স আছে। সেই বয়স উত্তীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর কেন পরস্পরের প্রতি এতটা টান, এতটা ভালোবাসা। তখন শরীর কোনো ম্যাটার না। এই রসায়নটা কোত্থেকে আসে? তাই প্রেম আসলে একটি অনন্ত রসায়ন বেঁচে থাকার জন্য, প্রাণধারণের জন্য। সকল প্রাণীতে, সকল সৃষ্টিতে প্রেম অপরিহার্য একটা ব্যাপার। প্রেম ছাড়া যেমন কবিতা হয় না, প্রেম ছাড়া জীবনও হয় না।
প্রশ্ন : গ্লোবালাইজেশন কি প্রেমকে তার চিরায়ত জায়গা থেকে সরিয়ে দিয়েছে?
রফিক আজাদ : সব জায়গা কিন্তু এখনো বাজারকেন্দ্রিক হয়ে যায়নি। কোনো কোনো জায়গায় এই বিশ্বায়ন রক্তের সম্পর্কটাকেও ভেঙে দিয়েছে। সিঙ্গেল ফ্যামিলি ঠিক আছে। কিন্তু জন্মদাতা-জন্মদাত্রীকে অস্বীকার করাটা শেখাচ্ছে তারা। এটা খুবই দুঃখজনক।
প্রশ্ন : তার মানে মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক করে ফেলছে?
রফিক আজাদ : হ্যাঁ, আত্মকেন্দ্রিক করে ফেলছে। খুব। এটা করছে তাদের স্বার্থে। যাতে তারা মানুষের শ্রম, চব্বিশ ঘণ্টার মেধা সবকিছু খাটাতে পারে তাদের লুটপাটের কাজে।