কাস্ত্রোর ক্যুবায় মত প্রকাশের স্বাধীনতা
ভূমিকা
“আমি জানি অন্যদের চেয়ে আমার ক্ষেত্রে এই বন্দীদশা অনেক কঠিন হবে, সেটি কাপুরুষোচিত হুমকি ও অসহনীয় নিষ্ঠুরতায় ঠাসা থাকবে। কিন্তু আমি বন্দীশালাকে ভয় পাই না, যেমন আমি ভয় পাই না ঘৃণ্য অত্যাচারীর উন্মত্ততা, যে আমার ৭০ জন কমরেডের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। দোষ আমাকে দিতে পারেন। তাতে কিছু যায়-আসে না। ইতিহাস আমায় নির্দোষ ঘোষণা করবে।” (১)
১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই আনুমানিক ১৩৫ জন সঙ্গী নিয়ে ক্যুবার মনকাডা সেনা ব্যারাকে হামলা চালান ফিদেল কাস্ত্রো। উদ্দেশ্য, স্বৈরাচারী জেনারেল ফুলহেনসি বাতিস্তার জান্তা সরকারকে উৎখাত করা। এই বাতিস্তা ১৯৫২ সালের ১০ মার্চ এক সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। তাঁর শাসন থেকে ক্যুবার জনগণকে মুক্ত করতেই ওই অভিযানে নামেন কাস্ত্রো। জনগণের সমর্থন ছিল তাঁর সঙ্গে। কিন্তু বিধি বাম। ৭০ জন কমরেডের প্রাণহানি হয় এই বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে। প্রাণে বেঁচে গেলেও কদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হন কাস্ত্রো, সঙ্গে আরো ২৮ জন সঙ্গী। গোপনে তাঁকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে যাওয়ায় চাপের মুখে পড়ে বাতিস্তা সরকার, কাজেই বিচারের মুখোমুখি করতে হয় কাস্ত্রোকে। তেপ্পান্ন সালের ১৬ অক্টোবর আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর, আইনজীবী না থাকায় নিজের পক্ষে নিজেই কথা বলেন কাস্ত্রো, দীর্ঘ চার ঘণ্টা। এই কথাই, বলতে পারেন বক্তৃতা পরবর্তীকালে ‘লা ইসতোরিয়া মে এবসলবেরা’, ইংরাজিতে ‘হিস্টোরি উইল অ্যাবজলভ মি’ (ইতিহাস আমায় নির্দোষ ঘোষণা করবে) শিরোনামে খ্যাতি লাভ করে।
বিচারে কাস্ত্রোর ১৫ বছরের সাজা হলেও দুই বছরের মাথায় জনমতের চাপে পড়ে বাতিস্তা সরকার বাধ্য হয়, সাধারণ ক্ষমার আওতায় কাস্ত্রোকে মুক্তি দিতে। এরপর তিনি মেক্সিকোতে চলে যান, সফল বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন নিজেকে। চে গেভারা, খুয়ান আলমেদার, রাউল কাস্ত্রো প্রমুখ ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহযোদ্ধাদের নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ফিদেল। ১৯৫৯ সালে বিপ্লব সফল হয়, ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন বাতিস্তা। ক্যুবায় শুরু হয় কাস্ত্রোর আমল, যা চলে ২০০৮ সাল পর্যন্ত।
ক্ষমতায় থাকার পঞ্চাশ বছরে জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেমের পাশাপাশি সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেন তিনি। প্রধান শত্রু, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পেরে উঠতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয় কাস্ত্রোর ক্যুবাকে। একটা সময় মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেলে সবাই ভেবেছিল নিঃসঙ্গ হবে ক্যুবা, হাল ছেড়ে দেবেন কাস্ত্রো। কিন্তু দমে যায়নি ক্যুবা, পুরো দমে চলতে থাকে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। শিক্ষা ও চিকিৎসায় তাই ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করে ক্যুবা। শত চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জনগণের আস্থা ও ভালোবাসা থাকায় ক্যুবা সামনের দিকেই এগিয়েছে কেবল। বাতিস্তার অনেক অনুসারী বা কাস্ত্রোর প্রতিপক্ষ অথবা সমাজতন্ত্রবিরোধী অনেকেই হয়তো দেশ ছেড়েছেন, পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে, বিরোধিতা করেছেন, গোপনে হত্যার নীলনকশা এঁকেছেন, কিন্তু তারপরও কাস্ত্রো দৃঢ়তার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পেরেছিলেন, বাকি জনগণের কাছে আস্থাভাজন ছিলেন বলেই।
কাস্ত্রোর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পর, ১৯৫৯ সালের শেষের দিকে ফটোসাংবাদিক লি লকউড ক্যুবাতে যান বাস্তিতার আমলের পরিসমাপ্তি প্রত্যক্ষ করতে। তখন অনেক চেষ্টা করে তিনি ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ পান। কাস্ত্রো তখন ক্যুবাকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনায় ব্যস্ত। দেখা হওয়ার পরপরই লকউডের সঙ্গে কাস্ত্রোর সখ্য তৈরি হয়, এই সুবাদে পরবর্তী এক দশকে বেশ কয়েকবার কিউবা সফর ও কাস্ত্রোর সঙ্গ লাভ করেন লকউড। এই ফটোসাংবাদিক লক্ষ্য করলেন দ্বীপরাষ্ট্রটিতে তাঁর অবাধে যাতায়াতের ব্যাপারে কাস্ত্রোর কোনো আপত্তি নেই। এই সুযোগ তিনি গ্রহণ করেন, সাত দিন ধরে কাস্ত্রোর সাক্ষাৎকার নেন লকউড, সাল ১৯৬৫। সাক্ষাৎকারটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬৭ সালে। তর্ক সাপেক্ষে সবচেয়ে চোখা এই সাক্ষাৎকারে লকউড কাস্ত্রোকে অনেক কঠিন প্রশ্নে জর্জরিত করেন। তবে সেসব কঠিন প্রশ্নের জবাব দিতে কাস্ত্রোও ছাড় দেননি। যেমন প্রশ্ন করা হচ্ছিল, ক্যুবার সংবাদপত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে সবসময় নেতিবাচকভাবে দেখানো হয় কেন? কাস্ত্রো পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র কি ক্যুবা বা সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ভালো কিছু প্রচার করে?
মার্কিন সাংবাদিক ও ক্যুবার বিপ্লবী নেতা—দুজন দুই মেরুতে অবস্থান নিয়ে কথা বললেও, শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁরা আশা প্রকাশ করেন—দুই দেশের মানুষের মধ্যে একদিন নিশ্চয় দূরত্ব কমে আসবে। লকউড মারা যান ২০১০ সালে, ৭৮ বছর বয়সে; আর ফিদেল কাস্ত্রো ২০১৬ সালে, তখন তাঁর বয়স ৯০। আর যে ক্যুবাতে মার্কিন দূতাবাস নিজেদের পতাকা গুটিয়ে নিয়েছিল ১৯৬১ সালে, সেই পতাকা আবারও ওড়ে, নতুন করে যাত্রা শুরু করা মার্কিন দূতাবাসে, ২০১৫ সালে। কাজেই প্রশ্নকর্তা ও উত্তরদাতার আশাবাদ একসময় হয়তো ফলে যেতেও পারে।
২০১০ সাল থেকেই (ওই বছরেই লকউড মারা যান) ক্যুবার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, এমন এক পরিস্থিতিতে প্রকাশনা সংস্থা ট্যাসশেন কাস্ত্রোর সাক্ষাৎকারগুলো নতুন করে একটি সংকলনে ছাপে, নাম “কাস্ত্রো’স ক্যুবা : অ্যান আমেরিকান জার্নালিস্টস ইনসাইড লুক অ্যাট ক্যুবা ১৯৫৯-১০৬৯”, এতে যোগ করা হয় কয়েকশ ছবি, যার বেশির ভাগই আগে কোথাও প্রকাশ হয়নি। এই সংকলনে ক্যুবার শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক কাস্ত্রোর ভাবনাকে তুলে ধরা হয়। সেখানে লকউডের নেওয়া সাক্ষাৎকারটি পুনর্মুদ্রিত হয়।
বাংলায় অনুবাদের জন্য সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছে ‘দ্য প্যারিস রিভিউ’র অনলাইন সংস্করণ থেকে, যা প্রকাশ পায় ১১ জুলাই ২০১৬।
বোধিনী
১. Fidel Castro Reader, edited by David Deutschmann and Deborah Shnookal, Left Word, 2009, India.
সাক্ষাৎকার
লকউড : ক্যুবার শিল্পের ওপর কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণের আরোপের কোনো ইচ্ছা কি আছে? ধরুন সাহিত্যের ওপর?
কাস্ত্রো : সব শিল্পের প্রকাশেই একটা আলাদা ভঙ্গি রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলি, চিত্রকর্ম থেকে চলচ্চিত্র ভিন্ন। চলচ্চিত্র হলো আধুনিক শিল্প (ইন্ডাস্ট্রি অর্থে), যেখানে প্রচুর অর্থকড়ি লাগে, একটা চলচ্চিত্র বানানোর সঙ্গে ছবি আঁকা বা বই লেখার তুলনা করলে চলবে না। কিন্তু আপনি যদি জিজ্ঞেস করেন, নিয়ন্ত্রণ করা হবে কি না এসবের ওপর। উত্তর হলো—না।
লকউড : একটা বিষয় বেশ বিস্ময়কর, সেটা হলো, সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে আপনার দেশের শিল্পী বা চিত্রকর ও ভাস্কর শিল্পীদের স্বাধীনতা ভোগের মাত্রা, অন্য সাম্যবাদী দেশগুলোর তুলনায়। তবে এই উদারনীতিটা মনে হয় সাহিত্যের ক্ষেত্রে একটু কম প্রয়োগ হয়।
কাস্ত্রো : এর কারণ সাহিত্যের সঙ্গে বই প্রকাশের ব্যাপারটি জড়িত। এটা প্রধানতই একটি অর্থনৈতিক সমস্যা। আমাদের যে সামর্থ্য আছে, সেটা সব ধরনের পাঠ্যবই ছাপানোর জন্যই যথেষ্ট নয়, যেমন স্কুলের বই, রেফারেন্স সংক্রান্ত বইপত্র। আমরা চাইলেই কাগজ নষ্ট করতে পারি না। এটা আমাদের অনেকগুলোর মধ্যে একটা সীমাবদ্ধতা। তার মানে এটাও নয় যে, এর পেছনে রাজনৈতিক কোনো কর্তৃত্ব নেই। যেসব বই আমাদের মনে হয় কোনো উচ্চমূল্য যোগ করবে না, সেগুলো প্রকাশের সম্ভাবনা কম থাকে।
লকউড : কথাটি অন্যভাবে বললে, একজন লেখক যদি একটি উপন্যাস লেখেন এবং সেখানে যদি প্রতিবিপ্লবী আবেগ অনুভূতি থাকে তাহলে সেটি বোধ হয় আর প্রকাশ পাবে না, তাই তো?
কাস্ত্রো : বর্তমান সময়ে, না। একদিন হয়তো আসবে, যখন সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা অবারিত হবে, আর যখন ওই ধরনের বইও ছাপা হবে না, যেগুলো—পাঠ্যবই ছাড়াও বিশ্বসাহিত্যে যেসব বই চিরন্তন সত্যকে ধারণ করে, সেগুলোর জন্য ক্ষতিকর হবে না। তখন অনেক সম্পদ আমাদের থাকবে, যা দিয়ে বৃহত্তর মানদণ্ডে আমরা বই প্রকাশ করতে পারব, তখন যে কেউ চাইলে যেকোনো বিষয়ের ওপর তর্ক করতে পারবে। আমি, বিশেষ করে, বুদ্ধিবৃত্তির ক্ষেত্রে যতদূর পর্যন্ত আলোচনা করা সম্ভব সেটার পক্ষে। কেন? কারণ আমি মুক্ত মানবে বিশ্বাস করি, আমি সুশিক্ষিত মানুষে আস্থা রাখি, আমি এমন মানুষে বিশ্বাস করি যে চিন্তাশীল, যে নিজের বিশ্বাস থেকে, নির্ভয়ে কাজ করে। আর আমি বিশ্বাস করি, আপনার চিন্তার নিজেকে রক্ষা করার সামর্থ্য থাকতে হবে। আমি বইকে কালো তালিকাভুক্ত বা চলচ্চিত্রকে নিষিদ্ধ, এসব জিনিস করার বিপক্ষে।
ভবিষ্যতে যে ধরনের মানুষ আমরা পেতে চাই, সেখানে আমার ব্যক্তিগত আদর্শ কী জানেন? আমি চাই মানুষ এমনভাবে চর্চিত ও শিক্ষিত হবে যাতে হতবুদ্ধি করে দেয় বা বদলে দিতে চায় এমন চিন্তাভাবনার সংস্পর্শে এলে সেটাকে তারা নির্ভয়ে সঠিকভাবে বিচার করতে সক্ষম হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিজেদের নিয়ে আমরা কীভাবে ভাবি? আমরা ভাবি, আমরা যেকোনো বই পড়তে বা যেকোনো চলচ্চিত্র দেখতে পারি, যেকোনো বিষয়ের ওপর, আমাদের মৌলিক বিশ্বাসকে অক্ষুণ্ণ রেখে; কোনো বইতে যদি কোনো বিষয় নিয়ে জোরালো তর্ক থাকে, তাহলে সেটা বেশ উপকারী, সেটা ইতিবাচক, এটাকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করার সক্ষমতা আমাদের আছে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশের সব নারী-পুরুষ এমনটা হয়ে উঠুক, সেটাই চাই। আমরা এমন একটি ছাঁচেই লোকজনদের গড়তে চাই। আমরা যদি এভাবে চিন্তা না করতাম, তাহলে আমরা এমন মানুষ হতাম যাদের নিজেদের প্রত্যয় ও দর্শনের ওপরই আস্থা নেই।
লকউড : কিন্তু এমন পরিবেশ তো এ সময়ে সম্ভব নয়?
কাস্ত্রো : সেটা ভাবাটা এখন ভুল হবে। কারণ প্রথমত, এখানে অর্থনৈতিক সমস্যা জড়িত, দ্বিতীয়ত এখনো আমরা একটি লড়াইয়ের ভেতর রয়েছি।
লকউড : ‘লড়াই’য়ের নামে ক্যুবার সংবাদমাধ্যম যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে একপেশেভাবে লিখে যাচ্ছে, সেটাও তো ঠিক?
কাস্ত্রো : আমি আপনাকে বলব না যে, এটা আমরা করছি না। এটা সত্যি যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা যা বলি সেটা মূলত খারাপ দিকগুলো নিয়েই, এখানে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যায় তেমন কিছু ছাপা হওয়ার ঘটনা বিরল। আমরা আসলে সেই আচরণই করছি, যা আপনাদের দেশ করছে। আমি বলতে চাইছি, যুক্তরাষ্ট্রে যা আছে সেটা নিয়ে আমরা চেষ্টা করি সবচেয়ে বাজে মন্তব্যটাই করতে, এটা করি কারণ, যুক্তরাষ্ট্র যা করছে সেটার জবাব দিতে। তবে পার্থক্য হলো যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে আমরা যা বলি, সেগুলোর কোনোটাই মিথ্যা নয়। আমি আপনাকে বলেছি, আমরা খারাপ জিনিসটার ওপরই জোর দিই, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব দিক নিয়ে কথা বলি না, সেসব দিককে আপনি ইতিবাচক হিসেবে দেখতে পারেন, কিন্তু আমরা মিথ্যা তৈরি করি না।
লকউড : কিন্তু সেটা তো একই ব্যাপার হলো। আমাদের খারাপ দিকগুলো শুধু বড় করে দেখা হলে, আপনি সেখানে বিকৃতি সৃষ্টি করছেন, যা মিথ্যারই সমতুল্য।
কাস্ত্রো : এটা নির্ভর করে আপনি ‘মিথ্যা’ বলতে কী বোঝেন তার ওপর। আমি একমত এটা বিকৃতি। একটি মিথ্যা কিন্তু একটি ঘটনাকে ইচ্ছা করে বানিয়ে তোলা জিনিস বৈ কিছু নয়, যে ঘটনার অস্তিত্বই আসলে নেই। বিকৃতি আর মিথ্যার মধ্যেও তফাত আছে, যদিও প্রশ্নাতীতভাবে এ দুটোরই একই রকম কিছু প্রভাব আছে। এটা আদর্শ নয়। তবে এটা হলো বাস্তবতার ফল, এই বাস্তবতা আবার আমরা কারো ওপর চাপিয়ে দিইনি। লোকজনের মধ্যে বিশুদ্ধ বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা বিরাজমান, এমন শান্তির দুনিয়া আসলে হবে না। এবং এই অবস্থার জন্য আমরা দায়ী নই।
লকউড : কিন্তু আপনি যদি এ ধরনের বিকৃতির চর্চা করতেই থাকেন, তাহলে নাগরিকদের ভেতর তো শত্রুভাব আরো বেড়ে যাবে, সে ক্ষেত্রে আপনি কি কখনো শান্তি প্রত্যাশা করতে পারেন?
কাস্ত্রো : আবারও বলছি, এ জন্য আমরাই একমাত্র দায়ী নই। যুক্তরাষ্ট্রই ক্যুবার সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে।
লকউড : আমার মনে হয় এটা প্রশ্নের উত্তর হলো না।
কাস্ত্রো : আপনার সঙ্গে কথা বলে আমি আমার দায়িত্ব পালন করছি শুধু, আর এই কথাবার্তায় কোনো রাখঢাক না করেই আমাদের ভেতরকার বিষয়গুলো বলছি। এসব কথা এভাবে বলার মতো সততা আমার আছে—মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কতজন নেতা আমার মতো করে কথা বলতে পারবে?
লকউড : হ্যাঁ আপনি অনেক খোলামেলা। তবে আমি এ ব্যাপারে আরেকটু কথা বলতে চাই। আমার নিজস্ব মত হলো, ক্রমাগত আমাদের বিকৃত চেহারা প্রচারের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কিত সব জ্ঞান আপনার সমাজে উন্মুক্ত করে দিলে আরো বেশি কিছু অর্জন করতে পারবেন। যেমন—সাম্প্রতিক সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের ‘নাগরিক অধিকারের জন্য লড়াই’য়ের পক্ষে সরকারের পদক্ষেপ রয়েছে, এবং এ জন্য একটি শক্তিশালী আইনও পাস হয়েছে। এই বিষয়টা তো ক্যুবার সংবাদমাধ্যম তুলে ধরতে পারত। এটা না করে কৃষ্ণাঙ্গরা যে ক্যালিফোর্নিয়ায় দাঙ্গা করেছে বা কু ক্লাক্স ক্ল্যান (Ku Klux Klan) যে জর্জিয়া ও আলাবামায় এগিয়ে যাচ্ছে, শুধু এ ধরনের খবরই আপনারা ছাপেন।
কাস্ত্রো : আমি যেটা বুঝি, আইনের খবরটি এখানে প্রকাশ হয়েছিল, আর স্বভাবতই এ ব্যাপারে আপনাদের থেকে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি যথেষ্ট আলাদা। আমরা বিশ্বাস করি, বৈষম্যের সমস্যার সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয় জড়িত এবং এটির ভিত্তিমূলে আছে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ, যেখানে মানুষের দ্বারা মানুষ শোষিত হচ্ছে।
এটা স্পষ্টতই একটি কঠিন ও জটিল সমস্যা। আমরা নিজেরাও এ বৈষম্যের অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে গিয়েছি। বৈষম্য ঘুচবে তখনই, যখন শ্রেণির বিভেদ বিলুপ্ত হবে। কম কষ্টেই এ বিপ্লব ঘটানো সম্ভব, এবং সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। আমার মনে হয় না, এটা যুক্তরাষ্ট্রে করা সম্ভব হতো। এ মুহূর্তে সেখানে বিপ্লবের কথা বললে একটু অদ্ভুতই শোনাবে। হয়তো যুক্তরাষ্ট্রে কখনোই বিপ্লব সংঘটিত হবে না, ধ্রুপদি অর্থে বিপ্লব বোঝাচ্ছি, তবে এর বদলে হয় তো ক্রমবিকাশের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন সাধিত হবে। আমি নিশ্চিত, উদাহরণস্বরূপ বলছি, পাঁচশ বছরের ভেতর উত্তর আমেরিকার যে সমাজ আমরা দেখছি, সেটা আমূল পাল্টে যাবে, হয়তো এ সময়ের মধ্যেই বৈষম্যজাত সমস্যা আর তাদের থাকবে না।
লকউড : কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলো নিয়ে কথা হচ্ছে না কেন? কেন ক্যুবার জনগণ পুরো ইতিহাস বলা হচ্ছে না?
কাস্ত্রো : এর কারণ সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এখনো ইতিবাচক অর্থে ক্রমবিকাশের ধারায় যে পরিবর্তন, সেটা হয়নি। তবে এর পরিবর্তে, রাজনৈতিকভাবে বললে, সত্যিকারের পশ্চাদগতি হয়েছে। আমরা সাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বলতে পারি, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি, তার সব পররাষ্ট্রনীতির ঊর্ধ্বে, একটি অগ্রবর্তী অতি প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানের দিকে অনেক, অনেক অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
লকউড : আমরা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে কথা বলছিলাম না।
কাস্ত্রো : বাস্তবতা হলো এই নীতির কারণেই আমরা অনেক বেশি আক্রান্ত।
লকউড : যেহেতু এই বিষয় নিয়ে আলাপ করছি, আমার কাছে মনে হয়েছে এখানে সরকারি সব চিন্তাধারা থেকে যারই বড় ধরনের ভিন্নমত রয়েছে, গণমাধ্যমে নিজেকে প্রকাশে তারই সবচেয়ে কম সুযোগ রয়েছে। সত্যি বলতে, ক্যুবার পত্রিকায় সরকারের সমালোচনা নেই বললেই চলে। পত্রিকাকে মনে হয় সরকারেরই একটি অঙ্গ।
কাস্ত্রো : যেটা আপনি বললেন, সেটা সত্যি। এখানে সমালোচনা কমই করা হয়। সাম্যবাদের কোনো শত্রু আমাদের পত্রপত্রিকায় লিখতে পারেন না— কিন্তু আমরা সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করি না, আবার আমরা গণমাধ্যমের প্রকল্পিত স্বাধীনতা, যেটি বাস্তবে বিরাজই করে না, সেটি ফলাও করে বলি না, অথচ আপনারা সেটাই করেন। তা ছাড়া, আমি মেনেও নিই যে এই ক্ষেত্রে আমাদের সংবাদমাধ্যমের একটু কমতি রয়েছে। আমি মনে করি না, সমালোচনা কম থাকা কোনো স্বাস্থ্যকর বিষয়, বরং সমালোচনা একটি দরকারি ও ইতিবাচক অস্ত্র, আর আমার মনে হয়, আমাদের সকলের এই অস্ত্রের ব্যবহার শেখা উচিত।
লকউড : আপনি কি মনে করেন না, সে রকম পরিবেশ থাকলে, মানে যে পরিবেশে সমালোচনাকে গঠনমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে, ক্যুবার লেখকরা সেই অস্ত্রের ব্যবহার করত?
কাস্ত্রো : সমালোচনা, হ্যাঁ—কিন্তু সেটা শত্রু বা প্রতিবিপ্লবের পক্ষে গেলে কাজ করবে না।
লকউড : কিন্তু কোন সমালোচনা গঠনমূলক আর কোনটি প্রতিবিপ্লবী, সেটা ঠিক করবে কে?
কাস্ত্রো : দেখুন, আমরা এখন একটা লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, কমবেশি এটাকে খোলামেলা যুদ্ধই বলতে পারেন, আর যখন, উদাহরণস্বরূপ বলছি, যুক্তরাষ্ট্র এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, দেশটি যখন যুদ্ধে লিপ্ত তখন ভিন্ন সুরে কথা বলা লোকদের কিন্তু বিনা বিবেচনাতেই দমন করা হয়েছে। আপনারা যখন নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছিলেন, তখন আপনাদের এই নীতি ছিল।
লকউড : আপনি কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। সমালোচনার বিষয়টি কে ঠিক করবে?
কাস্ত্রো : সে রকম পরিস্থিতিতে দল সিদ্ধান্ত নেবে, রাজনৈতিক যে শক্তি, বিপ্লবী যে শক্তি, সে সিদ্ধান্ত নেবে। সাধারণত যখন আমাদের সে রকম পরিস্থিতি আর থাকবে না, পদক্ষেপ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তাও আসলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।
লকউড : কিন্তু সে রকম পরিস্থিতির আগপর্যন্ত তো আপনার সমাজে কোনো সমালোচনাই থাকছে না, পত্রিকায় যেমন থাকছে না, তেমনি থাকছে না সাহিত্য, বেতার কি টেলিভিশনে, অথবা ক্যুবাতে যত রকম যোগাযোগের মাধ্যম রয়েছে কোথাও সমালোচনা থাকছে না।
কাস্ত্রো : অবশ্যই ন্যূনতম সমালোচনা তো আছেই। আরো বিষয় আছে—আমাদের মনোযোগী হতে হবে সাংবাদিকতা-সংশ্লিষ্ট কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে, কারণ তাঁরা যা বলেন বা লিখেন সেটা লাখ লাখ মানুষ পড়ে। যদি ভবিষ্যতে আমাদের বৃহত্তর সংস্কৃতির লোক তৈরি হয়, তাহলে তাদের সংস্পর্শে এসে অন্য মানুষও সেই সংস্কৃতিকে ধারণ করা শুরু করবে, তখন সমাজে ভূমিকা রাখার জন্য সত্যিকারের কাজের মানুষ পাওয়া যাবে। আমরা মনে করি, আধুনিক জীবনে সাংবাদিকতার বিভিন্ন যেদিক আছে, সেগুলোর বেশ গুরুত্ব আছে।
আমি আপনাকে এটা বলব না যে বর্তমান পরিস্থিতির কারণে আমরা সব গুলিয়ে ফেলেছি, দেশের রাজনৈতিক ও বিপ্লবী লক্ষ্য ছাড়াও সাংবাদিকতা আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে ভিন্ন ক্ষেত্রে। আমাদের একটি লক্ষ্য রয়েছে, কর্মসূচি রয়েছে, পূরণ করার জন্য উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সেই উদ্দেশ্যই মূলত সাংবাদিকতার কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ করে। আমি বলব, এটি প্রধানত নিয়ন্ত্রণ করে বুদ্ধিজীবী শ্রমিকদের শ্রমকে। আমি এটাকে অস্বীকার করব না।
লকউড : কিন্তু সব ধরনের সমালোচনাকে দমন করার ভেতরে কি কিছু বিপদ রয়েই যাচ্ছে না?
কাস্ত্রো : আমি একমত। আমি এটা বলিনি যে সব সমালোচনা না থাকলে সেটাই ভালো হবে; বরং এতে আরো ক্ষতি হয়।
লকউড : আপনার কি মনে হয়, এমন পরিস্থিতি তৈরির পেছনে দায় কার?
কাস্ত্রো : আমার মনে হয়, এর পেছনে অনেক অবস্থাই দায়ী, কিন্তু মূলত দায়ী জরুরি অবস্থা ও চাপ, যার ভেতর দিয়ে দেশ চলছে, আমাদের প্রথম দরকার খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার জন্য বাকি সব কর্মকাণ্ডকেই এখন দ্বিতীয় সারিতে পাঠিয়ে দেওয়া দরকার।
লকউড : ‘প্রতিবিপ্লবে’র বিরুদ্ধে আপনার ব্যক্তিগত শক্তিশালী অবস্থানই হয় তো এই বিধিনিষেধের আবহ তৈরিতে প্রভাব ফেলেছে। এটা কি অসম্ভব, যে একবার এই আবহ তৈরি হয়ে গেলে কোনো বুদ্ধিজীবী হয়তো ভীত থাকবেন, ভাববেন যেকোনো সমালোচনামূলক ভাবনাকেই সরকার প্রতিবপ্লবী বলে ভেবে বসতে পারেন? এ ক্ষেত্রেই বোধ হয় আপনি সবচেয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন সব সময়, যোগাযোগ ছিন্ন করেছেন আপনার সঙ্গে সেসব মেধাবী লোকজনকে, যাঁরা নিজেদের অবস্থান থেকে কোনো একটা সমস্যাকে চিহ্নিত করতে পারেন বা যাঁদের আরো উন্নত ভাবনা থাকতে পারে। সমালোচনামূলক মন্তব্যের শ্বাসরোধ করে, আপনি কি এমন একটা অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করছেন না, যেখানে অন্য কারো নয়, শুধু আপনার নিজের ভাবনার কথাই শোনা যাবে?
কাস্ত্রো : আমি স্বীকার করছি, ওসব বিষয়গুলোর ওপর আমাদের মনোযোগ দিতে হবে নিকট ভবিষ্যতে। কারণ, অন্য বিষয়গুলো আমাদের মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে, যেসব ঘাটতি আমাদের আছে, সেসব নিয়ে ভাববার ক্ষমতা আমাদের এত দিন ছিল না।
লকউড : সমালোচনার অভাবের বিষয়টি শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রয়োগ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আপনার দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যালয়গুলো ঘুরে আমি সব জায়গাতেই দেখতে পেলাম, বইতে যা আছে সেটাই শেখানো হচ্ছে, প্রশ্ন করতে শেখানো হচ্ছে না। আপনার কি মনে হয় না, এটা আপনার দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য বুদ্ধিজীবী তৈরির ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ?
কাস্ত্রো : আমার মনে হয়, শিক্ষার্থীদের শিক্ষা অনেকাংশেই নির্ভর করে প্রশিক্ষণের মাত্রা ও শিক্ষকের সামর্থ্যের ওপর। কাজেই এটা নীতির প্রশ্ন নয়। শিশুকে অবশ্যই চিন্তা করতে শেখাতে হবে—শিক্ষকতার মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত শিশুর বুদ্ধিমত্তাকে উন্নত করা। যাই হোক, আপনি যেসব বিষয় লক্ষ্য করেছেন আমি সেগুলো নিয়ে চিন্তা করব। অন্য বিষয়ের সঙ্গে আমরা বেশ জোর দিচ্ছি আমাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে, শিক্ষা-সংক্রান্ত একেবারে উচ্চতম পর্যায়ে এটা হবে। এটা ভুলে গেলে চলবে না, আমরা যে অবস্থার মধ্যে বাস করেছি, সেটা স্বাভাবিক কিছু ছিল না—ভয়াবহ শ্রেণিসংগ্রামের ভেতর দিয়ে আমরা গিয়েছি, সেখানে কাজ করেছে ধারণার দ্বন্দ্ব, বিচার-বিবেচনা ও অনুভূতির দ্বন্দ্ব। এসব কিছু মিলে এক ধরনের পরিবেশ সৃষ্টি করে, সেখানে নানা রকমের বিধিনিষেধও তৈরি হয়…
যাহোক, সূচনা পর্বে আমরা আসলে এসব নিয়ে খুব বেশি চিন্তিত ছিলাম না। আমাদের মূল ভাবনা ছিল যেখানে অ-আ-ক-খ লেখাপড়া শেখানোর জন্য কোনো শিক্ষক নেই সেখানে বিদ্যালয় খোলা। প্রথম ধাপে শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা প্রাথমিক বিষয়গুলো নিয়ে ভেবেছি, অনেক কিছুই এখানে তৈরি করে নিতে হয়েছে, কারণ আমাদের দক্ষ লোকের অভাব ছিল। যেসব বাচ্চা এখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ে এবং ভবিষ্যৎ বুদ্ধিজীবী, যারা আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক, তারা যেন গোঁড়ামি পদ্ধতির শিক্ষা না পায়, সেটা আমাদের নিশ্চিত করতে হবে, সেটা করাটাই যৌক্তিক, তবে এর পাশাপাশি তাদের নিজেদের জন্যই চিন্তা ও বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতাকে উন্নত করতে হবে।
লকউড : আমি নিজে শ্রেণিকক্ষে দেখেছি, সেখানে বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরা হয় এক ধরনের গোঁড়ামি নিয়ে। উদাহরণস্বরূপ বলি, আমরা একটু আগেই বলছিলাম যে কীভাবে এখানকার পত্রিকাগুলো যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ইতিবাচক কোনো চিত্র প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে। দেখুন, যুক্তরাষ্ট্রবিষয়ক ঘটনাগুলো যেভাবে বর্ণনা করা হয় ছাত্রদের কাছে, সেখানে তো পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত দৃষ্টিভঙ্গিই উপস্থাপন করা হয় হুবহু, বারবার করা হয়, কোনোরকম শোধন ছাড়াই। এই যে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের সামনে যে এ ধরনের, একপাক্ষিক ছবি তুলে ধরা হচ্ছে, পুরো বিদ্যালয় জীবনজুড়ে, সম্ভবত প্রথম শ্রেণি থেকে, তারা বড় হলে কী হবে?
কাস্ত্রো : কোনো সন্দেহ নেই, যুক্তরাষ্ট্র বা দেশটির যেকোনো কিছু সম্পর্কে তাদের বাজে ধারণা জন্মাবে। যেভাবে মার্কিন শিশুরা শিক্ষিত হয়, সমাজতন্ত্র সম্পর্কে খুব খারাপ ধারণা নিয়ে। এটা দুঃখজনক, কিন্তু এটাই বাস্তবতা।
লকউড : একদিন পুনরায় যুক্তরাষ্ট্র ও ক্যুবার মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে। যখন সেটা হবে, তখন কি এটার রেশ আপনাদের বহন করতে হবে না? তরুণ বয়সেই যাদের ভেতর আপনি খারাপ অনুভূতি ঢুকিয়ে দিচ্ছেন?
কাস্ত্রো : এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। তা ছাড়া এমন প্রশ্ন আগে কেউ কখনো করেননি। আসলে এ রকম প্রশ্ন এবারই প্রথম কোনো উত্তর আমেরিকানের মুখ থেকে শুনলাম। এ ধরনের কথা আমরা নিজেদেরও বলি না। এটা বলতে পারেন, এ সমস্যা নিয়ে আমরা কখনই সচেতনভাবে ভেবে দেখিনি। হয়তো এর পেছনে আমাদের কিছুটা হতাশাও কাজ করেছে, এই হতাশা হলো যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে নিয়ে, যাদের মতামত প্রকাশের সুযোগ সেই অর্থে নেই, অবস্থা পরিবর্তন করার সামর্থ্যও নেই।
এমনটাও হবে হয়তো যে আমরা নিজেরা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি, নিগ্রোদের সঙ্গে সংহতির অনুভূতি কতটা গভীরভাবে উত্তর আমেরিকার মানুষের হৃদয়ের ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছে। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই, আর এ কারণেই আমরা বোধ হয় কিছু মাত্রা পর্যন্ত মার্কিন জনগণকে অবমূল্যায়ন করি। এটা কিন্তু সুচিন্তিত নীতির ফল নয়। যদি কখনো আপনি বই প্রকাশ করেন তখন হয়তো আমাদের যাঁরা সংবাদপত্রে কাজ করেন, তাঁরা প্রশ্নগুলোর দিকে মনোযোগ দেবেন। আমি, আমার ক্ষেত্রে বলছি, তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে, তাদের বলেছি এসব বিষয়ে একটু নজর দিতে। আপনি যেমনটা বললেন, যেকোনো কিছুর দোহাইতেই হোক, আমি মনে করি সত্যি, একদিন—এখনই হবে সেটা একেবারেই বিশ্বাস করি না, কিন্তু একটা দীর্ঘ সময় পর—আমাদের দুই দেশের জনগণের ভেতর সুসম্পর্ক বিরাজ করবে।
লকউড : আমার মনে হয়, অযথা কারণে দীর্ঘ করার চেয়ে সুসম্পর্ক গড়ার এই সময়টা যতটুকু সম্ভব, আমাদের কমিয়ে আনার চেষ্টা করা দরকার।
কাস্ত্রো : আমার মনে হয় সেটাই যুক্তিসংগত। চলুন, দুপুরের খাবারটা সারি।
ভূমিকা ও অনুবাদ : বিধান রিবেরু