বাঙ্গালি সংস্কৃতি : গ্রহণ-বর্জনের সংকট
[‘বাঙ্গালি সংস্কৃতি : গ্রহণ বর্জনের সংকট’ শিরোনামে মুদ্রিত এই লেখাটি—খানিক আগাইলেই বুঝিবেন—আসলে লেখা ছিল না—ছিল একটি বক্তৃতার লিখিত রূপ। এই বক্তৃতার শিরোনামটিও আমার দেওয়া নহে। ঐ বক্তৃতার জন্য বিশেষ কোন নোটও আমি ব্যবহার করি নাই। সেদিন আমার হাতে একটা পত্রিকার একটা সংখ্যা ছিল। সেই পত্রিকা হইতে কয়েকটি পংক্তি আমি পড়িয়া শুনাইয়াছিলাম। বক্তৃতাটি ছাপা হইয়াছিল—এতদিনে মনে পড়িতেছে— ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি’ নামক একটি সংকলনে। সংকলনটি প্রকাশিত হইয়াছিল রাজশাহী হইতে—বাংলা ১৩৯০ সনের কোন একসময় অর্থাৎ ইংরেজি ১৯৮৩ কিম্বা ১৯৮৪ সালে। সংকলনটি সম্পাদনা করিয়াছিলেন সম্প্রতি পরলোকগত নাজিম মাহমুদ।
‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন’ এতদিনে একটি প্রতিষ্ঠান হইয়া উঠিয়াছে। যতদূর মনে পড়ে প্রথম জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হইয়াছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। সে আজিকার নহে, আজি হইতে তিরিশ-পয়ত্রিশ বছর আগেকার, সেই ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে কোন এক অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ পাঠ করিয়াছিলেন গণ্যমান্য লেখক হাসান আজিজুল হক। তাঁহার প্রবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘বাঙ্গালি সংস্কৃতি: গ্রহণ বর্জনের সংকট।’ আমার বক্তৃতা ছিল তাঁহার প্রবন্ধের উপর মন্তব্যস্বরূপ—এই কথাটা না বলিলেই নয়।
আমি সদ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যুক্ত হইয়াছি। সম্মেলন কর্তৃপক্ষ—বিশেষ করিয়া সম্মেলনের প্রাণভোমরা এখন পরলোকগত ওয়াহিদুল হক—আমাকে সেই অধিবেশনে আমন্ত্রণ জানাইয়া বিশেষ বাধিত করিয়াছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার নাজিম মাহমুদ ছিলেন সেই সম্মেলনের কার্যবিবরণীতুল্য এই সংকলনটির সম্পাদক। সংকলনটির অন্তর্গত আমার বক্তৃতার শ্রুতিলিপি আমার সংগ্রহ হইতে হারাইয়া গিয়াছিল। সম্প্রতি আমার একজন তরুণ বন্ধু লেখাটি সংগ্রহ করিয়া আমাকে বিশেষ বাধিত করিয়াছেন। এখানে মুদ্রণের জন্য প্রুফ কাটিতে বসিয়া আমি কয়েকটি বানান বদলাইয়া লইয়াছি। এই বানানমণ্ডলীর মধ্যে বিশেষ উল্লেখ করার মতো স্বয়ং আমার নামের বানান। যে সকল নতুন শব্দ এই যাত্রা ঢুকাইয়া লইয়াছি সেগুলি বন্ধনীযোগে দেখান হইয়াছে।—ঢাকা, ডিসেম্বর ২০১৭]
সংস্কৃতি সম্পর্কে কমপক্ষে আড়াইটা ধারণা আমার মনের মধ্যে প্রবেশ করেছে এই দুই দিনের আলোচনা থেকে। একটা ধারণা—হাসান [আজিজুল হক] আজকে উল্লেখ করেছেন—মানুষের বাঁচার সংগ্রামের যে ইতিহাস সেটা তার সংস্কৃতি। আবার কার্যক্ষেত্রে সংস্কৃতি বলে এখানে যেটা পেশ করা হচ্ছে—রবীন্দ্র-সঙ্গীত, শিল্প-সাহিত্য বা ‘গল্পগুচ্ছে’র কথা, ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’র কথা পর্যন্ত এসেছে। দুটোয় কিন্তু তালগোল পাকানোর একটা ব্যাপার আছে। বাকি আধাটা কি সেটা আমি কালকেও জনাব ওয়াহিদুল হকের কথায় শুনেছি। অবশ্য আলোচনার সুবিধার্থে পণ্ডিতগণকে অনেক সময় ভাগ করে কথা বলতে হয়। রাজনীতি এবং সংস্কৃতি দুটোকে তিনি আলাদাভাবে দেখাচ্ছেন। এই যে অর্ধ-সংস্কৃতির একটা মনোভাব আছে, রাজনীতি যেন সংস্কৃতি নয়, সংস্কৃতি যেন রাজনীতি নয়। এটা বলার ভঙ্গির ত্রুটির জন্য হতে পারে কিন্তু ব্যাপারটা অর্ধ-সংস্কৃতি হিশেবেই আবির্ভূত হয়। আমার মূল বক্তব্য হলো আরো একটু ভিতরে।
আমাদের আলোচনায় সবসময়ই মনে হয়েছে, ধর্ম এবং সংস্কৃতি উভয়ের মধ্যে যেন একটা বিরোধ আছে এবং এটাই যেন আমাদের মূল বিরোধ। ধর্মকে যাঁরা ব্যবহার করছেন বা যাঁরা প্রকৃতপক্ষে জনগণের সংস্কৃতি চাচ্ছেন তাঁদের মধ্যে যে বিরোধ নেই সেটা আমি বলবো না। কিন্তু এটাই কি মূল বিরোধ? না বিরোধের প্রতিভাস? না বিরোধের অভিব্যক্তি? সেটা আমাদের নির্ণয় করা দরকার। আমি পশ্চিমবঙ্গের কথাটা এই জন্যেই বলছি। এখানে—পূর্ববঙ্গে—মুসলমানদের মধ্যে একটা হীনমন্যতার বহিঃপ্রকাশ সবসময়ই আমরা লক্ষ করেছি। আমাদের সাধারণ লোকদের মধ্যে একটা ধারণা যে পূর্ববঙ্গের লোকেরা কম লেখাপড়া জানে এবং পশ্চিমবঙ্গই বেশি জানে। আমি উদাহরণটা [তাই] পূর্ব বাংলা থেকে না দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকেই দিচ্ছি।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিবনারায়ণ [রায়] বাবু বলে এক ভদ্রলোক একটা কাগজ বের করেন ‘জিজ্ঞাসা’ নামে। তাতে কিছুদিন আগে প্রয়াত—বাংলাদেশে দার্শনিক নামে খ্যাত—আবু সয়ীদ আইয়ুবের একটা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধটির নাম হচ্ছে ‘সংস্কৃতিসংকট না সংস্কৃতিসংঘাত?—এবং প্রসংগত।’ তাতে ভদ্রলোক লিখেছেন, আমি আপনাদেরকে উদ্ধৃতি নিয়ে পড়ে শোনাচ্ছি, ‘সংস্কৃতি সমাজের উপরিতলের ব্যাপার, অবশ্য বিত্তবান বলতে যাদের বোঝায়—টাটা, বিড়লা, ডালমিয়া, বাজাজ—তাঁদের কথা ভাবছি না, ভাবছি সেইসব মধ্যবিত্তের কথা যাঁরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ পেয়েছেন এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে—জ্ঞানবিজ্ঞান শিল্প-সাহিত্যের চর্চা, সেইসব ক্ষেত্রে—সৃষ্টিশীল হবার সাধনা না করলেও যথোপযুক্তভাবে গুণ গ্রহণ করবার শক্তি অর্জন করেছেন।’ [ভদ্রলোক] আরো লিখেছেন, ‘কেউ কেউ দেবদত্ত ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।’
আমি বিস্তারিত না পড়েই আলোচনাটা এভাবে [এগিয়ে] নিয়ে আসতে পারি। সাধারণভাবে সমাজচিন্তা, দর্শনচিন্তা বাঙ্গালি সমাজের কি পর্যায়ে যে নেমেছে তার উদাহরণ হিশেবে এই সমাজের তথাকথিত শ্রেষ্ঠ লোকটিকে পেশ করলাম। আরো যদি আলোচনা করি তবে আরো ভুরি ভুরি দুর্গন্ধ বেরুবে।
১
বাঙ্গালি সংস্কৃতির আজকে প্রধান উপাদান হচ্ছে—চিন্তাহীনতা। গতকালকে একটা কথা ওয়াহিদ ভাই [ওয়াহিদুল হক] বলেছিলেন এবং আরো আগে হায়াৎ মামুদ প্রস্তাব তুলেছিলেন রবীন্দ্র-সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের কি করা দরকার। তাঁদের মতে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে বেশি করে বই লেখা দরকার। ওয়াহিদ ভাই বলেছেন—আসলে শিল্পযাপন করা দরকার। আত্মাকে সংস্কার করে যে বস্তু [তার নাম শিল্প—তাই] সেই শিল্পকে চর্চা করা দরকার। আমি কথাগুলির সাথে দ্বিমত পোষণ করি না, কিন্তু কথাগুলি যে কি ভয়ানকভাবে খণ্ডিত তার [দিকে] আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই।
আসলে এটা খুবই পরিচ্ছন্ন ব্যাপার যে রবীন্দ্রনাথ ভারতীয় উপমহাদেশে একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশ্ব-সাহিত্যের দরবারে [আমাদের সভ্যতাকে]—বাঙ্গালি সভ্যতাই বলুন আর ভারতীয় সভ্যতাই বলুন—তুলে ধরেছেন। এখন [বিবেচনা করে দেখি], রবীন্দ্রনাথের শেষ বাসস্থান শান্তিনিকেতন। তার অদূরেই সাঁওতালরা আছেন, তাঁরা হয়তো এখন পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের নামই শোনেননি। এরকম পরস্পরবিরোধী অবস্থা বাংলাদেশে বিরাজ করছে—এমনকি সমগ্র ভারতবর্ষেও তাই বিরাজ করছে।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে প্রবন্ধ বেরুচ্ছে না, গবেষণা হচ্ছে না—এটা সত্যি নয়। হয়তো পূর্ব বাংলায় হচ্ছে না—এখানে একটা বিশেষ রাজনৈতিক অবস্থা ছিল—কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমরা আরো সক্রিয়ভাবে ব্যবহার করেছি আমাদের মুক্তিসংগ্রামে। কিন্তু একটা জিনিশ লক্ষ করেছেন যে রবীন্দ্রনাথের মতন সৃষ্টিশীল প্রতিভা আর একটাও তৈরি হলো না বাঙ্গালিদের মধ্যে। অনেক প্রতিভাবান লোকের জন্ম হয়েছে তা আমি অস্বীকার করবো না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের সমকক্ষ কেউ হননি। রবীন্দ্রনাথকে যাঁরা অনুসরণ করে শান্তিনিকেতনে [বসে] আছেন তাঁরাও সৃষ্টিহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। তাহলে রবীন্দ্রনাথের সংস্কৃতিচর্চার আসল মর্মটা কি? যদি এই প্রশ্ন আমি তুলি, আমি বলবো সেটা রবীন্দ্রনাথের উপর তথাকথিত গবেষণা করা মাত্র নয়—তথ্য সংরক্ষণের জন্যে শুধু আরো কয়েকটি রবীন্দ্রভবন করা নয়—রবীন্দ্রনাথ যে অনুপ্রেরণার সাথে—যে রকম সৃষ্টিশীলতার সাথে—বিশ্বের দরবারে বাংলা [ভাষার] সম্মানকে উন্নীত করেছেন সে রকম বিপুল সৃষ্টিশীলতার পরিচয় দেওয়া।
কিছু লোকের রবীন্দ্রনাথকে একটা অনৈতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার প্রবণতা আছে। সমগ্র বাঙ্গালি সংস্কৃতি সম্পর্কেও এই ধারণাটা দেখতে পাচ্ছি। কিছু লোকের মধ্যে যাঁরা পুঁজিবাদের আদর্শের অনুসারী তাঁদের মধ্যে এই ভাবালুতাটা প্রচ্ছন্ন। রবীন্দ্রনাথ ভাবালুতার প্রশ্রয় দেননি। রবীন্দ্রনাথের মধ্যে একটা যুক্তিবাদী মন ছিল। যেটা [মহাত্মা] গান্ধির সাথে [খোদ] রবীন্দ্রনাথের বিরোধের মধ্যেও দেখা যায়। রবীন্দ্রনাথ কাউকে সমীহ করে কথা বলেননি। রবীন্দ্রনাথের ঐতিহ্যকে যদি অনুসরণ করতে হয় তাহলে তাঁর যুক্তিশীলতাকে প্রতিষ্ঠা করাই একটা [কাজের মতো] কাজ।
হাসান আজিজুল হকের প্রবন্ধ শোনার সময় এই রকম আমারও মনে হয়েছে যে আরো বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত ছিল। আজকের সংস্কৃতির আসল ভিত্তিটা যে বিদেশিদের প্রভাব বা সাম্রাজ্যবাদের লগ্নিপুঁজি এ ধরনের একটা কথা এসেছে। গতকালকে [অধ্যাপক] শহিদুল ইসলাম যখন আলোচনা করছিলেন তখন তিনিও বলছিলেন যে ‘বিদেশিদের প্রভাব’ জাতীয় একটা ব্যাপার আছে। আমি প্রশ্ন করতে চাই, এটা [মাত্র] একটা ব্যাপার হলো! যেটা আমাদের সমগ্র অস্তিত্বের ভিত্তি সেটাকে শুধু একটা ব্যাপার হিশেবে, জাস্ট একটা ডেকোরেটিভ অ্যাফেয়ার হিশেবে ধরা যায় না। ঘটনাটা আর একটু খুলে বলি। আমাদের সংস্কৃতিকে যদি শুধুমাত্র সাহিত্য শিল্পকলা দর্শন সংস্কৃতি ধর্ম এই সমস্ত কম্পোনেণ্ট বা রিফ্লেকশন অব কালচারের মধ্যে সীমিত রাখি তবে আমরা অনিবার্য বিরোধের মধ্যে পড়ি।
২
আমাদের উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তন এবং আমাদের অন্তর্নিহিত শক্তি—এইসব কথা আমাদের ভাবতেই হবে। শুধু নিছক সংস্কৃতির কথা ভাবা যাবে না। আজকে যখন প্রশ্ন আসছে আমাদের দেশে বিদেশি সংস্কৃতির প্রভাবের কথা, অপসংস্কৃতির প্রভাবের কথা, এটাকে যদি ঠেকাতে হয় তবে শুধুমাত্র ভাবালুতা দিয়ে—কান্না[কাটি] দিয়ে, আর্তনাদ[আহাজারি] দিয়ে—বা নিজেদের মধ্যে শিল্পকলার তথাকথিত সংস্কার দিয়েও হবে না। এটা সুস্পষ্টভাবে একটা আন্দোলনের প্রশ্ন। আন্দোলন বলতে শুধুমাত্র আমি রাস্তার শ্লোগান বা মিছিলকেই বুঝি না। আন্দোলন একটা বড় কথা। আন্দোলন মানে নড়াচড়া। এই আন্দোলন অবশ্যই সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি।
মানুষ অনেক কাজ করে। কিন্তু মানুষের নির্ধারক কাজ হচ্ছে মানুষ উৎপাদন করে। এটাকে যদি বৈজ্ঞানিক মাপকাঠিতে নির্ধারণ না করি তাহলে আমরা আন্দোলন [কি বস্তু তা] বুঝতে পারবো না। এ আন্দোলনকে সংক্ষেপে রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যেতে পারে। রাজনৈতিক আন্দোলন কি সংস্কৃতি-বিবর্জিত হয়? বিদেশি আধিপত্যের হাত থেকে যদি আমরা উদ্ধার পেতে না পারি তাহলে আমরা সফল হবো না। আধিপত্যটা কি সেটাই আমাদের বোঝা দরকার। কোন [একটা] দেশ আমাদের দেশ দখল করলো—সেটাই কি শুধু বিদেশি আধিপত্য?
বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে আগে উৎপাদন [করতো] এবং কিভাবে আজও উৎপাদন করছে, সেটা যদি তুলে ধরতে পারি তাহলে আধিপত্যের একটা রূপ ধরতে পারি। এদেশের প্রাক-পুঁজিবাদী সংস্কৃতি ধ্বংস করে দেবার জন্য এমন একটা ঐতিহাসিক ব্যবস্থা এসে উপস্থিত হলো ইংরেজদের মাধ্যমে। এটা নিয়ে অগ্রসর হলো উৎপাদন-ব্যবস্থা। তা থেকেও আস্তে আস্তে বাংলাদেশের বাজার আন্তর্জাতিক বাজারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল এবং সে বাজারের অন্তর্ভুক্তি থেকে আমরা এখনো মুক্তি পাইনি, যদিও বা এক ধরনের রাজনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছি।
আমরা এমন একটা অবস্থার মধ্যে পড়েছি, আন্তর্জাতিক বিভাজন, আন্তর্জাতিক শ্রমব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য এইগুলো থেকে মুক্তি পাইনি। আমাদের প্রধান সংস্কৃতি এখন ‘কোকাকোলা’ সংস্কৃতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ-সাহায্যে আমাদের দেশ চলে, পণ্যদ্রব্য চলে। আমাদের এই উৎপাদন-ব্যবস্থা একান্তভাবে পরনির্ভরশীল। এইটাই হল আমাদের সংস্কৃতির বিকার বা অপসংস্কৃতির প্রকৃত উৎস। সুতরাং যদি কেউ বলেন যে আমরা পরনির্ভরতার বিরুদ্ধে লড়াই না করেই তা দূর করবো তাহলে সেটা হবে আকাশকুসুম কল্পনার শামিল।
সংস্কৃতি মূলত মানুষের জীবনযাপন-পদ্ধতির বা বাঁচার ইতিহাস। উৎপাদন-নীতির উপর ভিত্তি করে উৎপাদন-পদ্ধতি বদলানোর সংগ্রাম না করলে সাংস্কৃতিক স্বাধিকারের ব্যাপারটা যে কিছুটা অলীক এবং দুর্বল থেকে যায় সেটা মনে রাখা দরকার। কিন্তু [তার সঙ্গে] এটাও মনে রাখা দরকার [যে] উৎপাদন-পদ্ধতির পরিবর্তনের সংগ্রামকে ব্যাপকভিত্তিক করা তখনই সম্ভব যখন বেশির ভাগ মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। ইংরেজদের [পক্ষে] আমাদের দেশ দখল করার প্রধান কারণ ছিল, আমাদের দেশের লোকেরা উৎপাদন-পদ্ধতিতে তাদের [মতো] সে সময়ের [মাপে] প্রগতি অর্জন করতে পারেনি।
এই অবস্থা বাংলাদেশে এখনও বিরাজ করছে এবং বাংলাদেশের শাসকশ্রেণির এই যে নির্বীর্যতা, সৃষ্টিহীনতা—[এই শ্রেণি যে কিছুই] তৈরি করতে পারে না—এটাই আমাদের সমাজ-ব্যবস্থার মূল সংকট। অথচ দেশে যারা শাসক-শোষক তারা নিজেদের অক্ষমতাটা ঢাকা দিতে বিদেশের উপর নির্ভর করে। গরিব লোকদের শোষণ করে। ইংলণ্ডে বা জার্মানিতে—এমনকি জাপানেও—যেভাবে আধুনিক পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার [যাত্রা] শুরু হয়েছিল সেই ব্যবস্থা এখানে নেই। সেখানে যেমন বড় বড় পুঁজিপতিরা বড় বড় কারখানার মালিক হয়ে ম্যানচেস্টারে, বার্মিংহামে বা লন্ডনে ফিনান্স মার্কেটের খেলায় সারা দুনিয়াকে হাতে নিয়ে এসেছে। সেই রকমের খেলা এখানে হয়নি।
কিন্তু এখানে আরেকটা জিনিশ ঘটেছে। এখানে প্রচুর বেকার শ্রমিক, বেকার কৃষক ভূমি থেকে উচ্ছেদ হয়েছে। সুতরাং এখানে দেখা যাচ্ছে যে একটা বিপুল পরিমাণ শ্রমিক এমনিতেই বাদ থেকে যাচ্ছে। বুর্জোয়ারা উৎপাদনে শক্তিশালী না হয়েও শোষণটা চালাতে পেরেছে শক্তিশালী বিদেশি পুঁজির সাথে আঁতাত করে। এই যে পরিস্থিতি এটা হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতির সংকটের মূলে। এখন যে সংস্কৃতির সংকটের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে—মুসলমান না বাঙ্গালি—এগুলি আদৌ অগুরুত্বপূর্ণ নয়—অনেকেই এ বিষয়ে আলোচনা করেছেন বলে আমি তা পরিহার করলাম। কিন্তু এইগুলির ভিত্তি দেখতে হবে ওইখানে—এইগুলি কেন হতে পারে? তারপরে আমরা হয়তো একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানে আসতে পারি।
এই কথা যদি আমরা মনে রাখি এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যদি আমরা কিছু কূপমণ্ডুকতা পরিহার করি তাহলে হয়তো আমাদের এই সংগ্রাম জয়ী হওয়া যাবে।