দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ অথবা নতুন মহাভারত প্রসঙ্গে
‘দীনেশ সেনকে আমরা প্রকারান্তরে বাঙালী জাতের সামাজিক ইতিহাসের উদ্ধারকর্তারূপে সম্মান করতাম। ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার গবেষণার একদিকে আর দীনেশ সেন আর একদিকে,—এইরূপ ছিল ধারণা। তখনকার দিনে এই দুজনই ছিলেন ঐতিহাসিক গবেষণার পথ-প্রদর্শক।... দীনেশ সেনের সাহিত্য-ব্যাখ্যার ভেতর ধর্ম, দেবদেবী, পূজা-পার্বণ, হাঁচি-টিকটিকি ইত্যাদি অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠানের প্রভাব খুব বেশী। কিন্তু সাহিত্যের উপর ধর্মের একচাটিয়া প্রভাব দেখানো সাহিত্য-সমালোচকদের পক্ষে মস্ত দোষ। ঐতিহাসিক ও সাহিত্য-সমজদার দীনেশ সেনের অসম্পূর্ণতা আমি সেকালেও দেখেছি, একালেও দেখে থাকি। তবুও দীনেশ সেনকে তখনকার মতন এখনও বঙ্গবীর, বঙ্গনায়ক, সার্বজনিক বাঙালী ছাড়া আর কিছু ভাবি না।’
—বিনয় কুমার সরকার, ১৯৪২ (মুখোপাধ্যায় ২০০৩ : ১৮৩ ও ২৮৭)
‘পর্দা উঠিবামাত্র ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথমাঙ্কেই আমরা আর্য-অনার্যের প্রচণ্ড জাতিসংঘাত দেখিতে পাই। এই সংঘাতের প্রথম [পর্বে] প্রবল বেগে অনার্যের প্রতি আর্যের যে বিদ্বেষ জাগিয়াছিল তাহারই ধাক্কায় আর্যেরা নিজের মধ্যে নিজে সংহত হইতে পারিল।... এই সমস্ত ইতিহাসকে ঘটনামূলক বলিয়া গণ্য করিবার কোনো প্রয়োজন নাই, আমি ইহাকে ভাবমূলক বলিয়া মনে করি। ইহার মধ্যে তথ্য খুঁজিলে ঠকিব, কিন্তু সত্য খুঁজিলে পাওয়া যাইবে।’
—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৯১২ (ঠাকুর ১৩৯৫ : ১৮ ও ২৮)
ইংরেজি ১৮৬৬ সালের নবেম্বর মাসে-কেহ বলেন মাসের তিন তারিখে, কেহ বা বলেন ছয় তারিখে-দীনেশচন্দ্র সেনের জন্ম। এইভাবে হিশাব কষিতে বসিলে দেখা যাইবে, গত বছর-মানে ২০১৬ সাল নাগাদ-তাঁহার বয়স একশত পঞ্চাশ বছর নিরবে পার হইয়া গিয়াছে। জসীম উদ্দীন কিংবা আহমদ ছফা—এই দুইজনের কোন একজনও যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন এই মহাত্মা পুরুষের বড় দিনটি হয়তো এত নিঃশব্দে পার হইত না।
এই বক্তৃতা দিবার উপযুক্ত মানুষ শহর ঢাকায় একজনই ছিলেন। তাঁহার নাম জসীম উদ্দীন। দ্বিতীয় জনের নাম করিতে হইলে আমি আহমদ ছফার নামটা স্মরণ করিব। আমি কোন বিচারেই তাঁহাদের স্থলে অভিষিক্ত হইবার যোগ্য নহি। গত বছর কি ভাবিয়া বা না ভাবিয়াই একবার উচ্চারণ করিয়াছিলাম, তবে কি এতদ্দেশে দীনেশচন্দ্র সেনের নামতা কেহ আর মুখে আওড়াইবেন না! দেখিলাম, দেয়ালেরও কান আছে। বাংলাদেশের জাতীয় জাদুঘর তাহাই প্রমাণ করিয়াছেন। বরং বিলম্বে কদাচ নাস্তি নহে! আর দায়টা পড়িবি তো পড়িলি দূতের ঘাড়ে! ‘দূত অবধ্য’ কথাটার আমরা অবাধ্য হইলাম!
দীনেশচন্দ্র সেনের সাধনা বিষয়ে বক্তৃতা লিখিবার কোন যোগ্যতাই আমার নাই। আমি এমনই ভাগ্যবঞ্চিত যে-দীনেশচন্দ্র দূরের কথা-জসীম উদ্দীনেরও দেখা পাই নাই। ভাগ্যের মধ্যে, আহমদ ছফার পদতলে দাঁড়াইয়া দুই চারি বৎসর বিদ্যাভ্যাসের সুযোগ পাইয়াছিলাম। সত্যের অনুরোধে বলিতেছি, আহমদ ছফার বাক্য শ্রবণ না করিলে হয়তো দীনেশচন্দ্রের সহিত আমার পরিচয় আরও বহুদিন পরাহত হইয়াই থাকিত। আজিকার এই বক্তৃতা তাই আমি মহাত্মা আহমদ ছফার নামেই উৎসর্গ করিতে বাঞ্ছা করিয়াছি। দুঃখের মধ্যে, বলিবার মতন তেমন নতুন কথা আমার বিশেষ নাই। আমি শুদ্ধ কয়েকটি কথার তাৎপর্য কি তাহা বিচার করিতে সাহস করিয়াছি। বাকি আপনাদের কৃপা।
অতি সম্প্রতি মহাত্মা আহমদ ছফার একটি দুর্লভ কবিতা আমাদের হাতে পড়িয়াছে। প্রথম প্রকাশের সনতারিখ দেখিয়া মনে হয় ইহা তাঁহার বিশ-একুশ বছর বয়সের রচনা। কবিতাটি মহাত্মার জীবদ্দশায় প্রকাশিত কোন কেতাবপত্রে কিংবা তাঁহার মৃত্যুর পরে সম্পাদিত রচনাবলিতে আজ পর্যন্ত স্থান পাইয়াছে বলিয়া আমরা জানি না। ইহাতে দেখা যায় কোন এক সন্তান পায়ে হাঁটিয়া প্রয়াত পিতার কবর জিয়ারতের অভিজ্ঞতা লিখিতেছেন। তাহা সত্ত্বেও আমার কেন জানি মনে হইল, এই কবিতার তাৎপর্য নিতান্ত পরিবার ও ব্যক্তিগত বেদনায় সীমাবদ্ধ নাও থাকিতে পারে। ইহার ছায়া জাতীয় জীবনেও পড়িতে পারে। আহমদ ছফা এখানে যে জনকের কথা বলিতেছেন সেই জনকের সহিত আমাদের ভাষার কোথায় যেন একটা সংযোগ আছে। দীনেশচন্দ্র সেনের স্মৃতির উদ্দেশে আহমদ ছফা ১৯৯৫ সালে একবার ভক্তি নিবেদন করিয়াছিলেন। ১৯৯৭ সালে আরেকবার।
সবিনয় সংযোগ করি, ১৯৬৪ সালে লেখা তরুণ আহমদ ছফার ‘জনকের কবরে’ নামধেয় এই কবিতাটিও দীনেশচন্দ্র সেনের স্মৃতির উদ্দেশে নতুন করিয়া নিবেদন করা যাইতে পারে। দীনেশচন্দ্র সেনকে বাদ রাখিয়া বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস লেখা হইবে কি করিয়া! একালের বাংলা সংস্কৃতির জনক জ্ঞান করিয়াই মাত্র আমরা তাঁহার কীর্তির যথোপযুক্ত মূল্য নিরুপণ করিতে পারি। আমেন।
অধরে কথার ঢেউ, চিন্তা আর চাঞ্চল্যের শিখা
দিগন্তে ফেরারী হল, আধবোঁজা পৃথিবীর চোখ—
অচেনা বাঁধনে তার দিব্যরূপরেখা
বেঁধেছে আমারে আহা, স্বপ্নময় যেন দুই তীর
মাঝখানে বয়ে যায় জীবনের বেগবান নদী।
যখন পেছনে চাই জনকের ডাক কানে বাজে
ভেসে আসে সঙ্গীতের সুরেলা ঝঙ্কার,
শিরায় রোমাঞ্চ জাগে, বেতস লতার বনে
ফিরে যাই, শিশু হই-মনে মনে বলি বারবার
অসম্ভব যতো কথা-পিতৃছবি আঁখিকোণে আঁকি।
চলে যাই আরো আগে যখন ফুটেছে ঠোঁটে
আধো আধো বোল, জনকের চোখে চোখ রেখে
যখন কয়েছি কথা, প্রাণ খুলে কত অকপটে।
হাজারো জান্নাত আমি গড়িয়ে দিয়েছি কত
জীবনের যৌবনের স্রোতে-তারপর আমি গেছি
বন্ধুহীন বিয়াবানে প্রাণের পরশ পেতে
মেকীর বাজারে, আব্বাজান, কি আমি পেয়েছি?
তোমার কবরে আজ ধীরে ধীরে সন্তর্পণে এসে
সবুজ দুর্বার সাথে কিছুক্ষণ কথা কয়ে
সজল নিশ্বাসে পুনঃ ফিরে চলে যাই
দুইটি তরল মুক্তা এই দুই আঁখিকোণে লয়ে।
১
পরলোকগমনের কিছুদিন আগে কবি জসিম উদ্দীন কলিকাতার একটি বনিয়াদী পত্রিকাযোগে দীনেশচন্দ্র সেনের স্মৃতিকথা নতুন করিয়া লিখিয়াছিলেন। ১৯৭৬ সাল নাগাদ-আমাদের কবিবর এই ইহলোক ছাড়িবার সামান্য কিছুদিন পর-‘স্মরণের সরণী বাহি’ নামের সেই স্মৃতিকথাটি বই আকারেও ছাপা হইয়াছিল। এই স্মৃতিকথার এক জায়গায় কবি লিখিতেছেন, ‘কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বৎসরগুলিতে দীনেশবাবুর জীবন বড়ই অসহায় ছিল। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের দল তাঁহাকে বড়ই কোণঠাসা করিয়া ফেলিয়াছিলেন। শনিবারের চিঠি ‘শ্রীদীনেশ’ নাম দিয়া ধারাবাহিকভাবে তাঁকে গালাগালি দিতেছিল।’ (জসীম উদ্দীন ২০০০ : ৫৭)
এই জায়গায় পৌঁছিয়া কবি জসীম উদ্দীন যোগ করিতেছেন, ‘একদিন আমি তাঁকে বলিলাম, ‘আপনার বিরুদ্ধে লোকে এত কিছু লেখে। আমাদের সহ্য হয় না। আপনি এদের ওপর মানহানির মকদ্দমা করেন না কেন?’ তিনি বলিলেন, ‘এরা আর কত শত্রুতা করবে? আমার সবচাইতে বড় শত্রু মরণ আমার সামনে এসে খাড়া হয়ে আছে। এ শত্রুর বিরুদ্ধে কোন আদালতে নালিশ করব বলতে পার?’ (২০০০ : ৫৭-৫৮)
বাংলাদেশের একজন প্রায় ‘জাতীয় কবি’ পদবাচ্য কবি প্রণীত এই কাহিনী হইতেও আমরা আজ কিছু পরিমাণে আন্দাজ করিতে পারি, দীনেশচন্দ্র সেন মানুষটা কোন ধাঁচের ছিলেন। তিনি কি জানিতেন, মরণের চেয়েও ঘোর আরেক শত্রু মরণের পর তাঁহার ঘাড় ভাঙ্গিবার অপেক্ষায় বসিয়াছিল? এই বিখ্যাত শত্রুর নাম কাল বা বিস্মৃতি। তাঁহার রচিত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ যে একদিন তাঁহাকে বিস্মৃতির অতলে তলাইয়া দিবে তাহা কি তিনি কদাচ ভাবিতে পারিয়াছিলেন? জসীম উদ্দীনের উপরোক্ত স্মৃতিকথা প্রকাশের কিছুদিন পর দীনেশবাবুর পুত্রের ঘরে নাতি স্বনামধন্য কবি সমর সেনও ‘বাবুবৃত্তান্ত’ নামক এক বিখণ্ড আত্মকথায় অভিযোগ করিতেছিলেন, ‘ঠাকুর্দা দীনেশচন্দ্র সেন পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতায় আসেন গত শতাব্দীর শেষ দিকে। তাঁর খণ্ড আত্মজীবনী আছে ‘ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য’ গ্রন্থে। বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে দীনেশচন্দ্রের অক্লান্ত অনুরাগ ও গবেষণায় অসাধারণ (অনেক সময় পদব্রজে) পরিশ্রমের কথা, তাঁর পথিকৃতের ভূমিকা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছে।’ সমরবাবু সেদিনকার ঐ খণ্ডিত বয়ানে আরও যোগ করিতেছিলেন, ‘তাঁর তথ্যগত ভুলভ্রান্তি পণ্ডিতেরা খুঁজিয়া দেখিয়াছেন, কিন্তু তাঁর অকৃত্রিম অনুরাগের ছিটেফোঁটা এঁদের থাকলে বাংলা সাহিত্য সমৃদ্ধতর হতো।’ (সেন ২০০৪ : ১৫)
একই প্রসঙ্গ ধরিয়া জসীম উদ্দীন আবার লিখিয়াছেন, ‘দীনেশবাবু বড় ভাবপ্রবণ ছিলেন। তিনি সাহিত্য সমালোচনা করিতেন তাঁর সেই ভাবপ্রবণ অন্তর দিয়া। তাই তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ পুস্তকের সন-তারিখে কিছু কিছু ভুল ছিল। সেই তিলকে তাল বানাইয়া তাঁহার বিরুদ্ধপক্ষরা তাঁকে হেয় করিতে চেষ্টা করিতেন। সাহিত্যের ইতিহাস লেখা মানে লেখকদের জন্মের বা আবির্ভাবের সন-তারিখ লইয়া গবেষণা করা নয়। সাহিত্যের ইতিহাস-লেখকের কাজ যুগের সাহিত্যরথীদের রসভাণ্ডারে প্রবেশ করিয়া তাহা পাঠকদিগকে আস্বাদন করাইয়া দেওয়া। তাঁহাদের রচনার মর্মকথাটির সঙ্গে তাঁহাদের প্রকাশভঙ্গিমার বৈশিষ্ট্য বলিয়া দেওয়া। যে যুগে তাঁহারা আবির্ভূত হইয়াছিলেন সেই যুগের ইতিহাস সমাজজীবন প্রভৃতির সঙ্গে তাহার ভাবধারা লইয়া আলোচনা করা। ইংরাজি সাহিত্যের ইতিহাস যাঁহারা লিখিয়াছেন, যতদূর মনে হয় তাঁহারাও উপরোক্ত আদর্শ সামনে রাখিয়া তাঁহাদের পুস্তক রচনা করিয়াছেন। কিন্তু দীনেশবাবুর শেষজীবনে তাঁহার বিরুদ্ধ পক্ষেরা তাঁহার পুস্তকের সামান্য ভুল-ত্রুটি লইয়া তাঁহার জীবন দুর্বিষহ করিয়া তুলিতেছিলেন।’ (জসীম উদ্দীন ২০০০ : ৫৮)
বিশ্ববিদ্যালয় হইতে অবসর লইবার পর দীনেশচন্দ্র সেন তাঁহার ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইখানি লিখিতে শুরু করেন। এই গ্রন্থই—বইয়ের উৎসর্গপত্রে তিনি আশংকা প্রকাশ করিয়াছিলেন—সম্ভবত তাঁহার হাতে লিখিত শেষ গ্রন্থ হইতে যাইতেছে। জসীম উদ্দীন স্মরণ করিতেছেন : ‘বাংলাদেশের ওপর এ পর্যন্ত যত বইপুস্তক ছাপা হইয়াছে, জেলাওয়ারিভাবে যতগুলি জেলার ইতিহাস লেখা হইয়াছে, হিন্দু-সমাজের নানা বর্ণের যেসব “কুলপরিচয়” গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছে সবগুলি সংগ্রহ করিয়া এই জ্ঞানসাধক মহাতপস্যায় সমাসীন হইলেন। সকাল হইতে দুপুর-দুপুর হইতে সন্ধ্যা কি একাগ্রভাবে তাঁহার অধ্যয়ন চলিতে লাগিল! তিনি শুধু পড়িতেন না, পড়িয়া পড়িয়া নোট গ্রহণ করিতেন। খাতার পর খাতা ভর্তি হইয়া চলিল। এইভাবে প্রায় বৎসরখানেক চলিয়া গেল। এইবার তিনি তাঁহার মহাগ্রন্থ রচনা আরম্ভ করিলেন। “বৃহৎ বঙ্গ” তো নয়—বাঙালি জাতির অতীত জীবনের মহাভারত।’ (২০০০: ৫৯)
বলা বাহুল্য নহে, ‘বৃহৎ বঙ্গ’ লিখিবার সময় দীনেশচন্দ্র সেনের বয়স হইয়াছে। কিন্তু তাঁহার পরিশ্রমের যেন বয়স নাই। জসীম উদ্দীন সেই দিনের কাহিনী আবারও বলিতেছেন : ‘আবার সেই সকাল হইতে দুপুর-দুপুর হইতে সন্ধ্যা-সন্ধ্যা হইতে অর্ধরাত। অতীতের মহা তিমিরাবরণ ভেদ করিয়া বাঙালি জাতির যেখানে যত গৌরবের কথা, শিল্পকলার অমর অবদানের কথা ভেলকিবাজির মতো দুই হাতে কুড়াইয়া আনিয়া তিনি তাঁর মহাগ্রন্থে শামিল করিতে লাগিলেন।’ (২০০০ : ৫৯)
তিনি কিভাবে কাজ করিতেন তাহার একটা অন্তরঙ্গ ছবিও পাওয়া যাইতেছে জসীম উদ্দীনের এই লেখায় : ‘এই সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাঁহার পাশে বসিয়া থাকিয়াছি। সত্তর বৎসরের বৃদ্ধ যেন নবযৌবনের উদ্যম ও দীপ্তি পাইয়াছেন। বাহিরের কোন কোলাহল-কোন দুর্ঘটনার সংবাদ কিছুই তাঁহাকে এই মৌন তপস্যা হইতে বিরত করিতে পারে নাই। লোকজন আসিয়াছে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে। তিনি অভ্যাগত কাহাকেও ফিরাইয়া দিতেন না। তাহাদের সঙ্গে কথা বলিতেন, সেই সঙ্গে তাঁহার লেখনীও সমানে চলিয়াছে। তাঁহার সেই ধ্যানময় জগতে তখনও তিনি সমান বিরাজমান। এই সময়ে তাঁহার বড় আদরের নাতনি পরী মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িল। এই ছোট্ট মেয়েটি সবসময়ই তার দাদুর কাছে থাকিত। কত আপনজনের চিরবিদায়-বার্তা তাঁহার কানে পৌঁছিল। চোখের জল মুছিতে মুছিতে তখনও তিনি সমানে লিখিয়া চলিয়াছেন। কত বড় বিরাট পুস্তক। সুদীর্ঘ দুই বৎসরের মধ্যে তিনি তাঁর জীবনের শেষ দান “বৃহৎ বঙ্গ’ —বাংলাদেশকে যাঁহারা ভালোবাসেন তাঁহাদের জন্য এক নূতন মহাভারত-লিখিয়া শেষ করিলেন। (২০০০: ৫৯-৬০)
কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হইতে বৃহৎ বঙ্গ দুই খণ্ডে প্রকাশ পাইল (প্রথম সংস্করণের আখ্যাপত্র অনুসারে বলিতেছি) যথাক্রমে বাংলা ১৩৪১ ও ১৩৪২ সনে। দীনেশচন্দ্রের মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর পরে জসীম উদ্দীন চাপা আবেগে স্মরণ করিতেছেন, ‘তিনি ভাবিয়াছিলেন এই পুস্তক প্রচারিত হইলে তিনি আবার তাঁহার সেই পূর্ব-গৌরব ফিরিয়া পাইবেন। [বঙ্গ]ভাষা ও সাহিত্য লিখিয়া একদিন তিনি দেশের বিদ্বজ্জনমহলে যে উৎসাহ ও সম্মান পাইয়াছিলেন আবার তেমনি বাংলার সুধীজন এই পুস্তক পড়িয়া কলরবে মুখরিত হইয়া উঠিবেন, কিন্তু তাহা হইল না।’ (২০০০ : ৬০)
কেন হইল না? জসীম উদ্দীন একটা উত্তর দিয়াছেন বটে, তবে তাহাতে তিনিও ঘটনার গোড়ায় হাত দিতে পারেন নাই। একটু পরেই আমরা তাহা দেখিব। এক্ষণে কবির কথায় ফিরিয়া আসি। তিনি লিখিয়াছেন, ‘আজ আর রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী নাই। সেই গ্রিয়ারসন সাহেব নাই। অক্ষয়কুমার [মৈত্রেয়] মহাশয় নাই, বিশ্বকোষের নগেন্দ্র [নাথ] বসু মহাশয় বাঁচিয়া নাই। সেই বিদ্যোৎসাহী ত্রিপুরার মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যও বাঁচিয়া নাই। গগণেন্দ্রনাথ [ঠাকুর] তিরোধান করিয়াছেন। কে আর আন্তরিক দরদ লইয়া এই বিরাট পুস্তকের নান্দী গাহিবেন!’ (২০০০ : ৬০)
অথচ তাঁহার নিন্দুকেরা দিব্য জাগিয়া আছেন। তাঁহারা সমানে দূর্গে তোপ দাগাইতেছেন। অধিক কি, তাঁহারা চারিদিকে পাহারাও বসাইয়াছেন। দীনেশচন্দ্র পলাইবেন কোথায়! জসীম উদ্দীন লিখিয়াছেন, ‘তাঁহার বিরুদ্ধপক্ষীয়রা যে চারিদিকে তাঁহার জন্য নির্মম ষড়যন্ত্র-জাল পূর্ব হইতে বিস্তার করিয়া রাখিয়াছিলেন! তাঁহারা নানান পত্রপত্রিকায় শকুনির মতো এই পুস্তকের কোথায় কোন ভুল আছে তাহাই খুঁজিয়া লইয়া তাঁহার প্রতি লোষ্ট্র নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন।’ (২০০০ : ৬০)
এতদিনে তাঁহার আত্মীয়রা তাঁহাকে একপ্রকার ত্যাগই করিয়াছেন। জসীম উদ্দীনের বাক্যে বলিতে : ‘যাঁহারা তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় নিজদিগকে প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিয়াছিলেন তাঁহারা কেহই তাঁহাকে এই বিরুদ্ধদলের আক্রমণ হইতে রক্ষা করিতে আগাইয়া আসিলেন না। মনীন্দ্রলাল বসু, বিশ্বপতি চৌধুরী, সুবোধ সেনগুপ্ত প্রমুখ তাঁর স্নেহচ্ছায়ায় বর্ধিত বহু সাহিত্যিক তখনও আপনাপন কর্মশক্তি লইয়া প্রসিদ্ধ। তাঁহারা কেহই তাঁহাকে এই সময় শত্রুবূহ্য হইতে রক্ষা করিতে আগাইয়া আসিলেন না। বরং কেহ কেহ যাইয়া অপরপক্ষে যোগদান করিয়া তাঁহাদের বিষোদ্গারণে সাহায্য করিলেন। যে শরৎচন্দ্রকে তিনি একদিন সুদীর্ঘ প্রবন্ধ লিখিয়া সাহিত্যিক সমাজে প্রতিষ্ঠিত করাইয়াছিলেন তিনিও তাঁহার জন্য এই সময়ে একফোঁটা কলমের কালি খরচ করিলেন না।’ দীনেশচন্দ্রের শত্রুপক্ষ কিন্তু তাঁহাকে মোটেও ক্ষমা করিয়া কথা বলেন নাই। জসীম উদ্দীন সেদিনের ভয়াবহতা এভাবে স্মরণ করিয়াছেন : ‘শনিবারের চিঠি এই পুস্তক পড়িয়া লিখিলেন, দীনেশবাবুর মাথায় সুপারি রাখিয়া হাতুড়ি পেটানো উচিত। কেহ কেহ এর চাইতেও কঠোর কথায় এই অমর পুস্তকের নিন্দাবাদ করিলেন।’ (২০০০ : ৬০)
দুঃখের মধ্যে, ‘এই পুস্তকের কোথায় তিনি তাঁর দরদী অন্তর লইয়া বাঙ্গালির অতীত জীবনের কোন অখ্যাত অজ্ঞাত কাহিনী খুঁজিয়া বাহির করিয়াছেন কেহই তাঁহার সন্ধান করিল না।’ জসীম উদ্দীন আক্ষেপ করিতেছেন, ‘এই অশীতিপর বৃদ্ধ বয়সে এত বড় বিরাট পুস্তক লিখিতে কিছু কিছু ভুলভ্রান্তি তাঁহার হইয়াছিল। কোন কোন জায়গায় স্বমতবিরুদ্ধতাও রহিয়াছে। পরবর্তী সংস্করণে তিনি হয়ত তাহা সংশোধন করিয়া লইতেন। কিন্তু কবিতার মতো এমন সুপাঠ্য করিয়া তিনি যে এই ইতিহাস পুস্তক রচনা করিলেন সেদিকে তো কেহই দৃষ্টিপাত করিলেন না।’ (২০০০ : ৬১)
এক্ষণে জসীম উদ্দীন স্পষ্টাক্ষরে নিজের মতটি প্রকাশ করিতে আর কসুর করিলেন না। তাঁহার রায় এই: ‘বস্তুত সাহিত্যধর্মী ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই পুস্তক গিবনের পৃথিবীর ইতিহাসের মতো চিরকাল একটি আদর্শ হইয়া থাকিবে।’ তিনি পশ্চাৎ পশ্চাৎ জিজ্ঞাসাও করিলেন, ‘বাংলা ভাষায় বৃহৎ বঙ্গের মতো এমন সুপাঠ্য ইতিহাস-পুস্তক কি এ পর্যন্ত কেহ রচনা করিতে পারিয়াছেন?’ উত্তর বলাই বাহুল্য—না। জসীম উদ্দীন বলিয়াছেন, ‘এই পুস্তকে গঙ্গার মহিমা, বীতপাল-ধীমানের কাহিনী, দীপঙ্কর-চৈতন্যদেবের আবির্ভাব, বৈষ্ণব সাহিত্য, সিরাজদ্দৌলার শেষ জীবন, বাংলার শাড়ি-শিল্পের কথা প্রভৃতি অধ্যায়ে দীনেশবাবু যে অপূর্ব পাণ্ডিত্য আর কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়াছেন তাহা ভাবিয়া বিস্মিত হইতে হয়।’ (২০০০ : ৬১)
দীনেশচন্দ্র সেনের সেদিনকার দুরাবস্থার সামান্য বিবরণ আবারও পাইতেছি জসিম উদ্দীনের লেখাতেই। তিনি সাক্ষ্য দিতেছেন : ‘এই গ্রন্থ লিখিয়া তিনি অনেকের কাছে অভিমত চাহিয়া পাঠান। আমাকেও তিনি বারবার আদেশ করেন এই গ্রন্থের উপরে কিছু লিখিতে। নিজে কিছু লিখিয়া যাঁর এতটুকু মতামত পাইলে গৌরবে আত্মহারা হইয়া উঠিতাম, তাঁহার পুস্তকের উপরে আমি আর কি অভিমত দিব! আমি এ বিষয়ে তাঁহাকে এড়াইয়া যাইতাম। একদিন তিনি রাগত হইয়া আমাকে বলিলেন, “বারবার বলিয়াও আমার বইয়ের উপরে তোমার মতামত পাইলাম না।” আমি বলিলাম, “আমাকে আর কদিন সময় দেন। আমি আপনার বইখানা আবার পড়ে ভাল করে একটি সমালোচনা লিখে দেব।” তিনি বলিলেন, “না, এখনই তুমি যা হয় লিখে দাও।”’ (২০০০ : ৬১)
করুণাসিক্ত সজল ভাষায় জসীম উদ্দীন লিখিতেছেন, ‘কাগজ-কলম লইয়া কিছু লিখিয়া দিলাম। তিনি অতি যত্নের সঙ্গে তাহা পকেটে পুরিলেন। আমার চক্ষু দুইটি অশ্রুসজল হইয়া উঠিল। সেই মহামহীরূহ হিমাচল আজ তাঁর পুস্তকের উপর আমার মতামতের জন্য—আমার মতো একজন নগণ্য লোকের মহামতের জন্য—এত উদগ্রীব! এ যেন একটি স্রোতেপড়া লোক তৃণখণ্ডের আশ্রয় খুঁজিয়া বেড়াইতেছেন। কিছুদিন পরে দেখিলাম, “বৃহৎ বঙ্গে”র শেষের দিকে আমার সেই লেখাটি ছাপা হইয়াছে।’ (২০০০: ৬১-৬২)
২
‘বৃহৎ বঙ্গ’ প্রকাশিত হইয়াছিল ১৯৩৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর। প্রকাশিত হইবার পর পরই দীনেশচন্দ্র সেন ইহার দুই খণ্ডের একপ্রস্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে পাঠাইয়া দেন। ঠিক কত তারিখে পাঠান হইয়াছিল তাহা সঠিক জানা যাইতেছে না। তবে ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ তারিখে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পত্রে দেখা যায় এই বৃহৎ বইটি তাঁহার দরবারেও হাজির হইয়াছে বা হইবার আর বেশি দেরি নাই। পত্রপ্রাপকের উদ্দেশে কবি ঐদিন লিখিয়াছিলেন, ‘নন্দলাল এখনো কলকাতায়। ফিরে এলে বৃহৎ বঙ্গে দৃষ্টিক্ষেপ নিশ্চয় করব।’ (ঠাকুর ১৪০২ : ৫৮)
এই চিঠির পরের অংশটুকুতে চোখ বুলাইলেই পরিষ্কার হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি অকারণে জানি ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটির উপর বড় একটা সদয় নহেন। সজ্জনেরও ছলের অভাব ছিল না : ‘শরীর যে ক্ষণভঙ্গুর আমার দেহ প্রতিদিন তার নিঃসংশয় প্রমাণ নিয়ে উপস্থিত হচ্চে। এতদিন মন তাকে বহন ক’রে জীবযাত্রায় সারথ্য করছিল, কিন্তু বাহন এখন পিছনের দিকে ঘন ঘন লাথি ছুঁড়তে সুরু করেছে-পিঁজরাপোলের অভিমুখে তার সমস্ত ঝোঁক, বোঝা যাচ্চে লাগামটা ফেলে দিয়ে স্বেচ্ছায় যদি না নেমে পড়ি তাহোলে ঝাঁকানি দিয়ে নামিয়ে ফেলবে হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে। এ অবস্থায় আমার কাছে যদি কিছু প্রত্যাশা করো তাহোলে তা পূরণের চেষ্টায় আমার নিঃস্বতা প্রকাশ পাবে। পূর্ব্বকালের তহবিলের মাপে এখনকার দাবী অসঙ্গত হবে।’ (ঠাকুর ১৪০২ : ৫৯)
রবীন্দ্রনাথের ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৬ তারিখের চিঠিটি দীনেশচন্দ্রের হাতে আদৌ-অন্তত ৩০ মার্চ পর্যন্ত-পৌঁছিয়াছিল কিনা পরিষ্কার নহে। চিঠিতে প্রযুক্ত সম্বোধন আর ক্রিয়াপদের প্রয়োগ দেখিলে মনে হয় চিঠিটি ঠিক দীনেশচন্দ্র সেন সমীপে লেখা নহে-হইতে পারে তাঁহার পরিবারের অন্য কাঁহারো সমীপে লেখা। প্রায় এক মাসের ব্যবধানে ৩০ মার্চ ১৯৩৬ তারিখে লেখা একটি চিঠিতে দীনেশচন্দ্র সেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে পুনশ্চ তাগাদা দিতেছেন, ‘নন্দলালবাবুর সঙ্গে আপনার জন্য এক সেট “বৃহৎ বঙ্গ” (দুই খণ্ড) পাঠাইয়াছিলাম। তাহার প্রাপ্তিস্বীকার করিবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসে তাহা দাখিল করার দরকার হইয়াছে।’ (ঠাকুর ১৪০২ : ৯৭)
রবীন্দ্রনাথের হইয়া তাঁহার ব্যক্তিগত সচিব অনিলকুমার চন্দ ৪ এপ্রিল ১৯৩৬ নাগাদ উপরোক্ত পত্রের উত্তরস্বরূপ প্রাপ্তিস্বীকার করিয়া লিখিলেন, ‘আপনি নিতান্ত অনুগ্রহপরবশ হইয়া যে এক সেট “বৃহৎ বঙ্গ” (১ম ও ২য় খণ্ড) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে পাঠাইয়াছিলেন তাহার প্রাপ্তিস্বীকারপূর্বক তাঁহার পক্ষে আপনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করিতেছি।’ (ঠাকুর ১৪০২ : ১৪১)
৩০ মার্চের উপরোক্ত পত্রযোগে দীনেশচন্দ্র অধিক লিখিয়াছিলেন : ‘এই পুস্তক দশ বার বৎসর খাটিয়া লিখিয়াছি, সুতরাং আপনার মত ব্যক্তির নিকট তাহার একটা সমালোচনা চাহিয়া চিঠি লিখিয়াছিলাম, যদি আপনার স্বাস্থ্য ও অনবকাশ বশত আপনি তাহা না লিখিতে পারেন, তবে ক্ষুদ্র একটি মন্তব্যের সৌজন্য হইতে কেন বঞ্চিত হইব, তাহা বুঝিতে পারি না। এই পুস্তকের অনেক স্থলে আপনার কথা বহু সম্মানের সহিত উল্লেখ করিয়াছি। যিনি সমস্ত জগৎ কর্ত্তৃক অভিনন্দিত, আমার মত ব্যক্তির সেইরূপ লেখা তিনি উপেক্ষা করিতে পারেন। আমি যাহা চাহিয়াছি তাহা দাবী নহে, অনুগ্রহ, সুতরাং অনুগ্রহপ্রার্থীর কিছুতেই ক্ষুণ্ণ হইবার অধিকার নাই।’ (১৪০২ : ৯৭)
৪ এপ্রিল ১৯৩৬ নাগাদ এই পত্রের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ লিখিলেন, ‘দীর্ঘকাল ব্যস্ত ছিলুম এবং স্বস্থানে ছিলুম না। ফিরে এসেছি, কিঞ্চিৎ অবকাশও পেয়েছি। আয়ু অল্পই অবশিষ্ট আছে, অবকাশও যে পরিমাণে দুর্লভ সেই পরিমাণেই স্পৃহনীয়, এ অবকাশ স্বল্প পরিমাণেও নষ্ট করতে ইচ্ছা করি না। গ্রন্থ সমালোচনা আমার ব্যবসা নয়, কাজটা অপ্রিয়। অভিমত প্রকাশ করতে লেশমাত্র উৎসাহ প্রকাশ করিনে। এখন আমার একান্ত প্রয়োজন বিশ্রাম। বৃহত্তর বঙ্গ বইখানি অত্যন্ত বৃহৎ। ঐ রচনা বিচার করবার শক্তি আমার অল্প। অতএব স্তব্ধ থাকাই শ্রেয়।’ (১৪০২ : ৫৯)
স্বভাবের অনুরোধে প্রশ্ন উঠিবে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি কারণে এই বিশেষ বহিটির বিষয়ে সমালোচনা দূরে থাকুন ‘ক্ষুদ্র একটি মন্তব্যের সৌজন্য’ অর্থাৎ একবাক্য সামান্য অভিমত প্রকাশে পর্যন্ত রাজি হইলেন না? ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটির নাম লিখিতে প্রয়াস পাইয়া তিনি যে উহার নাম হাত ফসকাইয়া ‘বৃহত্তর বঙ্গ’ লিখিয়া বসিলেন তাহাও অকারণ হইতে পারে না। আসল ঘটনা আমরা একটু পরেই দেখিতে পাইব। এয়ুরোপ খণ্ডের মহাত্মা ফ্রয়েড এই ধরনের অনিচ্ছাপ্রসূত ভ্রমেরও কারণ আছে বলিয়া নির্দেশ করিয়াছিলেন। কি হইতে পারে সেই কারণ?
‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটির সমালোচনা না করিবার কিংবা অভিমত না দিবার সপক্ষে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গোটা দুই কারণ বাতলাইয়াছিলেন। এক নম্বরে, তাঁহার তখন বিশ্রাম প্রয়োজন। ইহাতে অন্য কোন কথা চলিতে পারে না। দুই নম্বর কথা, ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইখানি অত্যন্ত বৃহৎ। অত বড় বইয়ের বিচার তাঁহার সাধ্যাতীত। এই জায়গায় আমাদের একটুখানি সংশয় ঘটিবার কারণ আছে। তিনি ছকেবাঁধা সত্য কথা বলিতেছেন, না নিছক সৌজন্যের আশ্রয় মাগিতেছেন? অন্তর্যামী এই সত্যে সংশয় করিতেছেন বলিয়াই হয়তো ‘বৃহৎ বঙ্গ’ স্থলে ‘বৃহত্তর বঙ্গ’ কথাটা হাত ফসকাইয়া বাহির হইয়াছে।
আমাদের এই কল্পনাতরু যে একান্ত মূলবিহীন শিকড়ছুট নহে তাহাও নানা প্রমাণে সিদ্ধ হইতে পারে। ঐযুগে বাংলাদেশে লেখাপড়ার জগতে ‘বৃহত্তর ভারত’ কথাটি অনেক লেখকের কলমেই সহজে যোগাইতেছিল। বাংলাদেশের উচ্চবর্ণ হিন্দু সমাজে একটা বিবাদ ততদিনে দানা দানা দাঁড়াইতেছিল। সেই বিবাদের ছিল দুই মেরু-‘বৃহত্তর ভারত’ বনাম ‘বৃহত্তর বা বৃহৎ বঙ্গ’। সত্যের অনুরোধে আমাদের কবুল করিতে হইবে, এই বিবাদে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দীনেশচন্দ্র সেন ঠিক এক মেরুতে দাঁড়াইয়াছিলেন—এমন কথা বলা যাইবে না।
দীনেশচন্দ্র সেনের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যাঁহারা সেনাপতির ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিলেন তাঁহাদের অনেকেই নিজেদের বলিতেন রবীন্দ্রনাথের দলের লোক। রবীন্দ্রনাথও তাঁহাদের একান্ত স্নেহে আপন দলের লোক বলিয়া কখনও কখনও স্বীকার করিয়া থাকিবেন। দীনেশচন্দ্র সেন বরাবর লিখিত ৪ এপ্রিল ১৯৩৬ সালের পত্রে রবীন্দ্রনাথ যে কলম ফসকাইয়া ‘বৃহত্তর বঙ্গ’ লিখিয়াছিলেন তাহার এক কারণ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মধ্যে পাওয়া যাইবে। ১৩৪১ বাংলা সনের ভাদ্র মাসে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ‘উদয়ন’ নামক এক মাসিক পত্রের পাতায় ‘বৃহত্তর বঙ্গ’ নামে এক প্রবন্ধ প্রকটিত করেন। ঐ প্রবন্ধে সুনীতিবাবু তাঁহার মনের কথাটা বেশ খোলামেলা বলিয়া ফেলিয়াছিলেন। তাঁহার বিচারে যাঁহারা বৃহত্তর ভারতের দেখাদেখি বৃহত্তর বঙ্গের ধ্বনি তুলিতেছেন তাঁহারা বড় একটা ভুল করিতেছেন। (চট্টোপাধ্যায় ১৩৪১ : ৫২৫-৫৩৮; চট্টোপাধ্যায় ১৪১৭ : ২৪২-২৫৭)
চট্টোপাধ্যায় লিখিয়াছেন, ‘কথাটা কিন্তু বেশীদিনের নহে; আমার মনে হয়, ১৯২৬ সালে ভারতের বাহিরের দেশে ভারতীয় সভ্যতার প্রচারের ইতিহাস আলোচনার উদ্দেশ্যে যখন কলিকাতায় “বৃহত্তর ভারত পরিষৎ” স্থাপিত হয়, তাহার পরে “বৃহত্তর ভারত”-এই সংযুক্ত পদ দুইটির দেখাদেখি “বৃহত্তর বঙ্গ” কথাটীও ব্যবহৃত হইতে থাকে। আগে আমরা “বঙ্গের বাহিরে বাঙ্গালী’ জানিতাম, “প্রবাসী বাঙ্গালী” জানিতাম। ১৯০০ সালে শিক্ষিত বাঙ্গালীর কাছে ‘বৃহত্তর বঙ্গ” শব্দদ্বয় ও তাহাদের অন্তর্নিহিত ভাব দুর্ব্বোধ্য হইত; ১৮৫০ সালের বাঙ্গালীর পক্ষে কথাটী ও তাহার অর্থ উভয়ই অবোধ্য লাগিত। অথচ এই কয় বৎসরে এই কথাটী হালের বাঙ্গালীর স্বাতন্ত্র্যবোধ ও গৌরববোধ, আত্মপ্রসাদ ও শক্তিসংগ্রহ (এবং সঙ্গে সঙ্গে আত্মবঞ্চনার) একটা মস্ত বড় সহায়ক হইয়া পড়িতেছে।’ (চট্টোপাধ্যায় ১৩৪১: ৫২৫; চট্টোপাধ্যায় ১৪১৭: ২৪২)
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় পরিষ্কার বলিয়া দিয়াছিলেন ‘বৃহৎ বঙ্গ’ জাতীয় কথার আড়ালে যদি বাংলাদেশকে ভারত হইতে পৃথক ভাবিবার কোন প্রয়াস লুকাইয়া থাকে তবে তাহা হইবে মারাত্মক। তিনি দক্ষিণে-বাঁয়ে ঘাড় না ঘুরাইয়া সোজাসুজি লিখিয়াছিলেন, ‘বাঙ্গালা দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি আলোচনা করিতে গেলে, তিনটি কথা আমাদের ভুলিলে চলিবে না। সে তিনটি কথা এই—’
[১] বাঙ্গালা-দেশ ভারতেরই অংশ।
[২] বাঙ্গালী জাতি ভারতীয় জাতি-মণ্ডলীরই অন্তর্ভুক্ত, ভারত-বহির্ভুত সত্তা তাহার নাই।
[৩] বাঙ্গালার সংস্কৃতি ভারতীয় সংস্কৃতিরই অংশ-ভারত-বিরোধী পৃথক বাঙ্গালী-সংস্কৃতি নাই।
অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে তিনি একথাও যোগ করিতে ভোলেন নাই : ‘এই রূপে ভারতের সঙ্গে অবিচ্ছিন্ন যোগসূত্রে সংযুক্ত হইলেও, বাঙ্গালা-দেশের সংস্কৃতিতে দুই একটি লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য বা স্বাতন্ত্র্য আসিয়া গিয়াছে। কিন্তু এই স্বাতন্ত্র্যকে আশ্রয় করিয়া, সংস্কৃতি-বিষয়ে “বাঙ্গালা-বনাম-ভারত” এইরূপ প্রশ্ন উঠিতেই পারে না।’ (চট্টোপাধ্যায় ১৩৪১ : ৫২৭; চট্টোপাধ্যায় ১৪১৭ : ২৪৪)
সেদিন সুনীতিকুমারের শেষ সিদ্ধান্ত ছিল :‘ “বৃহত্তর বঙ্গ”, “বৃহত্তর বঙ্গ” বলিয়া চীৎকার করিয়া কোনও লাভ নাই। ইংরেজের [মিডলম্যান] হইয়া, ইহাদের ফড়িয়াগিরি করিয়া যে বৃহত্তর বঙ্গের প্রতিষ্ঠা, তাহার কোনও স্থায়ী ফল দেখা যাইতেছে না। উৎকট বাঙ্গালীয়ানা লইয়া বাঙ্গালী ভারতে প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারবে না।’ তাঁহার বিশ্বাস, ‘সমগ্র ভারত এক, ভারতের অখণ্ড ও অচ্ছেদ্য একত্ব-এই বোধ আমাদের হিন্দু সংস্কৃতিতে ওতঃপ্রোত ভাবে বিদ্যমান; ইংরেজ শাসনের নূতন যুগে এই কথাই বাঙ্গালী ভারতবর্ষকে শুনাইয়াছেন—ইহাতেই তাহার প্রধান গৌরব, বঙ্কিমচন্দ্র, বিবেকানন্দ, ভূদেব, রবীন্দ্রনাথের বাণী, স্বদেশী আন্দোলনের যুগে, ভারতের একতাবোধকে দৃঢ় করিতে সাহায্য করিয়াছিল; তাই ১৯০৫ হইতে ১৯২০ পর্যন্ত বাঙ্গালীর নেতৃত্ব সমস্ত ভারত একরকম মানিয়াই লইয়াছিল।’ (চট্টোপাধ্যায় ১৩৪১ : ৫৩৮; ১৪১৭ : ২৫৭)
সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় একদিন যাহা বলিয়াছিলেন তাহার প্রতিধ্বনি শোনা গেল গোটা দুই বছর পর ছাপা ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকার একটি বেনামা নিবন্ধে। নিবন্ধের নাম ‘ইতিহাস নয়’। এই নিবন্ধটির—এতদিনে আমরা নিরূপণ করিয়াছি—লেখক নীরদচন্দ্র চৌধুরী। এই নিরূপণের সহজ একটা পদ্ধতি আছে। কেননা ‘ইতিহাস নয়’ প্রবন্ধের মূল মূল প্রত্যেকটি প্রস্তাব নীরদচন্দ্র চৌধুরীর নামে ইতিপূর্বে প্রকাশিত দুই দুইটি প্রবন্ধে প্রায় হুবহু পাওয়া গিয়াছে।
নীরদচন্দ্র চৌধুরী মনে করেন সুপ্রাচীনকাল হইতে বাংলাদেশ ও বাঙ্গালীকে সমগ্র ভারতবর্ষ হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখিবার কোন উপায় নাই। অথচ দীনেশচন্দ্র সেন কিনা ঠিক এই অসম্ভব কাজটিই করিয়াছেন! নীরদবাবুর ধারণা, ‘আজ আমরা ভারতবর্ষকে কতকগুলি প্রাদেশিক জাতি ও সংস্কৃতির সমষ্টি বা “ফেডারেশ্যন”রূপে দেখিতে অভ্যস্ত হইয়া উঠিয়াছি। কিন্তু ইতিহাসে তাহার কোন সাক্ষ্য নাই। ভারতবর্ষের স্থাপত্যে, চিত্রকলায়, সাহিত্যে, ধর্ম্মসাধনায়, ব্রিটিশ আধিপত্যের পূর্ব্বে বহু বৈষম্য ছিল বটে, কিন্তু উহাতে প্রাদেশিকতার কোন অনুভূতি ছিল না। এমন কি যে বাংলাদেশ ভৌগোলিক সংস্থানের জন্য উত্তরাপথের কেন্দ্রীয় সভ্যতা হইতে বরাবরই একটু দূরে ছিল এবং রাষ্ট্রীয় ব্যাপারেও বহু শত বৎসর বিচ্ছিন্ন ছিল, সেখানেও বাঙালীত্ববাদ বা বিশিষ্ট একটা বাঙালী সভ্যতা সৃষ্টির চেষ্টা হয় নাই।’ (চৌধুরী ১৩৪৩ : ১৩০৯)
উদাহরণের ছলে আপনার ধারণা আরো বিশদ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন নীরদচন্দ্র চৌধুরী। তিনি লিখিয়াছেন, ‘১৩৩৫ খৃষ্টাব্দ হইতে আরম্ভ করিয়া আকবরের বাংলা জয়ের পূর্ব্ব পর্যন্ত বাংলা দেশের একটা নিরঙ্কুশ স্বাতন্ত্র্যের যুগ। এই যুগেও বাঙ্গালী যে ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের সহিত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করিতে চায় নাই চৈতন্যের জীবনই তাহার অন্যতম প্রমাণ। এখন আমরা মধ্যযুগের বাঙালী জীবনকে বাংলা দেশের খুব একটা নিজস্ব জিনিষ বলিয়া দাবী করিতে আরম্ভ করিয়াছি, কিন্তু একটু তলাইয়া দেখিলে তাহার সহিত ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশের তৎকালীন সংস্কৃতির কোন মূলগত পার্থক্য পাওয়া যাইবে না। যাহারা খড়ের ঘরে, ছেঁড়া কাঁথায়, ও চিত্রিত হাঁড়িকুড়িতে বাংলা দেশের প্রাণধর্ম্মের সন্ধান পান, তাঁহারা সে-যুগের সংস্কৃতির মূল সূত্রটিই ভুলিয়া গিয়াছেন বলিলে অন্যায় হইবে কি? মুসলমান যুগে হিন্দুর সামাজিক ইতিহাস আলোচনা করিতে গিয়া এ কথাটা বিস্মৃত হইলে চলিবে না যে, তখন ভারতবর্ষের জনসমষ্টি কোন নূতন সভ্যতার সৃষ্টি করিতে পারে নাই, এই কয় শত বৎসর ধরিয়া তাহারা কেবলমাত্র কি ভাষায়, কি ধর্ম্মে, কি সাহিত্য ও আর্টে, কি আচার-ব্যবহারে প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতার একটা অপভ্রংশ সৃষ্টি করিবার চেষ্টা লইয়া ব্যাপৃত ছিল। উহার ফলে আমরা যাহা পাইয়াছিলাম, তাহা হিন্দু সভ্যতার একটা ‘তদ্ভব’ রূপ মাত্র; এই গ্রাম্য সংস্কৃতির মধ্যে বৈচিত্র্য যতই থাকুক না কেন, উহা কোন প্রাদেশিক সভ্যতার ভিত্তি হইয়া দাঁড়ায় নাই।’ (চৌধুরী ১৩৪৩ : ১৩০৯-১৩১০)
দীনেশচন্দ্র সেন ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থের ভূমিকায় আর দশ কথার মধ্যে ইহাও বলিয়াছিলেন, ‘আমরা প্রাচীন কালের কথা বলিতে যাইয়া সমস্ত পূর্ব্ব ভারতকেই লক্ষ্য করিব। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় তাঁহার বঙ্গ-বন্দনায় অশোকের নাম উল্লেখ করিয়াছেন; তিনি অন্যায় করেন নাই। এক সময়ে মগধই সমস্ত পূর্ব্বভারতের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। বঙ্গদেশের শিক্ষাদীক্ষার মূল প্রস্রবণ-এই গঙ্গার আদি-উৎস হরিদ্বার-স্বরূপ-মগধ-কেন্দ্রস্থলে বিরাজিত ছিল; মগধের উচ্চশিক্ষা, মগধের শিল্পকলা সমস্তই উত্তরকালে পূর্ব্বদিক আশ্রয় করিয়া গৌড়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল, মগধকে বাদ দিয়া বাঙ্গলার ইতিহাস রচনা করা চলে না। রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও তাঁহার বাঙ্গলার ইতিহাসে মগধকে বাদ দেন নাই।’ (সেন ২০০৬ : ১৯)
আরেকটা জায়গায় তিনি আরো ঢাক-ঢোল পিটাইয়া বলিয়াছেন, ‘আমার সরল আন্তরিক বিশ্বাস যে এই পূর্ব্বভারতের সভ্যতার-বিশেষ করিয়া মগধের শিক্ষাদীক্ষার-আমরা বাঙ্গালীরাই উত্তরাধিকারী হইয়াছি, অন্ততঃ আমরা তাহা যতটা পাইয়াছি, আমাদের প্রতিবেশীগণের মধ্যে কেহই, এমনকি খাস্ বিহারীবাসীরাও ততটা পান নাই। মগধের দীপ নিবু নিবু হইলে তাহা গৌড়ে জ্বলিয়া উঠিয়াছিল। এই দীপ একই দেশলাই কাঠির। গৌড়ের দীপ যখন নির্ব্বানোম্মুখ, তখন তাহার পরবর্ত্তী শিখা জ্বলিয়া উঠিয়াছিল নবদ্বীপে। সেই দীপই এখন কলিকাতা ও তন্নিকটবর্ত্তী স্থানে জ্বলিতেছে।’ (সেন ২০০৬ : ১৭৪)
এই প্রস্তাবটি রমেশচন্দ্র মজুমদারের অনুমোদন লাভ করে নাই। তিনি প্রতিবাদ করিয়াছেন, ‘আমরা এ বিষয়ে গ্রন্থকার বা রাখালবাবুর সহিত একমত হইতে পারি না। গ্রন্থকারের যুক্তি যদি সত্য বলিয়া গ্রহণ করা যায়-তবে “বৃহৎ বঙ্গ” নামক গ্রন্থে মগধের ইতিহাস না লিখিয়া “বৃহৎ মগধ” নামক গ্রন্থে বাঙ্গালার ইতিহাস লেখাই যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়।’ (মজুমদার ১৩৪৩ : ৯৫৪)
১৯৪৭ সালের বঙ্গবিভাগের পর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে যাঁরা ইতিহাস ব্যবসায়ে প্রসিদ্ধ হইয়াছেন তাঁহাদের মধ্যে দেখা যায় একপ্রকার ঐকমত্যের প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। এই ইতিহাস-ব্যবসায়ীদের একজন লিখিয়াছেন, ‘অনির্ণীতমূল্য অজস্র তথ্য সংকলনের ফলে [বৃহৎ বঙ্গ] বইখানি যথার্থ ইতিহাসের মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অথচ ঠিক উপাদান গ্রন্থের মর্যাদাও লাভ করতে পারেনি। তার কারণ ইতিহাসচর্চায় গ্রন্থকারের অভিজ্ঞতার অভাব।’ (সেন ১৯৯৭ : ৫২)
এই ঐকমত্যেরই প্রতিধ্বনি করিয়াছেন বিশ শতকের নতুন ইতিহাস-ধুরন্ধর দীপেশ চক্রবর্তী। তাঁহার মতে, দীনেশচন্দ্রের পুরাতন ভবদৃষ্টি ইতিহাসের সহিত একান্তই শত্রুতার জন্ম দেয়। দীপেশবাবু ইতিহাস বলিতে বোঝেন-উদাহরণ হিশাবে বলিতেছি-নীহাররঞ্জন রায় প্রণীত ‘বাঙালীর ইতিহাস (আদিপর্ব)’ কিংবা স্যার যদুনাথ সরকার সম্পাদিত ‘বঙ্গদেশের ইতিহাস (মুসলিম যুগ : ১২০০-১৭৫৭)’ ইতি আদি। দীনেশচন্দ্রের ইতিহাসঘাতকতার প্রমাণস্বরূপ দীপেশ চক্রবর্তী এই পরিত্যাজ্য ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থের পরের দিককার এক সংস্করণ হইতে একপ্রস্ত বচন উদ্ধার করিয়াছেন। দীনেশচন্দ্র লিখিয়াছেন, ‘আমি বহু বৎসর যাবৎ চণ্ডীদাসের গান গায়ত্রীমন্ত্রের ন্যায় প্রায় একরূপ জপ করিয়া আসিয়াছি, এই মহাকবি আমার যতটা অন্তরঙ্গ, আমার দারা পুত্র স্বগণের কেহ তদপেক্ষা অন্তরঙ্গ নহেন; তিনি আমাকে যতটা আনন্দ দিয়াছেন, পৃথিবীতে আর কেহ ততোধিক আনন্দ দেন নাই। এই দীর্ঘ অর্দ্ধ শতাব্দীর পরিচয়ে আমি তাঁহার সুরটা চিনিয়াছি; এতদিন ধরিয়া যদি কাহারও কথা দিনরাত্রি শোনা যায়, তবে তাহার সুরটা চেনা খুবই স্বাভাবিক। আমি ভাষাবিচার করিয়া কে খাঁটি চণ্ডীদাস, কে দীন চণ্ডীদাস, কে দ্বিজ চণ্ডীদাস, কে বাশুলীসেবক চণ্ডীদাস, কে তরুণীরমণ চণ্ডীদাস—এই চণ্ডীদাস ব্যুহের সমস্যা ভেদ করিতে যাইব না; আমার নিকট এক ভিন্ন দ্বিতীয় চণ্ডীদাস নাই। গত কয়েক বৎসর হইল একজন আমাকে কতকগুলি অজ্ঞাতপদ আনিয়া পরীক্ষা করাইয়াছিলেন, তন্মধ্যে যেগুলি চণ্ডীদাসের পদ তাহা আমার তখন অজ্ঞাত থাকিলেও আমি দুই একটি ছত্র শুনিয়া ঠিক ধরিয়া দিয়া পরীক্ষা উত্তীর্ণ হইয়াছিলাম, আমার একটিও ভুল হয় নাই।’ (চক্রবর্তী ২০০৪ : ৬৭৩; সেন ২০০২ : ২১১-২১২)
৩
বাংলাদেশের বর্ণহিন্দু সমাজের একটি অংশ দীনেশচন্দ্র সেনের কীর্তি নস্যাত করিতে কেন এত উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়াছিলেন তাহার একটি পরিচ্ছন্ন ব্যাখ্যা পেশ করিয়াছিলেন আহমদ ছফা। ততদিনে অবশ্য ঢের দেরি হইয়া গিয়াছে। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সহিত দীনেশচন্দ্র সেনের একদা সাক্ষাৎ ঘটিয়াছিল, আর এই সাক্ষাৎকারটি দীনেশচন্দ্রের পক্ষে বড় প্রীতিকর হয় নাই—এই ঐতিহাসিক তথ্য, এই সত্যসংবাদ ভর করিয়া আহমদ ছফা একপ্রস্ত পুরাণও খাড়া করিয়াছিলেন। এই পুরাণের মধ্যে—আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আদর্শ মান্য করিয়া বলিতেছি—বস্তুগত তথ্য খুঁজিলে ঠকিব নিশ্চয়ই কিন্তু ভাবগত সত্য খুঁজিয়া পাইতে পারি।
আহমদ ছফা লিখিয়াছেন, ‘দীনেশ এবং বঙ্কিমের মধ্যে বয়সের বিরাট ফারাক। বঙ্কিম যখন প্রৌঢ়, মৃত্যুর দিন গুণছেন, দীনেশ তখনো তরুণ। দীনেশচন্দ্র ছিলেন পূর্ববঙ্গীয় বৈদ্য সম্প্রদায়ের লোক। সারা জীবন চেষ্টা করেও ঘটি উচ্চারণ-পদ্ধতি রপ্ত করতে পারেননি। তাঁকে নিয়ে অনেকেই ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করতেন। যদিও দুজনের মধ্যে বেশি দেখাসাক্ষাৎ ঘটেনি, তথাপি এই পূর্ববঙ্গীয় বৈদ্য বঙ্কিমের রাগ, উষ্মা এবং বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তার কারণ অবশ্যই আছে। বঙ্কিম কংস, জরাসন্ধ, শিশুপাল-এই রাজাদের ধর্মের প্রয়োজনে হত্যা করা হয়েছিল বলে দাবি করেছেন। দীনেশচন্দ্র তাঁর দুখে সমাপ্ত ‘বৃহৎ বঙ্গ’ গ্রন্থে এই বঙ্কিমবাবুর ধর্মের আসল স্বরূপটি ফাঁস করে দিয়েছিলেন।’ (ছফা ২০০৮ : ৩৭৫-৭৬)
আহমদ ছফা বিষয়টি খানিক বিশদ করিয়াই বলিয়াছেন : ‘শ্রীকৃষ্ণ এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার প্রয়োজনেই এইসব রাজাদের হত্যা করেছেন। দীনেশ সেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে সেই জিনিশটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। এই রাজারা সকলেই আঞ্চলিক স্বাধীন নৃপতি। শ্রীকৃষ্ণের সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার করলে অবশ্যই তাঁদের অপরাধী বলতে হবে। তাঁদের আপন স্বজনদের কাছে [তাঁরা কিন্তু] ছিলেন স্বাধীনতার শহীদ। দীনেশচন্দ্র সেন এই বিষয়টা যুক্তি সহকারে প্রতিপন্ন করেছিলেন।’ আহমদ ছফার ধারণা, ‘বঙ্কিমচন্দ্র এবং দীনেশ সেনের আলাদা সাহিত্যরুচি এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটা বিরোধ লুকিয়ে ছিল।’ তাঁহার কথায়, ‘দৃষ্টিভঙ্গির এই [বিরোধ] বিষয়টা শুধু দুইজন মানুষের নয়, তাবৎ বঙ্গীয় সংস্কৃতির এবং রাজনীতির।’ (ছফা ২০০৮ : ৩৭৬-৭৭)
বিরোধের গোড়ায় যাওয়ার চেষ্টাও আহমদ ছফা করিয়াছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন বঙ্কিমের দৃষ্টিতে একজন অবতার। এই অবতারের মূল কাজ ছিল ধর্ম সংস্থাপন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। রাজ্যে যখন বিপ্লব ঘটে, বিদ্রোহ যখন রাজসিংহাসন টালমাটাল করে ফেলে, কিংবা পররাজ্যের আক্রমণে ধনপ্রাণ বিপন্ন হয়, অথবা অত্যাচারী রাজপুরুষদের নির্যাতনের কারণে প্রজাসাধারণের জীবনে ভোগান্তির অন্ত থাকে না, তখনই শান্তি বিঘ্নিত হয়। শ্রীকৃষ্ণের গীতোক্ত কাঠামো কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখলে সমাজে আর শান্তিভঙ্গের অবকাশ থাকে না। শ্রীকৃষ্ণ-প্রচারিত ধর্ম এবং শান্তি উভয়ের অর্থই রাজনৈতিক [পরি]প্রেক্ষিত থেকে বিচার করতে হবে। কোন কারণে শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার লক্ষণ দেখা দিলে বারবার শান্তি সংস্থাপনের প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। তারপরও যদি শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হয়, যে বা যারা শান্তি ভঙ্গকারী তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রহাতে যুদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। যুদ্ধ ক্ষত্রিয়ের পবিত্র কর্তব্য। কোন ক্ষত্রিয় [যদি] ন্যায়যুদ্ধে পরাঙ্মুখ হয়, তাহলে সেই ব্যক্তি ইহলোকে নিন্দিত হবে এবং পরলোকে থাকতে তার ভাগ্যে অনন্ত নরকবাস।’ (ছফা ২০০৮ : ৩৭৭)
১৯৪৭ সালের আগে পর্যন্ত বাংলাদেশে—মানে দ্বিতীয় ব্রিটিশ বাংলা বিভাজন কাণ্ডের গোড়ায়—যে রাজনৈতিক চিন্তাধারা কাজ করিতেছিল দীনেশচন্দ্র সেন সেই চিন্তাধারায় আদৌ অবগাহন করিতে রাজি হন নাই। ইতিহাস তাঁহার চিন্তাধারাকে পাশ কাটাইয়া গিয়াছে। আহমদ ছফা এই সত্যে সন্দিগ্ধ নহেন বলিয়াই হয়তো বিংশ শতকের শেষ দশকে দাঁড়াইয়াও ঘোষণা করিতে পারেন, ‘এই বিরোধের একটা নিরাকরণ অবশ্যই করতে হবে নইলে [বাংলা] তার পূর্ণ সত্তা ফিরে পাবে না।’ (ছফা ২০০৮ : ৩৭৭)
এই বিরোধের ছবিটা আহমদ ছফা আগেও একবার আঁকিয়াছিলেন। ১৯৯৪-৯৫ নাগাদ প্রকাশিত ‘স্মরণ : দীনেশচন্দ্র সেন’ নামক এক নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘বঙ্কিম যে ব্রাহ্মণ্যবাদী রাষ্ট্রচিন্তাটি খাড়া করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে দৃঢ় একটি অবস্থান নিয়ে দীনেশ সেন সারাজীবন সাধনা এবং সংগ্রাম দুইই করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্র নির্ভর করেছেন সংস্কৃত সাহিত্য, ব্রাহ্মণ্যবাদ, গীতা, বেদ—এসমস্ত জিনিশের ওপর। এগুলোর ভেতর থেকেই তাঁর রাষ্ট্রচিন্তার উপাদান তিনি বের করে এনেছিলেন।’ কিন্তু-আহমদ ছফার কথায়— ‘দীনেশবাবুর সন্ধানের প্রক্রিয়াটি ছিল ভিন্নরকম। তিনি শাস্ত্র নয়, সন্ধান করেছিলেন সমাজ। ধর্ম নয়, তাঁর উপজীব্য ছিল মানুষ-সে মানুষ হিন্দু না মুসলমান এটা তার ধর্তব্যের বিষয় ছিল না। লোকায়ত জীবনের গভীরে ডুব দিয়ে যে মর্মমধু তিনি আহরণ করেছিলেন, তার মর্যাদা এবং গুরুত্ব-বঙ্কিমের মত অত দার্ঢ্য নিয়ে দাঁড়াতে না পারলেও [তার] গভীরতা-অনেক গুণে বেশি।’ (ছফা ২০০৮ : ২২৩-২২৪)
আহমদ ছফার দেখার ক্ষমতা ছিল। দীনেশচন্দ্র সেনের বেলায়ও তিনি সে ক্ষমতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারই করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘বাংলার পল্লীসমাজ, বাংলার লোকসাহিত্য, বাংলার লোকসংস্কৃতি—এ সমস্ত জিনিশকে তাঁর মত এত হৃদয় দিয়ে কেউ গ্রহণ করেনি। তাঁর এই যে অনিদ্র অন্বেষণ—এর পেছনে একটা বিশ্বাসের আগুন ছিল। বঙ্কিম তাঁর প্রচণ্ড প্রতিভার প্রভাবে হিন্দুসমাজকে যে গোটা বাঙ্গালি জাতীয়তার প্রেম থেকে সরিয়ে নিয়ে একটি উল্টো ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছেন, তার প্রতিবাদ করাই ছিল দীনেশ সেনের মূল লক্ষ্য।’ আহমদ ছফা পুনশ্চ যোগ করিয়াছেন, ‘হিন্দু ব্রাহ্মণ্যবাদীদের রাষ্ট্রচিন্তার যে ধারাটি বঙ্কিম তাঁর অসাধারণ প্রতিভাবলে আবিষ্কার করে সমস্ত জাতির কাঁধে চাপিয়ে দিয়েছিলেন, দীনেশবাবু কোনরকম হৈচৈ না করে তাঁর সারা জীবনের কাজের মধ্য দিয়ে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এখানেই দীনেশবাবুর মহত্ত্ব।’ (ছফা ২০০৮ : ২২৪)
‘স্মরণ : দীনেশচন্দ্র সেন’ নিবন্ধের উপসংহারে পৌঁছিয়া আহমদ ছফা ঘোষণা করিয়াছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি বঙ্কিমের রাষ্ট্রচিন্তার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। মরা জন্তুর দাঁতের মত সেটা পড়ে থাকবে। যে সমস্ত ঐতিহাসিক উপাদান এবং দার্শনিক তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বঙ্কিম তাঁর রাষ্ট্রতত্ত্ব দাঁড় করিয়েছিলেন তার পেছনে হাতুড়েপনা ছাড়া কোন বৈজ্ঞানিক সত্যের স্বীকৃতি নেই।’ দীনেশচন্দ্র সেনের ভাবগত ইতিহাসকে আহমদ ছফা ইহার বিপরীতে স্থাপন করিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘দীনেশবাবু যে পথে একটি রাষ্ট্রীয় ভবিষ্যৎ কামনা করেছিলেন সে পন্থাটি অনেক বেশি বৈজ্ঞানিক, অনেক বেশি মানবিক। কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদের সেটা মেনে নেয়ার মত উদারতা ছিল না। বাংলার ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রার এই পর্যায়ে দীনেশ সেন ছাড়া আর কোন মনীষার প্রতি আস্থা সহকারে তাকাতে পারব তেমন কাউকে দেখি না।’ (ছফা ২০০৮ : ২২৪)
আহমদ ছফার বাক্য এই পর্যন্ত আমল করিবার পর আমাদের মনে অকস্মাৎ একটি প্রশ্নের উদয় হইল। হংসমধ্যে বক যথা ভদ্রলোক তথা বর্ণহিন্দু পরিমণ্ডলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও কি আহমদ ছফা বর্ণিত ‘আর কোন’ মনীষার দলে পড়িবেন? আহমদ ছফা নিজে কেন তাঁহার নামটা ধরেন নাই? আমাদের কৌতুহল জাগিল—আর কারণে না হইতে পারে—এক কারণে। সেদিন নানান যুক্তি দেখাইয়া দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বৃহৎ বঙ্গ’ বইটির বিষয়ে ক্ষুদ্র একটি মন্তব্য করিতেও অপারগতা প্রকাশ করিয়াছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু কেন? প্রকাশ থাকে যে এই ঘটনার সাড়ে তিন বছর পরও তিনি দীনেশচন্দ্র সেনকে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’র তারিফ জাহির করিয়া নতুন পত্র লিখিতে কসুর করেন নাই। সেদিন ১৯৩৯ সালে ২২ অক্টোবর-মানে দীনেশচন্দ্রের পরলোকযাত্রার মাসখানেক মাত্র আগে-মংপু হইতে রবীন্দ্রনাথ লিখিয়াছিলেন, ‘কল্যাণ নিলয়েষু, বিজয়ার আশীর্বাদ গ্রহণ করবেন। বাংলা প্রাচীন সাহিত্যে মঙ্গলকাব্য প্রভৃতি কাব্যগুলি ধনীদের ফরমাসে ও খরচে খনন করা পুষ্করিণী: কিন্তু ময়মনসিংহ গীতিকা [বাংলার] পল্লী হৃদয়ের গভীর স্তর থেকে স্বত উচ্ছ্বসিত উৎস, অকৃত্রিম বেদনার স্বচ্ছধারা। বাংলা সাহিত্যে এমন আত্মবিস্মৃত রসসৃষ্টি আর কখনো হয়নি। এই আবিষ্কৃতির জন্যে আপনি ধন্য।’ (ঠাকুর ২০০২ : ৬০)
দেখা যাইতেছে, পারিবারিক কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্কের টানা ও পোড়েন দিয়া আমাদের প্রশ্নের পুরা উত্তর পাওয়া যাইবে না। বাকি থাকে রাষ্ট্রচিন্তার প্রশ্ন। বঙ্কিমচন্দ্রের রাষ্ট্রচিন্তার সহিত রবীন্দ্রনাথ চিরকাল একমত পোষণ করিয়াছেন—এমনও নহে। কিন্তু এই প্রশ্নে-শ্রীকৃষ্ণের জরাসন্ধ, শিশুপাল ও কংসবধ প্রভৃতি অধ্যায়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে পথে হাঁটিয়াছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সেই পথেরই পরিব্রাজক। আহমদ ছফা রবীন্দ্রনাথের বিষয়টি কিভাবে দেখিতেন তাহা আমাদের কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। ১৯১২ সালে প্রকাশিত ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা’ নামক এক নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিয়াছিলেন, ‘প্রাচীনকালের এই মহাবিপ্লবের আর যে একজন প্রধান নেতা শ্রীকৃষ্ণ কর্মকাণ্ডের নিরর্থকতা হইতে সমাজকে মুক্তি দিতে দাঁড়াইয়াছিলেন তিনি একদিন পাণ্ডবদের সাহায্যে জরাসন্ধকে বধ করেন। সেই জরাসন্ধ রাজা তখনকার ক্ষত্রিয়দলের শত্রুপক্ষ ছিলেন। তিনি বিস্তর ক্ষত্রিয় রাজাকে বন্দী ও পীড়িত করিয়াছিলেন। ভীমার্জুনকে লইয়া শ্রীকৃষ্ণ যখন তাঁহার পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন তখন তাঁহাদিগকে ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশ ধরিতে হইয়াছিল। এই ব্রাহ্মণ-পক্ষপাতী ক্ষত্রবিদ্বেষী রাজাকে শ্রীকৃষ্ণ পাণ্ডবদের দ্বারা যে বধ করাইয়াছিলেন এটা একটা খাপছাড়া ঘটনামাত্র নহে। শ্রীকৃষ্ণকে লইয়া তখন দুই দল হইয়াছিল। সেই দুই দলকে সমাজের মধ্যে এক করিবার চেষ্টায় যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করিয়াছিলেন তখন শিশুপাল বিরুদ্ধ দলের মুখপাত্র হইয়া শ্রীকৃষ্ণকে অপমান করেন। এই যজ্ঞে সমস্ত ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়, সমস্ত আচার্য ও রাজার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণকেই সর্বপ্রধান বলিয়া অর্ঘ্য দেওয়া হইয়াছিল।’ (ঠাকুর ১৩৯৫ : ২৬-২৭)
দীনেশচন্দ্র সেন ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়ের এই বিরোধ-বিসম্বাদ উপেক্ষা করেন নাই। তিনি দেখাইয়াছেন, এই বিরোধের ইতিহাস আর্যাবর্ত বা প্রকৃত প্রস্তাবে উত্তরাপথের দুই পক্ষে বিরোধের ইতিহাস—এক পক্ষের ইন্দ্রপ্রস্ত অন্যপক্ষে মগধ। দীনেশচন্দ্র লিখিয়াছেন, ‘প্রাগৈতিহাসিক যুগের বৃহৎ বঙ্গের প্রধান পুরুষ জরাসন্ধ। মহাভারত, হরিবংশ প্রভৃতি পুরাণে এই অদ্বিতীয় বীরের কাহিনী বিশেষভাবে লিপিবদ্ধ আছে।’ (সেন ২০০৩ : ২৪)
অন্যদিকে দীনেশচন্দ্র সেন জরাসন্ধ বধ প্রসঙ্গে সরাসরি বঙ্কিমচন্দ্রের বক্তব্যও খণ্ডন করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, ‘অবশ্য ভীমার্জ্জুনের সাহায্যে ছলনা করিয়া কৃষ্ণ জরাসন্ধকে বধ করিয়াছিলেন, তাঁহারা কপট স্নাতকবেশে যাইয়া জরাসন্ধকে আক্রমণ করেন। তাঁহার মৃত্যুতে মগধের দীপ্তি কতকদিনের জন্য নিবিয়া গিয়াছিল।’ (সেন ২০০৩ : ২৮)
এই প্রসঙ্গে দীনেশচন্দ্রের যুক্তি অবিস্মরণীয়। তিনি লিখিয়াছেন, ‘কৃষ্ণ মগধরাজের বিরুদ্ধে যে সকল অভিযোগ উপস্থিত করিয়াছিলেন, জরাসন্ধ তাহাদের সকলগুলিই [নিরসন] করিয়াছিলেন। তাঁহার বিরুদ্ধে সর্ব্বপ্রধান অভিযোগ—যাহা আমরাও প্রতিবাদ করিতে দ্বিধাবোধ করি—তাহা তাঁহার মহাদেব মন্দিরে একশত রাজাকে বলি দেওয়ার সংকল্প।’ দীনেশচন্দ্র সেন লিখিতেছেন, ‘এই নিষ্ঠুর ও বর্ব্বরজনোচিত ব্যবহার সমর্থন করা যায় না। কিন্তু জরাসন্ধ এই অভিযোগের উত্তরে কি বলিয়াছিলেন, তাহা প্রণিধানযোগ্য—‘হে কৃষ্ণ। আমি কোন রাজাকেই জয় না করিয়া আনয়ন করি নাই। বিক্রমপ্রকাশপূর্ব্বক লোককে আপনার বশে আনিয়া তাহার প্রতি স্বেচ্ছানুসারে ব্যবহার করাই ক্ষত্রিয়ের ধর্ম্ম।’ (সেন ২০০৬ : ৪৩)
এই বিরোধের নির্গলিতার্থ কি? দীনেশচন্দ্রের মতে, ‘কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের সময় আমাদের বৃহৎ বঙ্গ পরাক্রান্ত রাজগণের নিবাসস্থল এবং শ্রেষ্ঠ আর্য্যভূমিরূপে প্রতিষ্ঠিত ছিল। অবশ্য বঙ্গদেশের পূর্ব্ব-সীমান্তের রাজগণের প্রসঙ্গে যদিও কিরাত, চীন ও যবন সৈন্যের উল্লেখ দৃষ্ট হয়, তথাপি তাঁহাদের সঙ্গে সমস্ত আর্য্যাবর্ত্তময় বৈবাহিক আত্মীয়তা ছিল তাহা প্রমাণিত হইতে পারে।’ (সেন ২০০৬ : ৩০)
দীনেশচন্দ্র সেন দেখাইয়াছেন, সেদিন এই বৃহৎ বঙ্গের কেহ কেহ সার্ব্বভৌম সম্রাট ছিলেন। সেই সময় ‘ব্রাহ্মণেরা কৃষ্ণকে কেন্দ্রস্থানীয় করিয়া উত্তর-পশ্চিমে যে নূতন হিন্দুসমাজ গঠন করিতেছিলেন—পূর্ব্বদেশের সার্ব্বভৌম রাজারা তাহার ঘোরতর বিরুদ্ধতা করিয়াছিলেন। মহাভারত, রামায়ণ এই দুই হিন্দুসমাজের সর্ব্বজনাদৃত গ্রন্থে ধর্ম্মসমন্বয়ের একটা চেষ্টা আছে; কিন্তু যে আকারে আমরা এই দুই পুস্তক পাইতেছি-তাহা সমধিক পরিমাণে-কৃষ্ণের মহিমাদ্যোতক।’ (সেন ২০০৬ : ৪৩)
এই মহিমার সর্বশেষ দ্যোতনা লিখিয়াছেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ পর্যন্ত সেই দ্যোতনায় সায় দিয়াছেন কিন্তু দীনেশচন্দ্র সেন কৃষ্ণচরিত্রে মজিতে পারেন নাই। এই অসম্মতিকেই দীপেশ চক্রবর্তী দীনেশচন্দ্র সেনের পরাজয় বলিয়া চিত্রিত করিয়াছেন। এই পরাজয় একদিকে তরুণতর ইতিহাস ব্যবসায়ী নিহারঞ্জন রায়ের নিকট, অন্যদিকে প্রধান রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় মহাসভা বা কংগ্রেসের নিকট। দীপেশ চক্রবর্তীর আদরের ইতিহাস-ব্যবসায়ী স্যার যদুনাথ সরকারও সেদিন জয়ী হইয়াছিলেন আর দীনেশচন্দ্র সেন পরাস্ত হইয়াছিলেন এ সত্যে সন্দেহ কি! (চক্রবর্তী ২০০৪ : ৬৬৯, ৬৭৪; চক্রবর্তী ২০১৫)
৪
এই বক্তৃতা শুরু করিয়াছিলাম জসীম উদ্দীনের ননী চুরি করিয়া। ইহার সংহারও তাঁহার গোষ্ঠেই করিতে হইবে। ১৯৫৫ সনে প্রকাশিত ‘যাঁদের দেখেছি’ পুস্তকে জসীম উদদীন ‘দীনেশচন্দ্র’ নামে একটি ক্ষীণকায় স্মৃতিকথা লিখিয়াছিলেন। সেই স্মৃতিকথায় একটি ভারি মজার কাহিনী আছে। ইহাতে দীনেশচন্দ্র সেনের আরেকটি পরিচয় পরিষ্কার হয়। জসীম উদ্দীন লিখিয়াছেন, ‘“ময়মনসিংহ গীতিকা” সংগ্রহ করিতে যাইয়া আমার মনে সন্দেহের উদয় হইল, এগুলি গ্রামে যেভাবে গাওয়া হয় যথাযথ সেইভাবে সংগ্রহ করা হয় নাই। গীতিকা-সংগ্রাহক উহার উপর কিছু রং চড়াইয়াছেন। এই কথা আমি দুই একজন বন্ধু-বান্ধবের নিকট আলোচনা করি। তাহা দীনেশবাবুর কানে যায়। দীনেশবাবু আমাকে এ বিষয়ে জবাবদিহি করিতে পত্র লিখিলেন।’ (জসীম উদ্দীন ১৯৯৯ : ৬৭-৬৮)
জসীম উদ্দীন যোগ করিতেছেন, ‘আমি তখন সবেমাত্র “ময়মনসিংহ গীতিকা” সংগ্রহের ভার পাইয়াছি। দীনেশবাবুর পত্র পাইয়া আমার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। সত্যকথা বলিলে দীনেশবাবুর নিশ্চয়ই আমাকে এ কাজে আর রাখিবেন না। আমি চারিদিন নির্জনে বসিয়া চিন্তা করিলাম। তখনকার ছেলেমানুষির কথা ভাবিলে এখন হাসি পায়। গ্রাম্য ফকিরদের বৈঠকে বসিয়া কত প্রার্থনা করিলাম। তারপর দীনেশবাবুকে আগাগোড়া সব কথা খুলিয়া লিখিলাম। দীনেশবাবু আমার বিরুদ্ধে কোনো কিছু করিলেন না। তিনি শুধু লিখিলেন, ‘এ বিষয়ে তোমার ধারণা ভুল। পরে বুঝিতে পারিবে।’ (১৯৯৯ : ৬৭-৬৮)
কবি পুনশ্চ জানাইতেছেন, মাঝে মাঝে তিনি বন্ধু-বান্ধবদের বলিয়া থাকিতেন, ‘দীনেশবাবুর মৃত্যুর পর “ময়মনসিংহ গীতিকা” সংগ্রহের গলদগুলি নিয়ে আলোচনা করব। তিনি আমার জীবনে সবচাইতে উপকারী বন্ধু, তিনি দুঃখ পান এমন কোন কাজ তিনি জীবিত থাকতে আমি করব না।’ এই খবর লোকমুখে শুনিয়া কবি কালিদাস রায়কে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘জসীম মনে করেছে আমার মৃত্যুর পর সে “ময়মনসিংহ গীতিকা”র বিরুদ্ধে সমালোচনা করবে। আমি মরলে এই বাংলাদেশেই আবার ফিরে আসব। এই দেশের চাইতে সুন্দরতর স্বর্গ কোনদিনই আমি কামনা করিনি। দেহের দিক দিয়ে হয়তো আমার মৃত্যু হবে, কিন্তু মনের দিক দিয়ে এই বাংলাদেশ ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।’ (জসীম উদ্দীন ১৯৯৯ : ৬৮)
আজ দীনেশচন্দ্র সেন শুদ্ধ দেহের দিক দিয়া নহেন মনের দিক দিয়াও ইহলোকের অতীত হইয়াছেন। এদিকে মনের দিক দিয়া তাঁহার সেই বাংলাদেশও আজ আর বর্তমান নাই। তবে মনে হয় শুদ্ধ একটা জিনিশেরই মৃত্যু নাই। ইহার নাম ভবিষ্যৎ। অন্য কথা ছাড়িয়া দিলেও এক আহমদ ছফার নৈবেদ্যেই প্রমাণ দীনেশচন্দ্র সেন পুরাপুরি মরেন নাই। বাংলার ঐতিহাসিক অগ্রযাত্রার এই পর্যায়ে—মানে ১৯৭১ সালের পরে—একমাত্র দীনেশচন্দ্র সেন ছাড়া আর কোন মনীষার নাম আজ মনে পড়িবে না যাহার দিকে আজ এই সমবেত আমরাও আস্থার সহিত তাকাইতে পারি।
সত্যের অনুরোধে বলিতে হইবে, দীনেশচন্দ্র সেন কখনোই একান্ত বা নিঃস্ব ছিলেন না। উদাহরণস্বরূপ : তাঁহার কালের আরেক শ্রেষ্ঠ ইতিহাস ব্যবসায়ী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়ের কণ্ঠেও একদিন এই আর্তস্বরই শোনা যাইতেছিল। বাংলা ১৩১৪ সালে মৈত্রেয় লিখিয়াছিলেন, ‘ভারতবর্ষ বহু প্রদেশে বিভক্ত মহাদেশ। এক প্রদেশ হইতে অন্য প্রদেশ অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। বাঙ্গালা দেশ সেইরূপ। সমগ্র ভারতবর্ষের সহিত বাঙ্গালাদেশের সংস্রব থাকিলেও, বাঙ্গালাদেশের বিশেষত্বের অভাব নাই; সমগ্র ভারতবাসীর সহিত বাঙ্গালীর সংস্রব থাকিলেও, বাঙ্গালীর বিশেষত্ব দেখিতে পাওয়া যায়। সুতরাং বাঙ্গালীর একটি স্বতন্ত্র ইতিহাস ছিল। সেই ইতিহাস বিলুপ্ত না হইলে বাঙ্গালীর সর্ব্বপ্রকার বিশেষত্বের কার্য্যকারণশৃঙ্খলা বুঝিতে পারা যাইত।’ (মৈত্রেয় ২০১২ : ৫০)
সুখের মধ্যে, ইতিহাস বসিয়া থাকে না। কারণ মোটে চার আনার ইতিহাস নামের বিজ্ঞান ব্যবসায়ী যাহাই বলুন না কেন, ইতিহাস মোটেও অতীত ব্যবসায়ী নহে। তাহার এক মেরুতে সবসময়ই বর্তমান ক্রিয়াশীল। আর কে না জানে, বর্তমান বস্তুটি সদা পরিবর্তনশীল। ১৯৭১ সালে যখন সাবেক পূর্ব পাকিস্তান সাবেক পাকিস্তানের নিগড় হইতে মুক্ত হইবার সংগ্রাম রক্তপাতের পর্যায়ে পৌঁছিল তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন অধ্যাপক ততদিনে কলিকাতাবাসী পদার্থবিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু এক জলদি নিবন্ধে এই সত্যই প্রকটিত করিয়াছিলেন। ১৯৪৭ সালের কথা অবিস্মরণপূর্বক ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল বসিয়া তিনি লিখিয়াছিলেন: ‘ছেলেবেলা যখন স্কুলে পড়ি তখন দেশে এসেছিল স্বদেশী জোয়ার। তখনকার দিনে রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি সকলেই নেমেছিলেন। প্রচার করেছিলেন বাঙ্গালার ঐক্য। আমরাও রাখীবন্ধন করেছিলাম। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়িয়েছিলাম, গেয়েছিলাম “আমার সোনার বাংলা” গান। তারপর কত কী হলো। দেশের ছেলেমহলে এল বিপুল আকাঙ্ক্ষা। বিদেশী কব্জা থেকে দেশকে মুক্ত করতে হবে, ইত্যাদি নানা কথা। পথ খুঁজে বেড়িয়েছে লোকে, প্রাণ দিয়েছে অনেক। তার [পর] একসময় মনে হয়েছিল হিন্দুর ঐতিহ্য হয়তো বেশী দামী। কাজেই অনেকে স্বীকার করে নিলেন দেশ ভাগ করা যাক। হয়তো এইভাবে আমরা আবার জাতি হিসেবে মাথা তুলে উঠতে পারব।... সেদিন জ্ঞানবৃদ্ধেরা আলোচনা করেছেন, জাতির ঐক্য বলতে কী বোঝায়? এক সময় ভেবেছিলেন অনেকেই-ধর্মের ভিত্তিতেই জাতির একতা গড়ে তুলতে হয়। কিন্তু বাঙ্গালী ভুল করেছে। তবে ভবিষ্যতে বিশ্বের দরবারে মানুষের ঐতিহ্য যে ওতঃপ্রোতভাবে দেশের মাটির সঙ্গে জড়ানো, তাই প্রমাণের একটা ধাপ এগিয়ে দিল বাঙ্গালীর এই বিপুল প্রচেষ্টা [মানে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ]।’ (বসু ১৩৮৭ : ৩০৭)
জাতির ঐক্য বলিতে যাঁহারা একদা ধর্মবিশ্বাসের ঐক্য প্রচার করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করিয়াছিলেন তাঁহাদের মধ্যে যদুনাথ সরকার ইতিহাস ব্যবসায়ে সমধিক প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ততদিনে ঘোষিত হইয়া গিয়াছে কিন্তু ঠিক কার্যক্ষেত্রের কাটাকাটিটা তখনও শেষ হয় নাই। এমন সময়-জুন ১৯৪৭ নাগাদ-তিনি লিখিলেন, ‘আমরা ভারতবর্ষের কেন্দ্রের সহিত থাকিতেছি। ভারতবর্ষের কোন প্রদেশ যদি বিপথগামী হইয়া কেন্দ্রের সহিত থাকিতে অস্বীকৃতি জানায় তবে আমরা বলিব সেই প্রদেশ হইতে নিজেদের আলাহিদা করিয়া লইবার অধিকার আমাদের আছে। ইহাতে আমাদের মঙ্গল আছে আর আছে এই ভিন্নমতাবলম্বী প্রদেশবাসীদেরও পরিশেষ মঙ্গল।’ (সরকার ২০১৪ : ৫৩)
দেশভাগের অনিবার্য আরেক পরিণতির নাম সেদিন দাঁড়াইয়াছিল শরণার্থী সমস্যা। ইংরেজ শাসকদের ভারতবর্ষ ছাড়িবার একবছরের মাথায়-১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ-যদুনাথ সরকার সেই সমস্যা মোকাবেলার উপায় হিশাবে প্রগাঢ় পরিহাস রসিকতার পরিচয় দিয়াছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে অজস্র সংখ্যায় আগমনশীল পূর্ববঙ্গীয় হিন্দু বা বাঙ্গালদের সান্তনা দিবার উদ্দেশ্যে তিনি ক্ষীণকায় পশ্চিমবঙ্গের সহিত পশ্চিম এশিয়ার জায়মান এয়ুরোপিয়া এয়াহুদি রাষ্ট্রের তুলনা কাটিয়াছিলেন। তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘পূর্ববঙ্গ হইতেছে এয়াহুদি বিবর্জিত ফিলিস্তিনের তুলনা। আর আমরা পশ্চিমবঙ্গকে এয়াহুদি শাসনাধীন ফিলিস্তিনের মতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে বাধ্য—ইহা হইবে তমিস্রার মধ্যে আলোকবর্তিকাস্বরূপ, মধ্যযুগীয় অজ্ঞানভাব আর অচলিত ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের অন্ধসংস্কারে ডোবা মরুভূমির মধ্যে একখণ্ড মরুদ্যান বিশেষ।’ (সরকার ২০১৪ : ১০৩)
হয়তো এই জাতীয় উচ্চাভিলাষ তাড়িত হইয়াই বাংলামুলুকের ইতিহাস ব্যবসায়ীরা একদিন দেশভাগের আওয়াজ তুলিয়াছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসুর উক্তি—যাহা উপরে পড়িলাম—এই সত্যেরই স্মরণিকা বৈ নয়। এতদিনে কেহ কেহ এই ভুল বুঝিতে পারিয়াছেন। কিন্তু দীপেশ চক্রবর্তী ইত্যাদির মোকদ্দমা দেখিলে মনে হয় সকলেই কবি নয়, মাত্র কেহ কেহ কবি। আহা! যদুনাথ সরকার প্রণীত সুসমাচার পাঠ করিয়া দীনেশচন্দ্রের দেহাতীত আত্মা না জানি কতটা শিহরিয়া উঠিয়াছিল!
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪২৪
দোহাই
১. অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস,’ রচনা সংগ্রহ, রাজনারায়ণ পাল (সম্পাদিত), (কলিকাতা : পারুল, ২০১২)।
২. আহমদ ছফা, ‘স্মরণ : দীনেশচন্দ্র সেন,’ আহমদ ছফা রচনাবলি, নূরুল আনোয়ার সম্পাদিত, ৫ম খণ্ড (ঢাকা : খান ব্রাদার্স, ২০০৮), পৃ. ২২০-২২৪।
৩. আহমদ ছফা, ‘শতবর্ষের ফেরারি : বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,’ আহমদ ছফা রচনাবলি, ঐ, পৃ. ৩৫৩-৪০০।
৪. জসীম উদ্দীন, ‘দীনেশচন্দ্র,’ যাঁদের দেখছি, ৫ম মুদ্রণ (ঢাকা : পলাশ প্রকাশনী, ১৯৯৯)।
৫. জসীম উদদীন, স্মরণের সরণী বাহি, ২য় মুদ্রণ (ঢাকা : পলাশ প্রকাশনী, ২০০০)।
৬. প্রবোধচন্দ্র সেন, বাংলার ইতিহাস-সাধনা, ২য় মুদ্রণ (কলকাতা : পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, ১৯৯৭)।
৭. বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, ‘কৃষ্ণচরিত্র,’ বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খণ্ড : সমগ্র সাহিত্য, যোগেশচন্দ্র বাগল (সম্পাদিত), ১৪শ মুদ্রণ (কলিকাতা : সাহিত্য সংসদ, ১৪০৯)।
৮. মঞ্জুশ্রী দাসসামন্ত, প্রবাসী ও রবীন্দ্রনাথ (কলকাতা : দে বুকস্টোর, ১৯৯৭)।
৯. দীনেশচন্দ্র সেন, ঘরের কথা ও যুগসাহিত্য, ২য় মুদ্রণ (কলিকাতা : জিজ্ঞাসা, ১৯৬৯)।
১০. দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, ১ম ও ২য় খণ্ড, ৩য় মুদ্রণ (কলিকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৬)।
১১. দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, ১ম খণ্ড, ৯ম সংস্করণ (৩য় পুনর্মুদ্রণ), (কলিকাতা : পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ, ২০০২)।
১২. [নীরদচন্দ্র চৌধুরী], ‘ইতিহাস নয়,’ শনিবারের চিঠি, ৮ম বর্ষ ১১শ সংখ্যা (ভাদ্র ১৩৪৩), পৃ. ১৩০১-১৩১৫।
১৩. নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ‘বাংলা দেশ ও ভারতবর্ষ,’ অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, শ্রুত্যানন্দ ডাকুয়া সম্পাদিত (কলকাতা : সূত্রধর, ২০১৭), পৃ. ৪৯-৬৪ [প্রথম প্রকাশ: প্রবাসী, চৈত্র ১৩৩৭]।
১৪. নীরদচন্দ্র চৌধুরী, ‘বাঙালীত্বের স্বরূপ,’ অগ্রন্থিত প্রবন্ধ, ঐ, পৃ. ৮০-৯০ [প্রথম প্রকাশ : বঙ্গশ্রী, ফাল্গুন ১৩৩৮]।
১৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র : দশম খণ্ড (দীনেশচন্দ্র সেন ও অরুণচন্দ্র সেনকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের এবং রবীন্দ্রনাথকে লিখিত দীনেশচন্দ্র ও অরুণচন্দ্রের পত্রাবলী), ২য় সংস্করণ (কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৪০২)।
১৬. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাভা-যাত্রীর পত্র, পুনর্মুদ্রণ (কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৯২)।
১৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ভারতবর্ষে ইতিহাসের ধারা,’ ইতিহাস, প্রবোধচন্দ্র সেন ও পুলিনবিহারী সেন (সম্পাদিত), পুনর্মুদ্রণ (কলিকাতা : বিশ্বভারতী, ১৩৯৫)।
১৮. রমেশচন্দ্র মজুমদার, ‘বৃহৎ বঙ্গ,’ ভারতবর্ষ, ২৩ বর্ষ, ২য় খণ্ড, ৬ষ্ঠ সংখ্যা (জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৩), পৃ. ৯৫৩-৯৫৪।
১৯. রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ‘মহত্তর ভারত,’ রচনা-সংগ্রহ, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত (কলিকাতা : পত্রলেখা, ২০১৫), পৃ. ৮৭-৯৫।
২০. সমর সেন, বাবুবৃত্তান্ত ও প্রাসঙ্গিক, পুলক চন্দ সম্পাদিত, ৪র্থ সংস্করণ (কলিকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৪)।
২১. সত্যেন্দ্রনাথ বসু, ‘বাঙলা দেশ ডাক দিয়েছে,’ রচনা সংকলন (কলকাতা : বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ, ১৩৮৭), পৃ. ৩০৬-৩০৭।
২২. সুপ্রিয়া সেন, দীনেশচন্দ্র (কলকাতা : জিজ্ঞাসা, ১৯৮৫)।
২৩. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ‘বৃহত্তর বঙ্গ,’ উদয়ন, ২য় বর্ষ ৫ম সংখ্যা (ভাদ্র ১৩৪১), পৃ. ৫২৫-৫৩৮।
২৪. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, নির্বাচিত রচনা সংকলন, বারিদবরণ ঘোষ সম্পাদিত, ২য় সংস্করণ (কলকাতা : মিত্র ও ঘোষ, ১৪১৭), পৃ. ২৪২-২৫৭।
২৫. হরিদাস মুখোপাধ্যায় গয়রহ (সম্পাদিত), বিনয় সরকারের বৈঠকে: বিংশ শতাব্দীর বঙ্গ-সংস্কৃতি, প্রথম ভাগ, পুনর্মুদ্রণ (কলকাতা : দে’জ পাবলিশিং, ২০০৩), [প্রথম প্রকাশ : ১৯৪২]।
২৬. Dipesh Chakrabarty, ‘Romantic Archives: Literature and the Politics of Identity in Bengal,’ Critical Inquiry, Vol. 30, No. 3 (Spring 2004), pp. 654-682.
২৭. Dipesh Chakrabarty, The Calling of History: Sir Jadunath Sarkar and His Empier of Truth (Chicago: Chicago University Press, 2015).
২৮. Jadunath Sarkar, ‘Free Hindustan: Defence and Progress,’ in India after Independence: Writings of Jadunath Sarkar, ed. Raj Narayan Pal (Kolkatta: Parul, 2014), pp. 49-58.
২৯. Jadunath Sarkar, ‘Brothers from over the River,’ in India after Independence: Writings of Jadunath Sarkar, ed. Raj Narayan Pal (Kolkatta: Parul, 2014), pp. 102-107.
৩০. Siddhartha Sen, ‘George Abraham Grierson, 1851-1941,’ Hermathena, No. 172 (Summer 2002), pp. 39-55 (http://www.jstor.org/stable/23041283, accessed: 13-05-2017, 12:21 UTC).
পরিশিষ্ট
গ্রন্থাবলী
দীনেশচন্দ্র সেন রচিত
১. কুমার ভূপেন্দ্র সিংহ (কাব্য), ১৮৯০।
২. জন্মান্তরবাদ, ‘অনুসন্ধান’, ফাল্গুন ১২৯৭; সেক্সপীয়র বড় কি কালিদাস বড়?, ‘জন্মভূমি’, জ্যৈষ্ঠ ১২৯৮; বাল্মীকি ও হোমার, রামায়ণ ও ইলিয়ড-‘অনুসন্ধান’, জ্যৈষ্ঠ ও আষাঢ় ১২৯৯; এই প্রবন্ধসমষ্টি পরে ‘রেখা’ নামক গ্রন্থে (১৩০১, ১৮৯৫) প্রকাশিত হয়।
৩. বঙ্গভাষা ও সাহিত্য-১ম ভাগ ও ২য় ভাগ (ইংরেজ প্রভাবের পূর্ব পর্যন্ত), ১৮৯৬।
৪. তিন বন্ধু (উপন্যাস), ১৯০৪।
৫. রামায়ণী কথা (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকাসহ), ১৩১১ (১৯০৪)।
৬. বেহুলা (পৌরাণিক কাহিনী), ১৯০৭।
৭. সতী (পৌরাণিক কাহিনী), ১৩১৩ (১৯০৭)।
৮. ফুল্লরা (পৌরাণিক আখ্যায়িকা) ১৯০৭।
৯. জড়ভরত (পৌরাণিক আখ্যায়িকা), ১৯০৮।
১০. সুকথা (সন্দর্ভ সংগ্রহ), ১৯১২।
১১. ধরাদ্রোণ ও কুশধ্বজ (পৌরাণিক উপাখ্যান), ১৯১৩।
১২. গৃহশ্রী, ১৩২২ (১৯১৬)।
১৩. সম্রাট ও সম্রাট মহিষীর ভারত পরিদর্শন (সচিত্র) (ইন্ডিয়া গভর্নমেণ্ট সঙ্কলিত ১৯১১ সালে ‘রাজদম্পতির ভারত পরিদর্শনের ইতিবৃত্ত’ নামক ইংরেজি গ্রন্থের সংক্ষিপ্ত বঙ্গানুবাদ), ১৯১৮।
১৪. নীলমাণিক (পল্লীচিত্র), ১৩২৫ (১৯১৮)।
১৫. সাঁঝের ভোগ (শিশুপাঠ্য গল্প), ১৯২০।
১৬. মুক্তাচুরি (পৌরাণিক আখ্যায়িকা), ১৩২৭ (১৯২০)।
১৭. রাখালের রাজগি (পৌরাণিক আখ্যায়িকা), ১৩২৭ (১৯২০)।
১৮. রাগরঙ্গ (পৌরাণিক আখ্যায়িকা), ১৯২০।
১৯. গায়ে হলুদ, ১৩২৭ (১৯২০)।
২০. বৈশাখী (শিশুপাঠ্য গল্প), অগ্রহায়ণ ১৩২৭।
২১. সুবলসখার কাণ্ড ( বৈষ্ণব উপাখ্যান), ১৩২৯ (১৯২২)।
২২. সরল বাঙ্গালা সাহিত্য, ১৩২৯ (১৯২২)।
২৩. ঘরের কথা ও যুগ-সাহিত্য (আত্মজীবনী), ১৯২২।
২৪. বৈদিক ভারত, আশ্বিন ১৩২৯ (১৯২২)।
২৫. ভয় ভাঙ্গা (গল্প), ১৯২৩।
২৬. দেশ মঙ্গল (গল্প), ১৯২৪।
২৭. আলোকে আঁধারে (উপন্যাস), ১৩২২ (১৯২৫)।
২৮. কানু পরিবাদ ও শ্যামলী খোঁজা ( পৌরাণিক আখ্যায়িকা), ১৩২২ (১৯২৫)।
২৯. চাকুরির বিড়ম্বনা (উপন্যাস), ১৯২৬।
৩০. ওপারের আলো (উপন্যাস), ১৯২৭।
৩১. মামুদের শিবমন্দির (উপন্যাস), ১৯২৮।
৩২. পৌরাণিকী ( বেহুলা, জড়ভরত, সতী, ফুল্লরা, ধরাদ্রোণ ও কুশধ্বজ একত্রে মুদ্রিত), ১৯৩৪।
৩৩. বৃহৎ বঙ্গ-১ম খণ্ড, ১৩৪১ সাল; ২য় খণ্ড-১৩৪২ সাল।
৩৪. আশুতোষ স্মৃতিকথা, ১৯৩৬।
৩৫. পদাবলী মাধুর্য্য (সন্দর্ভ), ১৩৪৫ (১৯৩৭)।
৩৬. শ্যামল ও কজ্জল (ঐতিহাসিক উপন্যাস), ১৩৪৫ (১৯৩৮)।
৩৭. পুরাতনী (মুসলিম নারী চরিত্র), ১৯৩৯।
মৃত্যুর পর প্রকাশিত
৩৮. বাংলার পুরনারী, ১৯৩৯।
৩৯. প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে মুসলমানের অবদান (১৯৩৭ এর নভেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদত্ত চারটি বক্তৃতার সমষ্টি), ১৯৪০।
দীনেশচন্দ্র সেন কর্তৃক সম্পাদিত
১. ছুটীখানের মহাভারত (সম্পাদক-বিনোদবিহারী কাব্যতীর্থ ও দীনেশচন্দ্র সেন), ১৩১২ (১৯০৫)।
২. শ্রীধর্ম্মমঙ্গল-মাণিক গাঙ্গুলী (সম্পাদক-হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ও দীনেশচন্দ্র সেন), ১৯০৫।
৩. কাশীদাসী মহাভারত, ১৯১২।
৪. বঙ্গ সাহিত্য পরিচয় (Typical Selections from the Earliest Times to the Middle of the Nineteenth Century) ১ম খণ্ড ও ২য় খন্ড (১৯১৪)।
৫. কৃত্তিবাসী রামায়ণ, জ্যৈষ্ঠ, ১৩২৩ (১৯১৬)।
৬. গোপীচন্দ্রের গান (উত্তরবঙ্গে সংগৃহীত), শ্রীবিশ্বেশ্বর ভট্টাচার্য্য সঙ্কলিত গান, সম্পাদক-দীনেশচন্দ্র সেন ও বসন্তরঞ্জন রায়, ১ম খণ্ড-১৯২২ এবং ২য় খণ্ড- ১৯২৪।
৭. ময়মনসিংহ গীতিকা (পূর্ববঙ্গ গীতিকা)-
১ম খণ্ড-১৯২৩ (ময়মনসিংহ গীতিকা নামে প্রকাশিত);
২য় খণ্ড-১৯২৬ (পূর্ববঙ্গ গীতিকা নামে প্রকাশিত);
৩য় খণ্ড-১৯৩০ (পূর্ববঙ্গ গীতিকা নামে প্রকাশিত);
৪র্থ খণ্ড-১৯৩২ (পূর্ববঙ্গ গীতিকা নামে প্রকাশিত)।
৮. কবিকঙ্কণ চণ্ডী (সম্পাদক-দীনেশচন্দ্র সেন, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও হৃষীকেশ বসু), ১ম ভাগ-১৯২৪; ২য় ভাগ-১৯২৬।
৯. গোবিন্দ দাসের কড়চা (নব সংস্করণ), সম্পাদক-দীনেশচন্দ্র সেন ও প্রভুপাদ বনোয়ারীলাল গোস্বামী, ১৯২৬।
১০. হরিলীলা, সম্পাদক-দীনেশচন্দ্র সেন ও বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ-১৯২৮।
১১. কৃষ্ণকমল গ্রন্থাবলী, সম্পাদক-দীনেশচন্দ্র সেন ও খগেন্দ্রনাথ মিত্র, ১৩৩৫।
দীনেশচন্দ্র সেন রচিত বা সম্পাদিত ইংরেজি গ্রন্থ
1. History of Bengali Language and Literature—1911.
2. Sati—1916.
3. The Vaisnava Literature of Mediaeval Bengal (with preface by J. B. Anderson)—1917.
4. Chaitanya and His Companions—28 November, 1917.
5. The Folk Literature of Bengal—24 March, 1920.
6. The Bengali Ramayanas—1920.
7. Bengali Prose Style—1921.
8. Chaitanya and His age—1922.
9. Eastern Bengal Ballads (with foreward by Lord Ronaldshay)
Vol. I—1923;
Vol. II—1926;
Vol. III—1930;
Vol. IV—1932.
10. Glimpses of Bengal Life—1925.
সূত্র:
১. সুপ্রিয়া সেন, দীনেশচন্দ্র সেন (কলকাতা : জিজ্ঞাসা, ১৯৮৫)।
২. ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাহিত্য সাধক চরিতমালা, ৮ম খণ্ড।
(সলিমুল্লাহ খানের এই প্রবন্ধটি ফুটনোট সহ পূর্ণাঙ্গ আকারে প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর। দীনেশচন্দ্র সেন স্মৃতি বক্তৃতার অংশ হিসেবে পুস্তিকা আকারে ১৯ মে ২০১৭ তারিখে এই লেখাটি জাতীয় জাদুঘর প্রকাশ করে।)