শাকুর মজিদের গদ্য
ইলিশের বৈশাখ, বৈশাখের ‘সন’
আমাদের ছোটবেলার সবচেয়ে অপছন্দের মাছ ছিল ইলিশ। আমার দাদা সপ্তাহে দুবার বাজারে যেতেন। সোম ও শুক্রবার। তার বাজেট থাকত বিশ টাকার মতো। সাত-আট টাকায় কেবল ইলিশ মাছই পাওয়া যেত। সে কারণে প্রতিদিনই শেষ আইটেম হিসেবে একটা সস্তার ইলিশ তিনি নিয়ে আসতেন। চল্লিশ বছর আগের সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই, যেটুকু আছে, তাতে মনে হয় এখনকার ৭-৮০০ গ্রামের একেকটা ইলিশ মিলত সতা-আট টাকায়। দাদা কাপড়ের ঝোলা ক্যারি করত—ওটা ভারি। ওর ভেতর আলু, মুকি, পান, তামাক, চিনি, চা-পাতা, বিস্কুট এসব। আমি আস্ত ইলিশটা বয়ে আনতাম। ইলিশের মুখের ভেতর বেত আটকানো। যেতে যেতে যেসব লোকের সঙ্গে দেখা হতো, তারা দাম জানতে চাইত। সব সময় আমার দাম জানা থাকত না। দাদার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করে দাম জেনে বলতাম। এর উত্তরে সবাই বলত, ইলিশের দাম দেখি বাড়ি গেল।
সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে থাকা হতো কেবল বাজারের দিন। মাগরিবের নামাজ শেষ করে দাদা বাড়ি আসতেন। তারপর মাইল দুই পথ হেঁটে হেঁটে বাড়ির কাছে আসতেই ডানে-বাঁয়ে অনেক বাড়ির রান্না ঘরের পাশ দিয়ে যেতে হতো। সেখানেও প্রথমে শব্দ পেতাম, পরে গন্ধ। কার উনুনে কড়াইয়ের ওপর তেল ঢালা হয়েছে আর তার ওপর ইলিশ পড়ে ছ্যাৎ করে শব্দ করে উঠল, শোনা যেত। আর ঘরের উঠান মাড়িয়ে পাশের সরু রাস্তা বরাবর তার ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়ত টের পেতাম। বুঝতাম, ও বাড়ির কপালেও শুধুই ইলিশ।
আমাদের অঞ্চলে (সিলেটের বিয়ানীবাজার) সস্তায় ইলিশ পাওয়ার একটা কারণ ছিল। ভারতের করিমগঞ্জের বোর্ডার আমাদের এলাকাসংলগ্ন। চাঁদপুর থেকে এই রুটে রাতের অন্ধকারে ইলিশ পাচার হতো ভারতে। বর্ডার ‘গরম’ থাকলে ‘বুঙ্গা’র এই মালগুলো বাজারে বিক্রি করে ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। সে কারণে প্রায় প্রতি বাজারেই ইলিশের আমদানি ছিল প্রচুর। আমরাও সপ্তাহে দুইটা করে ইলিশ খেতে খেতে ইলিশের প্রতি প্রায় বিতৃষ্ণা জন্মে যেত। ইলিশ ছাড়া অন্য মাছ বেশি প্রিয় ছিল। কিন্তু উপায় ছিল না। সারা বছর ইলিশে নির্ভর ছিলাম, যেহেতু এর দাম কম। আর এক সময় টের পেলাম যে, এই একটি মাত্র মাছ নানাভাবে, নানা রকমের তরকারি দিয়ে রান্না করা যায় এবং প্রতিটারই ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ। আমার সবচেয়ে প্রিয় ছিল মুখি দিয়ে ইলিশ। দুইটাই পিছলা পিছলা। আমার কাছে বড়োই সুস্বাদের। ইলিশের ডিম ভাজা কিংবা আমের বোল দিয়ে পাতলা ঝোলের তরকারিও ছিল প্রিয়। ভাজা ইলিশ দু-তিন টুকরা করা হতো বড়দের জন্য, কদাচিত তার ভাগ আমরা পেতাম। ইলিশের মাথা দেওয়া হতো বাবাকে। বাবা বছরের বেশিরভাগ সময় জাহাজে থাকতেন, তখন মাথা পেয়ে যেতাম আমি। এই ছিল আমার শৈশবের ইলিশ বিলাসিতা।
ইলিশ যে এমন মহার্ঘ টের পেলাম তার এক যুগ পর ঢাকা এসে। এখানে ইলিশের অনেক রেসিপির কথা শুনি। ইলিশ দোপেঁয়াজা, শর্ষে ইলিশ, আরো কত কী! আরো শুনি, পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে নাকি এটা বাংলাদেশের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত খাবার। তখনকার মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে নাকি প্লেনে করে ইলিশ পাঠাতেন সামরিক শাসক এরশাদ।
এই ইলিশ পয়লা বৈশাখের একটা আইটেম হয়ে দাঁড়ায় রমনার বটমূলে, এবং এটা আমি টের পাই এখানে আমার প্রথম উপস্থিতি, সেই ১৯৮৭ সালেই। খবর নিয়ে জানি যে ১৯৮৩ সালে কয়েকজন রমনার বটমূলে এক ডেকচিতে কিছু পান্তাভাত আর কড়াইতে ইলিশ ভাজা নিয়ে বসেছিলেন। প্লেটে প্লেটে করে তারা বিক্রিও করেছিলেন। এই ঘটনার দাবিদার দুজন। একজন দৈনিক জনকণ্ঠের সাংবাদিক বোরহান আহমেদ, অন্যজন সাংবাদিক শহিদুল হক খান। এঁদের সঙ্গে অবশ্য আরো কয়েকজন ছিলেন। নিতান্ত কৌতূহলী হয়েই তাঁরা এটা প্রথম করেছিলেন। কিন্তু পরের বছর দেখা যায়, মুড়ি-মুড়কির সঙ্গে সকালের নাশতা হিসেবে এটার বাজার ভালো যাচ্ছে। খুব ভোরে যারা রমনার বটমূলে গান শুনতে আসেন, তারা সকাল বেলা ক্ষুধার্ত হয়ে পড়লে এই আইটেমটা বাজার পেয়ে যায়। ১৯৯১ সালে, এরশাদের পতনের পরের বছর মহা জমজমাট বৈশাখী উৎসব হয় রমনায়। দেখি মাছের বাজারের মতো পান্তা-ইলিশের হাট বসেছে সেখানে। শৌখিন রাঁধুনিরা নিজেই দোকান দিয়ে বসেছেন। আমাদের হলের এক বড় ভাই আমাকে প্রায় জোর করে নিয়ে যান তাঁর স্টলে। ভাবীর পান্তা-ইলিশের দোকানে বসিয়ে আমাকে মাটির শানকির ওপর কিছু ভেজানো ভাত আর এক টুকরা ইলিশ, সঙ্গে পেঁয়াজ-কাঁচামরিচ দিয়ে সাজিয়ে দেন। আমি অনেক কষ্টে দু-তিন লোকমা খেলাম। পান্তাভাত আমি কখনো খাইনি। আমার গলায় আটকে যায়। খাওয়া শেষ করে বিল দিতে চাই। দেখি দাম লেখা, ইলিশপ্রতি পিস ২৫ টাকা, পান্তা ৫ টাকা। আমি হলে ছয় টাকায় ফুলকোর্স ডিনার খাই। এখানে ৩০ টাকা দিতে হবে? তা-ও বড় ভাই বলে কথা। বড় মুখ করে নিয়ে এসেছেন। আমি মানিব্যাগে হাত দিই।
বড় ভাই নিতান্ত ভদ্রতা করে বললেন, আরে না, না, লাগবে না।
আমি আবার হাত বের করে ফেলি। আমার ৩০ টাকা রক্ষা পেল।
এসব কাহিনীর দুই দশক পর দেখি ইলিশ নিয়ে এলাহি কাণ্ড! বৈশাখের সঙ্গে ইলিশ এসে জড়িয়ে যায়। টেলিভিশনের রান্নার অনুষ্ঠান, দৈনিক-সাপ্তাহিক-পাক্ষিকের রাঁধুনির পাতা, সর্বত্র বৈশাখের খাবার হিসাবে আমাদের ‘এক্সপার্ট’ রন্ধনবিদরা ইলিশ-পান্তাকে প্রায় জোর করে বৈশাখের খাবার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতে থাকেন এবং মিডিয়ার সৃষ্ট এই উপাচার আমাদের একশ্রেণির নাগরিকের সংস্কৃতি হয়ে যায়। সংকট দেখা দেয়, যখন এই কারণে ইলিশের চাহিদা বেড়ে যায় এবং তখন আগে থেকে স্টক করে রাখা বড় ইলিশ ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি দামে এটা বিক্রির চেষ্টা করে। এবং তখনই আরেক শ্রেণির নাগরিক এই ইলিশকে বর্জনের কথা বলে।
ইলিশ কি বৈশাখের খাবার?
আমার ছোটবেলা কেটেছে গ্রামে। হিন্দু-মুসলমান মিলে আমাদের এলাকা। আমাদের সকল উৎসবই ছিল ধর্মকে কেন্দ্র করে। আমারা, মুসলমানেরা ঈদ আর শবেবরাতে উৎসব করতাম। এর বাইরে বিয়েশাদি ছিল। আর হিন্দুদের আয়োজনে উৎসব ছিল সংক্রান্তি, বান্নি, রথ, এসব। কিন্তু সেসব উৎসবে আমাদের যাওয়া ছিল অবশ্যম্ভাবী। কয়েক মাস আগে থেকে পয়সা জমাতাম বান্নি যাওয়ার জন্য। আমার একটা বাঁশের ব্যাংক ছিল। এর মধ্যে ফুটো করে রাখতাম। দুই পয়সা, পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, সিকি, আধুলি পেলেই এর ভেতর ঢুকিয়ে রাখতাম। বান্নির দিন সকালবেলা ব্যাংক কাটা হতো। ছয়-সাত টাকা পেয়ে যেতাম। তারপর তিন-চার মাইল দূরের হিন্দু গ্রামের পাশে বসা বান্নি থেকে গুড্ডি, নাটাই, মোয়া, তিলুয়া, খই এসব কিনে আনতাম। অনেকগুলো ঘুড়ি কেনা হতো। সঙ্গে সুতো ও নাটাই। পুরা তিন-চার মেইল মেঠোপথ ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে বাড়ি এসে পড়তাম। সবাইকে তিলুয়া, খই খাওয়াতাম। এসব নিয়ে মহা উৎসব বসতবাড়ির উঠানে সন্ধ্যাবেলা।
বৈশাখে আমাদের কোনো আলাদা খাবার ছিল না। আমার তিন পুরুষ আগে হয়তো সবাই চাষা ছিলেন, কিন্তু আমার দুই পুরুষ আগে থেকে সবাই চাকরিজীবী। বর্গাওলারা ধান দিয়ে যেত, সে কারণে গ্রামে থাকলেও চাষবাসের জীবন আমার দেখা হয়নি। কৃষকেরা আমার বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেন ফজরের সঙ্গে সঙ্গে। তাদের সঙ্গে লুঙ্গি দিয়ে প্যাঁচানো একটা থালা থাকত, সঙ্গে পানির মগ। আমাদের অঞ্চলে পান্তাভাতের খুব চল ছিল না। ওখানে হয়তো অন্য কিছুও ছিল। ‘বিরান ভাত’ এখন যেটাকে আমরা ‘ফ্রায়েড রাইস’ বলি—এ রকমের খাবারের ব্যবহার ছিল বেশি।
পয়লা বৈশাখকে আমরা বলতাম ‘সন’। এই ‘সন’ খাওয়ার জন্য পয়লা বৈশাখে আমার দাদার সঙ্গে বেরোতাম, কারণ অন্তত দুইটা দোকানে রসগোল্লা খাওয়ানো হতো, যারা দাদার কাছে টাকা পেত। আমাদের ঈদগাহ বাজারে দুটো দোকান থেকে সারা বছর বাকিতে ‘খরচ’ নেওয়া হতো। বাবা বাড়ি এলে দোকানদার টাকা পেত। আমার সুবিধা অনেক ছিল, যেকোনো কিছু আমি দোকান থেকে নিয়ে নিতে পারতাম, আমাকে টাকা দিতে হতো না। সবুর চাচা খাতায় লিখতেন। সেই খাতা বছর বছর বদলাত। লাল রঙের কাপড় দিয়ে বাঁধাই করা খাতা, প্রস্থে চার-পাঁচ ইঞ্চি, লম্বায় ১২ ইঞ্চির মতো। এটাকে বলা হতো ‘হালখাতা’। এই খাতায় আগের বছরের হিসাব ক্লিয়ার করে দেওয়ার কথা। কিন্তু আমাদের হিসাব পুরা ক্লিয়ার হতো না। দাদা কিছু দিতেন, বাকিটা ‘ইজা’ লিখে নতুন খাতায় সংখ্যা বসত। আমার দাদা যখন এই লেনদেন নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন, তখন আমাকে বসিয়ে দেওয়া হতো লাল পর্দা দিয়ে আলগা করে রাখা দোকানের আরেক পাশে, যেখানে একটা ছোট টেবিল আর কয়েকটা টুল রাখা। আমার বসার পর এক কর্মচারী আমার জন্য একটা ছোট প্লেটে জিলাপি, নিমকি, খাজা আর রসগোল্লা নিয়ে আসত।
সবুর চাচাকে মাঝেমধ্যে বলতে শুনতাম, ভাতিজারে আরোখটা রসগোল্লা দাও। কর্মচারী আমার জন্য আরেকটা রসগোল্লা নিয়ে আসত। আর আমি প্রতিবছর সবুর চাচার ‘সন’ খাওয়ার জন্য ব্যাকুল থাকতাম।
আমার সেই ‘সন’ খাওয়া উৎসব এখন বৈশাখী উৎসব, বৈশাখী মেলা। আমরা এখন কত কিছু করি!
কপাল আমাদের ৩৬৫ দিনের মধ্যে আমরা কমপক্ষে দুবার ভাবি আর ভান করি যে, আগামী বছরটা যেন ভালো যায়। যার কাছে বলি, তিনিও কি বিভ্রান্ত হন না আমার এই চাওয়া দেখে?