অ্যালেন গিন্সবার্গের দুটি কবিতা
গত ৩ জুন ছিল মার্কিন কবি অ্যালেন গিন্সবার্গের জন্মদিন। পঞ্চাশ দশকের বিট জেনারেশনের এই কবি বহু আন্দোলনের ছিলেন পথিকৃৎ। তিনি সামরিকায়ন, সামরিক ব্যবসা ও যৌন নির্যাতনের বিরোধিতা করে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। তিনি ১৯২৬ সালের ৩ জুন জন্মগ্রহণ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সিতে। তারুণ্যের এই কবি মারা যান ১৯৯৭ সালের ৫ এপ্রিল। কবি গিন্সবার্গকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর দুটি কবিতা Five A.M. এবং A Supermarket in California-এর বাংলা অনুবাদ ছাপানো হলো। কবিতা দুটি ভাষান্তর করেছেন আরাফাত পারভেজ।
ভোর ৫টা
যে প্রাণের উচ্ছ্বাস আমাকে ভাসিয়ে তোলে মেঘের ওপরে
খোলা প্রান্তরে, অসীমে, প্রকৃত অনন্তে
শ্বাস বদলে যায় শব্দে
শব্দ ফিরে আসে প্রশ্বাসে
একশ দুইশ বছর ধরে তন্দ্রাচ্ছন্ন
প্রায় অমর, স্যাফোর ২৬শ শতাব্দীর
কাব্যছন্দময় প্রশ্বাসে—ছাড়িয়ে কাল, ঘড়ি,
সাম্রাজ্য, শরীর, গাড়ি,
রথ, গগনচুম্বী উড়োজাহাজ, রাষ্ট্র,
ধৃষ্ট প্রাচীর, চকমকে মার্বেল পাথর, ইনকা শিল্পকলা
সব মনের—কিন্তু এই উচ্ছ্বাস আসছে কোত্থেকে?
এই প্রেরণা? এই আবেশময় শ্বাস তোমার জন্য?
ঈশ্বর?
না, বিশ্বাস করি না, তুমি জড়িয়ে পড়বে
স্বর্গ আর নরকের ফাঁদে—
কলুষের ক্ষমতা, বরং এটাই জাগিয়ে রাখে হৃদস্পন্দন সারা রাত
অন্তরে শূন্যের বন্যা বইয়ে দেয়, প্রতিধ্বনিত
হয়ে যায় ভবিষ্যৎ নগরীতে, মহানগরীতে অথবা
ক্রিটান গ্রামে, জিউসের জন্মগুহা লাসিথি তটে—ওটসিগো প্রদেশে
খামারবাড়ি? কানসাসের সামনের বারান্দা?
বুদ্ধের সাহায্যের হাত, সাদামাটা প্রাণে দেয় না
কোনো নির্বাণ—
কফি, মদ, কোকেন, মাশরুম
গাঁজা, হাস্যরস?
নাহ, নীল আকাশে মগজের এই
লঘু উল্লাসের জন্য বড় ভারী
মে মাসের ভোরে যখন পাখি ডাকছে পুবের আকাশে
১২ নম্বর রোডে—
কোত্থেকে আসে এইসব উচ্ছ্বাস, আবার কোথায়ই বা হারিয়ে যায় একেবারে?
ক্যালিফোর্নিয়ার একটি সুপারমার্কেটে
আজ রাতে সে কোন ভাবনা আমি ভাবছিলাম তোমায় নিয়ে, ওয়ালট হুইটম্যান,
বিষাদ চৈতনে অলিতে-গলিতে হাঁটতে হাঁটতে গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে
চাঁদের দিকে তাকিয়ে।
ক্ষুধা-ক্লান্তিতে আর ভাবের বাজার করতে করতে আমি গিয়েছিলাম
নিওন ফ্রুট সুপারমার্কেটে তমার অগণিত কীর্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে।
কি কমলা আলোতে আর কি আবছায়ায়! পরিবারশুদ্ধ বাজার করছে
রাতের বেলায়! করিডোর ভর্তি স্বামীরা! বউয়েরা অ্যাভোক্যাদো ফলে
আর বাচ্চারা টমেটোতে!—আর তুমি, গার্সিয়া লরকা, তুমি
তরমুজের সামনে দাঁড়িয়ে কী করছ?
আমি তোমাকে দেখেছি ওয়ালট হুইটম্যান, নিঃসন্তান, একাকী
বৃদ্ধ নিড়ানি, ফ্রিজের ভেতরে নানান মাংস হাতাচ্ছ
আর দোকানের ছেলেগুলোর ওপর চোখ বুলাচ্ছ।
আমি শুনলাম তুমি তাদেরকে শুধাচ্ছ; শুয়োরের পাঁজরগুলোকে
কেটেছে? কলার দাম কত? তুমি কি সেই দেবদূত?
দোকানের গাদা করা চমৎকার সব কৌটার ফাঁক দিয়ে
আমি ঘুরছি তমার পেছন পেছন আর মনে মনে ভাবছি
দোকানের সতর্ক গোয়েন্দাও বুঝি ঘুরছে আমাদের
পেছন পেছন।
আমরা একসঙ্গে দোকানের দীর্ঘ করিডোর পাড়ি দিলাম, নীরব
খামখেয়ালিতে স্বাদ নিলাম আরটিচোক পাতার, লুকিয়ে আস্বাদ
নিলাম সমস্ত জমানো সুখাদ্যের কিন্তু একবারও ক্যাশিয়ারের
সামনে গেলাম না।
আমরা কোথায় যাচ্ছি ওয়ালট হুইথম্যান? এই তো আর এক ঘণ্টা
বাদে বন্ধ হয়ে যাবে মার্কেটের দরজা। তোমার দীর্ঘ দাঁড়ি
কোন রাস্তা তাক করছে আজ রাতে?
(আমি তোমার দীর্ঘ জীবনের স্বপ্ন আর লেখা স্পর্শ করছি এই সুপারমার্কেটে বসে
জল্পনাতে আর সেটা আমার নিজের কাছেই হাস্যকর লাগছে )
আমরা কি সারা রাত হাঁটব এই অন্ধকার একাকী রাস্তায়?
গাছের ছায়ায় অন্ধকার আরো গাঢ় হচ্ছে, ঘরগুলোর বাতি
নিভে গেছে, আমরাও নিঃসঙ্গই রয়ে যাবো।
আমরা কি সেই হারিয়ে যাওয়া শান্তির আমেরিকার স্বপ্ন
দেখতে দেখতে গ্যারাজের নীল গাড়িগুলোকে পাশ কাটিয়ে
ফিরে যাবো আমাদের নিরালা কুটিরে?
হায়! প্রিয় পিতা! ধূসর দাঁড়িওয়ালা, একাকী বৃদ্ধ সাহস—গুরু!
কেমন আমেরিকা তোমার ছিল যখন পৌরাণিক ‘শারন’
তার নৌকা থামিয়ে দিয়েছিল হঠাৎ আর তুমি মধ্যিপথে
নেমে পড়েছিলে কোনো এক ধোঁয়াটে তীরে আর দাঁড়িয়ে
দেখেছিলে তোমার তরী ধীরে হারিয়ে গেল ‘লেথে’
নদীর কালো জলে।