মাহবুব আজীজের একগুচ্ছ কবিতা
ভুলে থাকা
ছায়াপ্রেতের শরীর নিয়ে—ভুলে থাকা—আমার দরোজায় এসে রোজ ভোরে বসে থাকে, আমি অন্যদিকে তাকিয়ে ছায়াপ্রেতকে পাশ কাটিয়ে তরতর সিঁড়ি বেয়ে নামি; পাতালের দিকে নামতে নামতে মাঝপথে নগরের সড়ক আমাকে জাপটে ধরে, আমি কোনোরকমে থিতু হই ও তোমাদের প্রাত্যহিকতায় পৌঁছি।—নিয়মিত ঘটনা এই, গড়ানো দুপুর ক্রমম্ফুটমান হাসির মতো বিকালে গড়ায়, আর সন্ধ্যা হতেই ভুলে থাকা ছায়াপ্রেত আবার দরজার সামনে নিজের শরীর ষ্পষ্ট করতে থাকে; আমি সাততাড়াতাড়ি তাকে পাশ কাটানোর জন্যে সিঁড়ি খুঁজি; ডানাওয়ালা ঘোড়া আমাকে সিঁড়িতে পৌঁছে দেয়—অন্ধকার নামে, পরাবাস্তব অবয়ব নিয়ে রাত্রি আসে পরম উল্লাসে—ভুলে আর থাকা যায় না, আস্ত একখানা রাত তখন জীবন্ত, ঘুমোয় না, হেসে গড়িয়ে পড়ে—রাত্রির অট্টহাসিতে তালগোল পাকিয়ে সেই ছায়াপ্রেত দূরে বসে একলা কাঁদে, অশরীরী কান্না জ্যোৎস্নার সাথে চুয়ে চুয়ে পড়ে।
ঘুমের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে
মস্তিষ্কের যে অংশ স্মৃতি বা চিন্তায় মগ্ন, তার অধিকাংশ একজনের করতলে গেলে যা হয়, অচিরাৎ আমারও তাই হয়; এক মরাল গ্রীবা আমাকে অন্তহীন মুগ্ধতায় পেঁচেয়ি রাখে আনখশির—জ্বলজ্বলে সূর্যের নিচে সবুজ তারাজ্বলা শোভা আমাকে অন্ধ করে, বধির করে, চিন্তারহিত করে; উত্তর-দক্ষিণ নির্বিকার প্রদক্ষিণে আমি ঘুমিয়ে যাই অহর্নিশ, আলোর ভেতর দেখি অন্ধকার—অতল ঘুমের আশ্রয়, ঘুম দিই গভীর—আর ঘুমের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে তার দুয়ারে যাই; বন্ধ দুয়ার আমাকে ফিরিয়ে দেয়, আমি তবে ভুল দুয়ারের সামনে! আরেক দুয়ারে যাই, সেখান থেকে আরেক, অন্তহীন এই ভ্রমণ কেবল একাকী—শূন্যতার—দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে ঘুরে ঘুমের ভেতরে হাঁটতে হাঁটতে আমি অনন্ত ঘুমহীন দেশে নিজেকে দেখি; আর নিজেকে দেখে সম্ভবত চিনতে পেরে বড় উদ্বেল হয়ে আবারও হাঁটতে শুরু করি, আমার পাশেই আমি হাঁটি—হাঁটতেই থাকি।
মানুষেরা এমন করে কেন!
নিজের হৃৎপিণ্ড নেওয়া যায় হাতে, কিশোর পাঠ্যে হয়তো বা—অথচ, হে আনন্দময়ী—এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে আমার হৃৎপিণ্ড চিরে তুমি তুমুল হাস্যে মাতলে!—জ্যোৎস্নার পুতুলগুলো তখন দূর থেকে আমাদের দ্যাখে, তারা বিস্ময়ে আকাশ থেকে ঝরে পড়তে পড়তে বলে—মানুষেরা এমন করে কেন! আমিও তখন এই প্রশ্নে বিন্দুমাত্র উদ্বিগ্ন না হয়ে তোমার হৃৎপিণ্ডও এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে হো হো হাস্যে মাতাল হয়ে জ্যোৎস্নায় লুটোপুটি খাই, তোমার দুঃখিত চোখও তখন একই প্রশ্ন করে; আর দেখি আমার চোখ দিয়ে কখন অতল জল ঝরতে শুরু করে; আর একই প্রশ্নে আমিও ডুকরে কেঁদে উঠি—মানুষেরা এমন করে কেন!
সারল্য
সারল্য আর সবকিছুর চেয়ে আরাধ্য থাকে আমার, তাই সারল্য অভিমুখী যেকোনো অভিযানে নিশ্চিতে যাই বারবার, রোদ যখন অত আগ্রাসী হয় নাই, মানুষের মুখ থাকে গ্লানিহীন, বড় সরল মনে হয় তাদের, ইচ্ছে হয় খুব ভালোবাসি—বাষ্প ইঞ্জিনের মতো গলগল তাপ বেরুনো দিনে আর সবাই যখন এলোমেলো, ছন্নছাড়া—ক্রুব্ধ সব মুখ; তখন একটা মুখই মনে হয় এই পৃথিবীতে সারল্য ধরে রাখে, আমি তার পিছু নিই—গনগনে মধ্যদুপুরে জ্যোৎস্নার খোঁজে ফেরা আমি, ততক্ষণে সারল্যের আড়ালে লুকানো আততায়ীর হাতে ঝমঝম বেজে উঠি।
তোমাকে ছেড়ে যেতে যেতে
পরিচিত লতাপাতা আঁকা রিকশা, ধুলোমলিন বৃক্ষ, এবড়োথেবড়ো রাস্তা, মাংসের দোকানের দাঁত বের করা বিক্রেতা—সব যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আসলে নয়; যে যার কাজেই থাকে—আমার মনে হতে থাকে—তাকিয়ে আছে, সব তাকিয়ে আছে; মাথা নিচু ধীর পায়ে ছোট গলি ছেড়ে বড় রাস্তার দিকে এগোতে থাকি, ডান দিকে যাবার বদলে বাঁয়ে এগিয়ে যাই, কিছুদূর গিয়ে বুঝতে পারি, ভুল—ভুল রাস্তায় এসেছি; ফিরতি পথ ধরি আবার, এগোই বড় রাস্তার দিকে—বাতাসে বিদায়ের গন্ধ! আছে, আছে; বিদায়েরও গন্ধও আছে; এখন ক’টা বাজে? এখন কি সন্ধ্যা না রাত? ক’টা বাজলে রাত হয় বা ক’টা পর্যন্ত সন্ধ্যা—ঘড়ি দেখতে ইচ্ছা হয় না; আস্তে আস্তে হাঁটতে থাকি—যেন যুদ্ধক্ষেত্রে বেঁচে থাকা আমি শেষতম মানুষ—নিহত রক্তাক্ত শবদেহের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই; কে নিহত? ওইতো আমারই মৃতদেহ—তোমাকে ছেড়ে যেতে যেতে আমি আমার মৃতদেহের পাশ দিয়ে মাথা নিচু করে হেঁটে সামনের দিকে এগোই।