সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্য
ইলিশ! ইলিশ!
আজ সকালে আমি গেলাম বাজারে। ইলিশের সন্ধানে। বুদ্ধদেব বসু কবিতা লিখেছেন, ‘জলের উজ্জ্বল শস্য’ ইলিশ মাছ নিয়ে। বাংলা সাহিত্যে ইলিশের ছড়াছড়ি। সৈয়দ মুজতবা আলী বর্ণিত সেই গল্পটি নিশ্চয়ই অনেকেই জানেন। তবু সংক্ষেপে আবার বললে ক্ষতি নেই। এটি বিখ্যাত সম্রাট মুহম্মদ-বিন তুঘলক সম্পর্কে। ইতিহাসে যাঁকে পাগলা রাজাও বলা হয়। সেই তুঘলক গেছেন গুজরাটে বিদ্রোহীদের দমন করার উদ্দেশ্য নিয়ে। এমনকি জলাভূমিতে নৌকায় চেপে তাদের তাড়া করতেও সম্রাটের খুব উৎসাহ। তারই মধ্যে এক বিকেলে হঠাৎ একটা মাছ লাফিয়ে উঠে পড়ল নৌকার ওপর। ঝকঝকে সাদা রং, তার গড়নটিও চমৎকার। মাছটি দেখে সম্রাট খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়লেন। এটা কী মাছ, কেউ জানে না। তুঘলক বললেন, এটাকে এক্ষুনি কেটেকুটে রান্না করে দাও। আমি খেয়ে দেখব। তা শুনে তাঁর মন্ত্রী ও পরিষদরা আঁতকে উঠলেন। তাঁরা সম্রাটকে অনেক করে বোঝাবার চেষ্টা করলেন যে, এই মাছ বিষাক্ত কি-না তা তাঁর জানা নেই, তা ছাড়া এখন রোজার মাস চলছে, সুতরাং এখন এই মাছ সম্রাটের মুখে ছোঁয়ানোই উচিত নয়। জেদি সম্রাট কারো উপদেশ গ্রাহ্য করলেন না। তাঁর আদেশে তিনি সেই মাছ রান্না করালেন এবং খেলেন। খুব সম্ভবত অনেকটাই খেয়ে ফেললেন। তারপর তাঁর পেট ছেড়ে দিল এবং সেই কারণেই কি না কে জানে, কয়েক দিনের মধ্যেই মৃত্যু হলো তাঁর। এরপর মুজতবা আলীর মন্তব্য এই-সেই অচেনা মাছটি ইলিশই ছিল এবং ইলিশ খেয়ে যখন সম্রাটের মৃত্যু হয়েছে, তখন নিশ্চিত তিনি বেহেশতে গেছেন।
এই কাহিনীর ঐতিহাসিকতা নিয়ে আমায় কেউ প্রশ্ন করবেন না, প্লিজ। তবে গুজরাটে ইলিশ পাওয়া যায় ঠিকই। তার নাম পাল্লা। পৃথিবীর বহু দেশেই ইলিশ পাওয়া যায় বিভিন্ন নামে। ইলিশ সমুদ্রের মাছ। একসময় নদীতে নদীতে ঝাঁক বেঁধে ঢোকে ডিম পাড়ার জন্য। স্যামন মাছেরও এই স্বভাব। তবু বাঙালিদের ধারণা, বাংলার নদীর ইলিশ রূপে, গুণে, স্বাদে, গন্ধে শ্রেষ্ঠ। আমেরিকার ইলিশের নাম শ্যাড।
রবীন্দ্রনাথের জন্মের দেড়শ’ বছর উপলক্ষে কত রকম নতুন নতুন গবেষণাপত্র বেরোচ্ছে। ‘রবীন্দ্রনাথ ও মাছ’ এই বিষয়ে কেউ কিছু প্রকাশ করেছেন কি না, তা আমার চোখে পড়েনি। রবীন্দ্রনাথের ইলিশপ্রীতি সম্পর্কে কোনো তথ্য আমার জানা নেই। তবে পদ্মার ওপর বোটে অনেক দিন চেপেছেন, মাঝেমধ্যে কি ইলিশ চেখে দেখেননি?
স্বামী বিবেকানন্দর ইলিশপ্রীতি বিশ্ববিখ্যাত। স্বামীজির বুকের ওপর আড়াআড়ি রাখা দুহাত ও বীরত্বব্যঞ্জক চেহারা বহু পরিচিত হলেও তাঁর স্বাস্থ্য কিন্তু তেমন ভালো ছিল না। শেষের কয়েক বছর নানা রকম ব্যাধিতে ভুগেছেন। তিনি ছিলেন ভোজনরসিক। অনেক সময় চিকিৎসকদের নিষেধাজ্ঞা গ্রাহ্য করতেন না। একবার পূর্ববঙ্গে গিয়ে স্টিমারে ঘুরতে ঘুরতে ইলিশ মাছ ধরা দেখে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। চোখের সামনে এত টাটকা ইলিশ! তিনি তাঁর সঙ্গী কানাইকে তক্ষুনি আদেশ দিলেন, গোটাকতক ইলিশ কিনে ফেলতে। ওঁদের দলে রয়েছেন মোট সাতজন। তাই কানাই তিনটি বা চারটি বেশ বড় ইলিশ কিনতে চাইলে স্বামীজি তাঁকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, আমরা কজন মিলে খাব আর স্টিমারের খালাসি-মাঝিমল্লারা চেয়ে দেখবে?
কিনে ফেলা হলো ষোলোটি ইলিশ। কত দামে? এক একটি চার পয়সা, তাই মোট এক টাকা! এটা গাল-গল্প নয়, বিবেকানন্দের প্রামাণ্য জীবনীতে এই দামের উল্লেখ আছে।
আর একদিন, তখন স্বামীজির শরীর বেশ খারাপ। একটা যাই যাই রব উঠে গেছে। প্রায়ই তিনি বলেন, তাঁকে শিগগিরই চলে যেতে হবে। তিনি চল্লিশ বছরের বেশি বাঁচবেন না। একদিন তিনি উপোস করেছেন। পরদিন পরমহংসদেবের ঘরে বসে ধ্যান করলেন প্রায় তিন ঘণ্টা। তারপরই তাঁর খুব খিদে পেয়ে গেল। তিনি ঠিক করলেন, আজ তিনি ভাত, মাছ, তরকারি সব খাবেন। পুরোপুরি ঝাল ও মসলা দিয়ে। তখন গঙ্গায় ইলিশ মাছ ধরা হলো, প্রেমানন্দ স্বামী সেই মাছ কিনছেন খবর পেয়ে বিবেকানন্দ সেখানে উপস্থিত হয়ে কিনলেন সেই টাটকা ইলিশ। সেদিন বেলুড় মঠে লোকজন বেশি নেই। তাই তিনি প্রেমানন্দকে বললেন, শুধু ঝোল নয়, গোটাকতক মাছ ভাজা করতে বলো, ভাজা ইলিশের স্বাদই অপূর্ব। আর একটু মাছের টক করতেও বলে দিও।
সেদিন তিনি খেলেন ইলিশ মাছের তেল দিয়ে ভাত, ডাল দিয়ে ভাজা মাছ, ঝোলে তেমন ঝাল হয়নি বলে কাঁচালঙ্কা ডলে নিলেন। শেষ পাতে মাছের অম্বল। সেসব খেয়ে তাঁর শরীরে এমনই শক্তি এলো যে, লাইব্রেরি ঘরে এসে কয়েকটি ছাত্রকে পড়াতে লাগলেন পানির ব্যাকরণের মতো নিরস ও শক্ত বিষয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। অনেক দিন পর হাঁটতেও বেরোলেন। অনেক ব্যাপারেই তাঁর প্রবল উৎসাহ। অনেক গল্প করলেন অন্যদের সঙ্গে।
সেই রাত্রেই তাঁর মৃত্যু হলো।
কোনো মৃত্যুর সঙ্গে ইলিশ ভক্ষণের নিশ্চয়ই কোনো সম্পর্ক নেই। আসল কথা হচ্ছে, খুব ভালো জিনিস একসঙ্গে বেশি আহার করতে নেই। বাঙালদের অভ্যাস আছে। তারা তবু অনেকটা খেয়ে নিতে পারে। বিবেকানন্দ বাঙাল ছিলেন না। তাই সহ্য করতে পারেননি। আবার ভক্তদের মতে, তিনি পুণ্যাত্মা মানুষ। ওই রাতেই তাঁর চলে যাওয়ার কথা ছিল, যাওয়ার আগে বেশ তৃপ্তি করে ইলিশের সব রকম স্বাদ নিয়ে গেলেন।
ইলিশ বিষয়ে আমার আরো অনেক কিছুই লেখার আছে, কিন্তু আজকাল অনেকেই আর পুরোনো কথা শুনতে চায় না। আমি অনেক দিন বাজারে যাইনি, এ বছর শুনছি ইলিশের দাম নাকি ছয়শ, সাতশ টাকা। অবিশ্বাস্য মনে হয়। নিজের চোখে ব্যাপারটা দেখতে গেলাম।
এত দিন পরে বাজারে গেলেও তরকারিওয়ালি, ডিমওয়ালি, আলু-পেঁয়াজের দোকানদার অনেকেই আমাকে চিনতে পেরে, উঠে এসে আপনজনের মতো জিজ্ঞেস করে, দাদা, অনেক দিন দেখিনি তোমায়, শরীর ভালো আছে তো? আজকাল আত্মীয়স্বজনের সঙ্গেই বিশেষ দেখা হয় না। এঁদের গলায় সেই আত্মীয়তার স্পর্শ পেয়ে মনটা নরম হয়ে যায়।
মাছের বাজারে যাওয়ার আগে, তরি-তরকারির বাজার দেখে চমকে উঠি। এতো বৃষ্টি ও বন্যার কারণে নিশ্চয়ই অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। সাধারণ তরকারিরই আগুন দাম। গরিব মানুষরা মাছ-মাংস বেশি দাম দিয়ে কিনতে পারে না। এখন খাবেও না। কিন্তু তরকারি না পেলে কী খেয়ে বাঁচবে? বেগুন ষাট টাকা, কচুর শাক কুড়ি টাকা।
মাছের বাজারেও জমজমাট ভাবটা নেই। সাপ্লাই কম। অনেক দোকান খালি। ইলিশ আছে বটে, সবই বাংলাদেশের। এককালে ডায়মন্ড হারবার, কোলাঘাট, বাগবাজার ঘাটের ইলিশের খুব সুনাম ছিল। সেসব নাম আর কেউ করে না। এখন পুরোপুরি বাংলাদেশের ওপর নির্ভরতা। এই বাজারে যেসব ইলিশ রয়েছে, তা ছোট ছোট, বরফ দেওয়া, অনেকটা স্থূল পথ পার হয়ে তারা এসেছে। বরফ তো দিতেই হবে।
আসল ইলিশের স্বাদ দেড় কিলো থেকে পৌনে দুই কিলোতে। আমরা বাল্যকাল থেকে ইলিশের সমঝদার। আমার মতন এমন মানুষ খুব কমই আছে, যে জ্যান্ত ইলিশকে লাফাতে দেখেছে। ছোট ইলিশ কখনো খেতাম না, আর বরফের ইলিশ তো ছুঁয়ে দেখারও প্রশ্ন ছিল না। কার্যকারণবশত এ বছর একদিনও ইলিশ খাইনি। একটুক্ষণ দোলাচলে রইলাম, দুধের স্বাদ যেমন ঘোলে মেটে না, তেমনই খাঁটি ইলিশের স্বাদের সঙ্গে অন্য কিছুর সমঝোতা চলে না; বরং না খাওয়াই ভালো। আমি চলে যাওয়ার জন্যে উদ্যত হলে আমার পরিচিত মাছওয়ালাটি বলল, দাঁড়ান স্যার, আপনার জন্য আমি কাঁচা মাছ এনে দিচ্ছি।
কাঁচা মাছ কাকে বলে তা আমি জানি। বরফ ছাড়া। টাটকা। কোনো কারণে এই মাছ এরা আড়ালে লুকিয়ে রাখে।
সে যে দু-তিনটে মাছ নিয়ে এলো, তাদেরও ওজন একেকটি এক কিলো একশ মাত্র। তবে গড়ন ও গায়ের রং দেখে বোঝা যায়, ভালো জাতের। কাঁচা মাছের দাম বেশি। সাতশ টাকা কিলো। শুনে পিলে চমকে যাওয়ার কথাটা অনেক দিন পর মনে পড়ল।
ফেরার পথে আমার কিন্তু বেশি মন খারাপ হলো। বেগুনের দাম ষাট টাকা শুনে। তবু মানুষ বেঁচে আছে। মানুষ বেঁচে থাকবে।
একটি বিস্মৃত কাহিনী অনেক কাল আগে, স্বাধীনতা ও দেশ বিভাগের আগে, এক কলকাতার বাবু গিয়েছিলেন পূর্ববঙ্গে বেড়াতে। একটি গ্রাম্য কিশোরের সঙ্গে ভাব জমাবার উদ্দেশ্যে তিনি জিজ্ঞেস করলেন খোকা, আজ কী দিয়ে ভাত খেলি রে দুপুরে?
ছেলেটি বলল, কলমি শাক আর দুইখান মাছ ভাজা দিয়া দুগ্গা (কিছু) ভাত খাইলাম। তারপর মাছের ঝোল দিয়া ভাত খাইলাম। তারপর পুঁটিমাছ আর তেঁতুলের চুকা (টক) অম্বল।
ভদ্রলোক অবাক হয়ে বললেন, সে কী রে, তোরা ডাল খাসনি?
ছেলেটি ততোধিক অবাক হয়ে বলল, কত্তা, আমরা কি বড়লোক যে ডাইল খাব?