বাংলা সাহিত্যে রতি ও বিরতি
জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা প্রসঙ্গে
জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) সমালোচক জাতির লোকজনকে বড় একটা পছন্দ করিতেন না। প্রমাণস্বরূপ অনেকেই তাঁহার ‘সমারূঢ়’ নামক কবিতাটির নজির দেখাইতে পারিবেন। তাঁহার কবিতায় একজন কবি এই বাক্যটি জনৈক সমালোচকের মুখে ছুঁড়িয়া দিয়াছিলেন, ‘বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা’। কিন্তু সেই সমালোচক—যাহাকে আমাদের কবি অবজ্ঞায় নিছক ‘ছায়াপিণ্ড’ বলিয়া শনাক্ত করিতে দ্বিধা করেন নাই—এই কথার কোন উত্তরই দিতে পারেন নাই। তারপর কবি গাহিয়াছেন :
বুঝিলাম সে তো কবি নয়—সে যে আরূঢ় ভণিতা;
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ’পর
ব’সে আছে সিংহাসনে—কবি নয়—অজর, অক্ষর
অধ্যাপক; দাঁত নেই—চোখে তার অক্ষম পিচুঁটি
তো এই পর্যন্ত গেল সেই ছায়াপিণ্ডের কায়মনোবাক্য প্রসঙ্গ। তারপর আসিল তাহার ন্যায় ও অন্যায় প্রভৃতি বিচারের কথা। কবি লিখিয়াছেন এই সমালোচক শ্রেণির আয়-উপার্জন অনেক বেশি—অথচ তাঁহারা পরগাছা গোছের প্রাণি বই নহেন।
বেতন হাজার টাকা মাসে—আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি;
যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা-প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিল—হাঙরের ঢেউয়ে খেয়েছিলো লুটোপুটি।
সমালোচক মহাশয় যে আদৌ কবি নহেন তাহা একবার মাত্র প্রকটিয়া আমাদের কবিটি শান্ত হন নাই। তদুপরি তিনি জানাইলেন সমালোচক ভদ্রলোক মৃত সব কবিদের ‘মাংস কৃমি’ খুঁটিয়া জীবিকার অধিক আয় করেন এই কথা দিবালোকের মত সত্য। কবিরা জীবিত হইলেও না হয় একটা কথা ছিল।
সমালোচক জাতির উপর জীবনানন্দ দাশের বিরাগ মোটেও অর্বাচীন ঘটনা নয়। জীবনের শেষ বছরে—১৯৫৪ সালে—প্রকাশিত ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’র ভূমিকাচ্ছলে জীবনানন্দ দাশ অনুযোগ করিয়াছিলেন, সমালোচক জাতির লোকজন বড় অবিমৃষ্যকারী। তাঁহারা কবিকে বুঝিতে অক্ষম—এককথায় তাঁহারা পরপীড়ক। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘আমার কবিতাকে বা এ কাব্যের কবিকে নির্জন বা নির্জনতম আখ্যা দেওয়া হয়েছে; কেউ বলেছেন, এ কবিতা প্রধানত প্রকৃতির বা প্রধানত ইতিহাস ও সমাজ-চেতনার, অন্য মতে নিশ্চেতনার; কারো মীমাংসায় এ কাব্য একান্তই প্রতীকী, সম্পূর্ণ অবচেতনার; সুররিয়ালিস্ট। আরো নানারকম আখ্যা চোখে পড়েছে। প্রায় সবই আংশিকভাবে সত্য—কোনো কোনো কবিতা বা কাব্যের কোনো কোনো অধ্যায় সম্বন্ধে খাটে; সমগ্র কাব্যের ব্যাখ্যা হিসেবে নয়। কিন্তু কবিতা সৃষ্টি ও কাব্যপাঠ দুই-ই শেষ পর্যন্ত ব্যক্তি-মনের ব্যাপার; কাজেই পাঠক ও সমালোচকদের উপলব্ধি ও মীমাংসায় এত তারতম্য। একটা সীমারেখা আছে এ তারতম্যের: সেটা ছাড়িয়ে গেলে বড়ো সমালোচককে অবহিত হ’তে হয়।’ (দাশ ১৯৫৪: ৫)
১
ইংরেজি ২০০৯ সালের গোড়ার দিকে—ঘটনাচক্রে এই ঘটনাও ‘আজ হইতে আট বছর আগে একদিন’ ঘটিয়াছিল—জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা প্রসঙ্গে কয়েকটি মন্তব্য আমিও প্রকটিত করিয়াছিলাম। লেখাটি ইংরেজি ভাষায় ছাপা হইবার কারণে অধিক প্রচারিত হয় নাই। তবে সম্প্রতি লেখাটির দ্বিতীয় মুদ্রণ সম্পন্ন হইয়াছে। (খান ২০১৭)
সেই লেখার বাংলা অনুবাদ করিবার অবসর আমার এখনও হয় নাই। আজিকার লেখাটিতেও তাহা করিব না। শুদ্ধ সেখান হইতে কিছু কথা ধার করিব। আমরা এ যাত্রা বলিতে চাহিব, জীবনানন্দ দাশ যে বস্তুকে ‘বিপন্ন বিস্ময়’ বলিয়া ডাক দিয়াছেন তাহার সহিত ফ্রয়েড কথিত ‘অজ্ঞান’ বা আরো নির্দিষ্ট করিয়া বলিতে মৃত্যুর তাড়না বা ‘বিরতির’ সাযুজ্য আছে।
‘আট বছর আগের একদিন’ নামের কবিতাটি ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হইয়াছিল। কবিতাটি পরে তাঁহার ‘মহাপৃথিবী’ নামক কবিতাপুস্তকে ঠাঁই পায়। যতদূর বুঝিতেছি এই কবিতার গোড়ার কথাটি অনেক সমালোচক ধরিতেই পারেন নাই। এই জাতীয় নির্বোধ—অবিমৃষ্যকারী—সমালোচনার এক উপকারী সংকলন একদা উপহার দিয়াছিলেন ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। (চৌধুরী ১৯৯৪)
ঐ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত এক প্রবন্ধে দেখা যায় স্বয়ং জীবনানন্দ দাশ এই জাতীয় সমালোচকদের ভয়ে ঘোষণা করিতে বাধ্য হইতেছেন, ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটিকে তাঁহার সমগ্র কাব্যের শ্রেষ্ঠ প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা জ্ঞানে গ্রহণ করা যায় না। তাঁহার ভাষায়, ‘ঐ কবিতাটির নিকষে আমার সমস্ত কাব্য অধ্যয়ন করতে যাওয়া ভুল।’ (দাশ ১৯৯৪ : ২৩)
জীবনানন্দ দাশ ঠিকই বলিয়াছিলেন, ‘বড়ো সমালোচককে অবহিত হ’তে হয়’। আমি খুব কম সমালোচককেই দেখিয়াছি যাঁহারা সত্যকার অবহিত হইয়া এই ধরনের সমালোচনায় হাত দিয়াছেন। এই অনবহিত সমালোচকদের মধ্যে কেহ কেহ একদা অনুযোগ করিয়াছিলেন, দাশ মহাশয়ের কোন কোন কবিতা আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়। অর্থাৎ এই কবি ভদ্রলোকটি সমাজের শত্রু না হইয়া যাইতে পারেন না।
জীবনানন্দ দাশকে জীবদ্দশায় খুব বেশি সমালোচক বুঝিয়া উঠিতে পারেন নাই—একথা মিথ্যা নয়। এই না বুঝিবার দায় অনেকে সমালোচকের ঘাড়ে না দিয়া উল্টা কবির গাত্রে চাপাইয়াছিলেন। যেমন তাঁহার কনিষ্ঠ সমসাময়িক কবি অজিত দত্ত একদিন—আমাদের কবির মৃত্যুর অল্পদিন পর—ঠিকই কহিয়াছিলেন, ‘জীবিতাবস্থায় তাঁর কাব্যের সম্পূর্ণ মর্যাদা যদি কবি জীবনানন্দ না পেয়ে থাকেন, তবে সেটা বিস্ময়কর কিংবা অস্বাভাবিক নয়।’ (দত্ত ২০০০: ১৪২)
কবির মৃত্যুর প্রায় দশ বছর পর লিখিত এক নিবন্ধযোগে কবি ও অধ্যাপক অজিত দত্ত পুনশ্চ লিখিয়াছিলেন, জীবনানন্দ দাশের ‘দুর্বলতার বীজ’ নিহিত তাঁহার ‘একা একা ঘুরে ঘুরে কথা বলা’ বা ‘আত্মকল্পনা তন্ময়তার মধ্যে’। অজিত দত্তের যুক্তি এই জায়গায় আরেকটু উদ্ধার করা যাইতে পারে। তাঁহার মতে জীবনানন্দের কবিতায় ‘কল্পনা ও ভাব’ তাঁহার শিল্পকে অনেক সময়ই অতিক্রম করিয়া গিয়াছিল। অজিত দত্ত লিখিতেছেন :
“জীবনানন্দের কল্পনা যে স্বপ্নলোকে বিচরণ করে, কবির সেই মানসজগৎ একান্তভাবে তাঁর স্বকীয় এবং পরিচিত কবি-কল্পনা থেকে অনেকাংশে পৃথক। সে কারণে, এই অনবদ্য কল্পনা যেখানে একটি সরল এবং সহজে হৃদয়ংগমযোগ্য সংগতিপূর্ণ শিল্পরূপ লাভ করতে না পেরেছে সেখানেই তা অস্পষ্টতা ও দুর্বোধ্যতার আবছায়ায় বিলীন হয়ে গেছে। এ কারণে ‘পাখীরা’, ‘শকুন’, ‘বনলতা সেন’, ‘সোনালি ডানার চিল’ প্রভৃতির মতো পরিপূর্ণরূপে সার্থক ও নিটোল কবিতার সংখ্যা জীবনানন্দের অপেক্ষাকৃত অল্প বলা চলে। অতিরিক্ত ভাবকল্পনা তন্ময়তার জন্য অনেক সময় তাঁর কবিতার ভাব ও বক্তব্যের যোগসূত্র হারিয়ে গেছে, এমন উদাহরণ ও জীবনানন্দের কবিতায় অপ্রচুর নয়।” (দত্ত ২০০০ : ১৪৬)
২
অজিত দত্তের এই সংক্ষিপ্ত তালিকায়—বলা হয়তো বাহুল্যই—‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতাটি দেখা যাইতেছে না। আর যাঁহাদের তালিকায়ও বা কবিতাটি উঠিয়াছে তাঁহারাও ইহার অর্থ ধরিতে সমর্থ হইয়াছেন এমন বলা যাইবে না। কারণটা একটু বিশদ করিতে হয়। প্রায় সকল সমালোচকই কবিতার ‘কল্পনা ও ভাব’ লইয়া এমন বুঁদ হইয়া ছিলেন যে তাঁহারা কবির ভাষার দিকে তাকাইবার সময় পান নাই। অথচ কবিতা লেখা হয় শেষ পর্যন্ত ভাষা দিয়াই।
ক্লিনটন বুথ সিলি এবং তাঁহার পূর্বগামী এডওয়ার্ড ডিমক জুনিয়ার—এই দুই মার্কিন অধ্যাপকও এই কবিতা লইয়া আলোচনা করিয়াছেন। (সিলি ১৯৯৯, ডিমক ১৯৭৪) কিন্তু তাঁহারা কেহই আমল করেন নাই যে এই কবিতার ঘটনাটি মোটেও সরল নয়। উদাহরণস্বরূপ—অধ্যাপক সিলি লিখিয়াছেন—‘ঘটনা বড়ই সরল : এক ভদ্রলোক আত্মহত্যা করিয়াছেন।’ (সিলি ১৯৯৯ : ১৩৭)
আমাদের বিচারে ঘটনা আদৌ এত সরল নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এই কবিতার আসল ঘটনাটি মোটেও আত্মহত্যা লইয়া নয়—সেই ঘটনার শ্রুতি লইয়া। কবিতার উদ্বোধনী স্তবকেই সেই কথাটি পরিষ্কার উৎকীর্ণ আছে—
শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে
তাহাকে লাসকাটা ঘরে লইয়া যাওয়া হইয়াছে। ঘটনাটা শোনা গিয়াছে, দেখা যায় নাই। তাহাতেও ঘটনাটা আবার আজ কিংবা কাল ঘটে নাই। ঘটিয়াছিল ‘আট বছর আগের একদিন’। সমালোচকগণ কথাটা খুব কমই আমল করিয়াছেন। পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি লইয়াও বলা চলে, জীবনানন্দ দাশ বড় সত্য কথাই বলিয়াছিলেন—‘বড়ো সমালোচককে অবহিত হ’তে হয়।’ শ্রুতি মানেই পুনরাবৃত্তি। এয়ুরোপের কোন কোন ভাষায় ‘প্রথম দৃষ্টিতে প্রেম’ বলিয়া একটা কথা চালু আছে। ভাবিয়া দেখিলে এক অর্থে কথাটার কোন সারই নাই। প্রেমে পড়ার একটা অর্থ তো ‘স্মরণ করা’—কথাটা সংস্কৃত শব্দে বলিতে গেলে ‘স্মরা’ শোনায়। পুনরাবৃত্তি ছাড়া আপনি স্মরিবেন কিভাবে? প্রেমের সহিত তাই পুনরাবৃত্তি অচ্ছেদ্য বন্ধনে জড়িত। জীবনানন্দ দাশের কবিতাটি তন্ন তন্ন করিয়া পড়িলে এই পুনরাবৃত্তির নিদর্শনই বারংবার পাওয়া যায়।
ফ্রয়েডের আবিষ্কৃত সত্য অনুসারে মানুষ ভাষার প্রজা অর্থাৎ কথা বলে এমন মানুষ মাত্রেরই দুই প্রকারের জ্ঞান হয়—সজ্ঞান ও অজ্ঞান। এখানে অজ্ঞান বলিতে জ্ঞানের অভাব বুঝায় না, বুঝায় অয়ের বা অভাবের জ্ঞান। এই অজ্ঞান যদি কোথাও না কোথাও থাকিয়া থাকে তবে তাহার প্রকাশও থাকিবে। এই প্রকাশই ঘটে পুনরাবৃত্তির আকারে। ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার মাথা অর্থাৎ শিরোনাম হইতে পা— অর্থাৎ শেষ পংক্তি পর্যন্ত ‘এই পুনরাবৃত্তির’ গল্প শোনা যায়। তবে একটা কথা, সর্বাগ্রে কান পাতিতে হইবে।
তাই বলিতে হয়, প্রথম পংক্তির ইশারাই আকলমন্দের জন্য যথেষ্ট ছিল। এই ঘটনা তো আজিকার নহে। এই ঘটনা একান্তই শ্রুতির, সুতরাং স্মৃতির। দেখিতেছি কবিতার পঞ্চাশৎ পংক্তিতে আসিয়াও কবিতার কথক তাহার শ্রোতৃবৃন্দকে স্মরণ করাইয়া দিতেছেন:
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
ইত্যাদি।
অনেকানেক সমালোচক লিখিয়াছেন, শুদ্ধ শেষের স্তবকটির কথা ছাড়িয়া দিলে—গোটা কবিতার জিজ্ঞাসাটা দাঁড়াইয়াছে এই বাক্যে: ভদ্রলোকটি কেন আপন জীবনের ইতি টানিলেন? তাঁহার কিসের অভাব? আমাদের মতে, প্রশ্নটা অন্য জায়গায়। প্রশ্নটা অভাবের নয়, ভাবের। প্রশ্ন হইতেছে, কবিতার কথক মহাশয় এই গল্পটি এতদিন পরে কেন স্মরণ করিলেন? অথচ আমাদের বড় সমালোচকেরা প্রশ্নটা আমলই করিলেন না।
(পুরুষ) মানুষের বাঁচিয়া থাকিতে হয় নানা অজুহাতে। অজুহাতের তালিকাটি সুদীর্ঘ। ইহার মধ্যে আছে নারীর হৃদয়, প্রেম, শিশু, গৃহ, আরো অনেক পদার্থ। আছে অর্থ, আছে কীর্তি, আছে সচ্ছলতা। কিন্তু এই তালিকাই একমাত্র বা শেষ কথা নয়। এই সব তাড়ার নাম যদি একযোগে দাঁড়ায় ‘রতি,’ তবে তাঁহার সমান এবং বিপরীত তাড়ার নাম ‘বিরতি’ ছাড়া আর কি হইবে! জীবনানন্দ দাশ এই ‘বিরতি’ ক্রিয়ারই নাম রাখিয়াছিলেন ‘বিপন্ন বিস্ময়’। শুদ্ধ ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার নয়, জীবনানন্দের আরো অনেক কবিতায় এই ‘বিস্ময়’ কথাটি ঘুরিয়া ফিরিয়া আসিয়াছে।
এই বিস্ময়ের ভাষার নাম সিগমুন্ড ফ্রয়েড রাখিয়াছিলেন ‘অতি আনন্দ’ (Jenseits des Lustpriûips বা Beyond the Pleasure Principle)। ফ্রয়েডের আবিষ্কার অনুসারে বলিতে গেলে দাঁড়ায়, এই ‘অতি আনন্দ’ মনুষ্য সন্তানের ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর ভর করিয়া চলে না। তাহার সহিত ভাব করিয়াই বরং মনুষ্যকে সংসার করিতে হয়।
১৯২০ সালে প্রকাশিত ‘অতি আনন্দ’ নামক এক প্রবন্ধে এই সত্যটাই ফ্রয়েড পরিষ্কার করিয়াছিলেন। তিনি দেখাইয়াছিলেন, ভাষার মধ্যেই সেই অনিবার্য মৃত্যু মূর্তি ধরিয়াছে। ভাষাই মানুষকে অমর করিয়াছে। পাঠিকা লক্ষ্য করিবেন, লোকটার মরিবার সাধ হইয়াছে। একমাত্র মানুষেরই এই মরিবার সাধ জাগিতে পারে। অথবা যুক্তিশীল পাঠিকা বলিতে পারেন, যাহার মরিবার সাধ জাগে কেবল সেই মানুষ নামের যোগ্য। তাহাকে জানিতে হয়। জানিবার বেদনা গাঢ়— তাহার ভার আছে।
জানিবার ভার মানে বিরতির বাসনা। জীবনানন্দ দাশ তাহারই নাম রাখিয়াছেন ‘উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা’। ফ্রয়েডের ভাষায় ‘থানাটোস’ বা বিরতি দেবতা। চমৎকার এই রূপান্তর।
ইহার পাশাপাশি রতির উদাহরণগুলি দেখিবেন বড়ই বিপরীত অর্থাৎ মানবেতর। ইহাদের মধ্যে আছে সারারাত জাগরীর পেঁচা। আর আছে জীবনানন্দ অনুরাগী গলিত স্থবির ব্যাং, আছে জীবনের স্রোতে প্রেমিক মশা। আরও আছে রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যাওয়া মাছি, আছে সোনালি রোদের ঢেউয়ে খেলা করা কত উড়ন্ত কীট! আছে প্রাণ বাঁচাইবার সংগ্রামে আপ্রাণ লড়াইরত ফড়িঙ। আছে বৃক্ষজীবন, অশ্বত্থের শাখা, আছে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে মাখামাখি করা জোনাকির ভিড়। আছে হেমন্তের বিকেলের সুপক্ক যবের ঘ্রাণ। তারপরও কেন এই বিরতির সাধ? কারণ মানুষ মাত্র জীব বা প্রাণী নয়। মানুষই একমাত্র প্রাণী যে কথা বলে। আকলমন্দের জন্য তাই একথা ভাবা কঠিন নয় কেন ‘জীবনের এই স্বাদ’—‘হেমন্তের বিকেলের সুপক্ক যবের ঘ্রাণ’—লোকটার অসহ্য বোধ হইল।
মর্গে তাহার হৃদয় জুড়াইল কিনা— এই প্রশ্ন মোটেও অপূর্ব নয়। আশা করি এতক্ষণে কবিতাটি আরও একবার মাথা হইতে পা পর্যন্ত পড়িবার জন্য আমরা তৈরি হইয়াছি।
দোহাই
১. অজিত দত্ত, প্রবন্ধ সংগ্রহ (কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ২০০০)।
২. জীবনানন্দ দাশ, জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ২য় সংস্করণ (কলকাতা : নাভানা, ১৯৫৬), ১ম সংস্করণ ১৯৫৪।
৩. জীবনানন্দ দাশ, ‘আট বছর আগের একদিন’, ফয়জুল লতিফ চৌধুরী (সম্পাদিত), জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’, (ঢাকা : দিব্য প্রকাশ, ১৯৯৪), পৃ. ২৩-২৪।
৪. ফয়জুল লতিফ চৌধুরী (সম্পাদিত), জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’, (ঢাকা: দিব্য প্রকাশ, ১৯৯৪)।
৫. Clinton B. Seely, A Poet Apart: A Literary Biography of the Bengali Poet Jibanananda Das (1894-1951), reprint (Calcutta: Rabindra Bharati Univeristy, 1999), 1st ed. 1990.
৬. Sigmund Freud, ‘Beyond the Pleasure Principle,’ tran. John Reddick (2003), in S. Freud, The Penguin Freud Reader, Adam Phillips, ed. (London: Penguin Book, 2006), pp. 132-195.
৭. Edward C. Dimock, Jr., ‘The Poet as Mouse and Owl: Reflections on a Poem by Jibanananda Das,’ Journal of Asian Studies, vol. 33, no. 4 (1974), pp. 603-610; reprinted in Faizul Latif Chowdury, ed., Essays on Jibanananda Das, 2nd ed (Dhaka: Pathak Shamabesh, 2017), pp. 57-68, 1st ed. 2009.
৮. Salimullah Khan, ‘Jibanananda After Lacan: Repetition Automatism and Death Drive in Bengali Literuture,’ in Faizul Latif Chowdury, ed. Essays on Jibanananda Das, ibid., pp. 82-103.
পরিশিষ্ট
আট বছর আগের একদিন
জীবনানন্দ দাশ
শোনা গেল লাসকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে—ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হ’লো তার সাধ;
বধূ শুয়েছিলো পাশে—শিশুটিও ছিলো;
প্রেম ছিলো, আশা ছিলো—জ্যোৎস্নায়—তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয়নি ঘুম বহুকাল—লাসকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এবার।
এই ঘুম চেয়েছিলো বুঝি!
রক্তফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মতো ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুঁজির বুকে ঘুমায় এবার;
কোনোদিন জাগিবে না আর।
‘কোনোদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম—অবিরাম ভার
সহিবে না আর—’
এই কথা বলেছিলো তারে
চাঁদ ডুবে চ’লে গেলে—অদ্ভুত আঁধারে
যেন তার জানালার ধারে
উটের গ্রীবার মতো কোনো এক নিস্তব্ধতা এসে।
তবুও তো পেঁচা জাগে;
গলিত স্থবির ব্যাং আরো দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগে
আরেকটি প্রভাতের ইশারায়—অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগে।
টের পাই যূথচারী আঁধারের গাঢ় নিরুদ্দেশে
চারিদিকে মশারির ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা;
মশা তার অন্ধকার সঙ্ঘারামে জেগে থেকে জীবনের স্রোতে ভালোবাসে।
রক্ত ক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি;
সোনালি রোদের ঢেউয়ে উড়ন্ত কীটের খেলা কতো দেখিয়াছি।
ঘনিষ্ঠ আকাশ যেন—যেন কোন্ বিকীর্ণ জীবন
অধিকার ক’রে আছে ইহাদের মন;
দুরন্ত শিশুর হাতে ফড়িঙের ঘন শিহরণ
মরণের সাথে লড়িয়াছে;
চাঁদ ডুবে গেলে পর প্রধান আঁধারে তুমি অশ্বত্থের কাছে
এক গাছা দড়ি হাতে গিয়েছিলে তবু একা-একা;
যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের—মানুষের সাথে তার হয়নাকো দেখা
এই জেনে।
অশ্বত্থের শাখা
করেনি কি প্রতিবাদ? জোনাকির ভিড় এসে সোনালি ফুলের স্নিগ্ধ ঝাঁকে
করেনি কি মাখামাখি?
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা এসে
বলেনি কি: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে
চমৎকার!
ধরা যাক্ দু-একটা ইঁদুর এবার!’
জানায়নি পেঁচা এসে এ তুমুল গাঢ় সমাচার?
জীবনের এই স্বাদ—সুপক্ক যবের ঘ্রাণ হেমন্তের বিকেলের—
তোমার অসহ্য বোধ হ’লো;
মর্গে কি হৃদয় জুড়োলো
মর্গে—গুমোটে
থ্যাঁতা ইঁদুরের মতো রক্তমাখা ঠোঁটে।
শোনো
তবু এ মৃতের গল্প; কোনো
নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই;
বিবাহিত জীবনের সাধ
কোথাও রাখেনি কোনো খাদ,
সময়ের উদ্বর্তনে উঠে এসে বধূ
মধু—আর মননের মধু
দিয়েছে জানিতে;
হাড়হাভাতের গ্লানি বেদনার শীতে
এ-জীবন কোনদিন কেঁপে ওঠে নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
জানি—তবু জানি
নারীর হৃদয়—প্রেম—শিশু—গৃহ—নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, সচ্ছলতা নয়—
আরো-এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত—ক্লান্ত করে;
লাসকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাসকাটা ঘরে
চিৎ হ’য়ে শুয়ে আছে টেবিলের ’পরে।
তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা,
থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে ব’সে এসে
চোখ পাল্টায়ে কয়: ‘বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি বেনোজলে ভেসে?
চমৎকার!
ধরা যাক দু-একটা ইঁদুর এবার—’
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো—বুড়ি চাঁদটারে আমি ক’রে দেবো
কালীদহে বেনোজলে পার;
আমরা দু-জনে মিলে শূন্য ক’রে চ’লে যাবো জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।
----------------------
উৎস : জীবনানন্দ দাশ, জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ২য় সংস্করণ (কলকাতা : নাভানা, ১৯৫৬), পৃ. ৭৩-৭৬।