জেমস জয়েসের কবিতা
ভূমিকা
কখনো বা একটা পরিচয়ের আড়ালে হারিয়ে যায় আরেকটা পরিচয়। এই যে জেমস জয়েসকে আমরা একনামে চিনি বিশ্বের সেরা একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে, অথচ তিনি যে কবি ছিলেন সেটা কতটুকুই বা জানি। একাধিক কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে তাঁর জীবিতকালেই। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘দ্য হলি অফিস’ (১৯০৪) আদতে একটা রম্য রণসঙ্গীত, যা কবিতাই বলা যায়। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ চেম্বার মিউজিক (১৯০৭) ৩৬টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। মার্কিন কবি এজরা পাউন্ডের বিখ্যাত ‘ইমাজিস্ট এন্থোলজি’তে অন্তর্ভুক্ত হয় জেমস জয়েসের কবিতা। বিশ শতকে ইংল্যান্ড ও আমেরিকাতে মূলত রোমান্টিক ও ভিক্টোরিয়ান কবিতার বিরুদ্ধে শুরু হয় ইমাজিস্ট বা চিত্রকল্প আন্দোলন। তারা মূলত সরলতা, স্বচ্ছতার পথ ধরে একটা চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করে যান কবিতার মাধ্যমে। জেমস জয়েসের ‘চেম্বার মিউজিক’ সিরিজের কবিতায় এই সরল, স্বচ্ছ, চিত্রময় রূপ দেখা যায়। বলা দরকার, এজরা পাউন্ড তো বটেই, ইয়েটসও এই কবিতাগুলো পছন্দ করেছিলেন। ১৯০৯ সালে স্ত্রীকে লেখা এক চিঠিতে জয়েস তাঁর চেম্বার মিউজিক সম্পর্কে উল্লেখ করেন, ‘যখন ওগুলো লিখেছিলাম, আমি ছিলাম এক নিঃসঙ্গ বালক, রাত্রে একা একা হাঁটতাম আর ভাবতাম যে একদিন কোনো এক মেয়ে আমাকে ভালোবাসবে।’ বলা দরকার, চেম্বার মিউজিকের সব কবিতাই প্রেমের কবিতা। যদিও জেমস জয়েসের ভাষ্যমতে এগুলো একেবারেই প্রেমের কবিতা নয়, বরং এক তরুণের কথা এবং এর বেশির ভাগই গান হওয়ার উপযুক্ত। জয়েসের কথা প্রমাণ করতেই যেন ‘চেম্বার মিউজিকের’ বহু কবিতাই পরে সুরারোপিত হয়েছে একাধিক শিল্পীর দ্বারা।
‘পোয়েমস পেনিইচ’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। ততদিনে জয়েস একজন বিশ্বখ্যাত লেখক। মাত্র ১৩টি কবিতা দিয়ে সাজানো হয়েছে এই বই। কবিতাগুলো ১৯০৪ থেকে ১৯২৪ সাল নাদাগ রচিত। ২০ বছরে ১৩টি কবিতা। বইটির মূল্য ধরা হয় এক শিলং (বারো পেনি বা ফ্রাঁ)। পয়েমস বানানটি লেখা হয় pommes (poems নয়), যার ফরাসী অর্থ আপেল। আদতে আয়ারল্যান্ডে এক টাকায় ১২টি আপেল কিনলে সাথে একটি ফ্রি দেয়ার রেওয়াজ ছিলো। সে হিসাবেই ১২টি কবিতার সাথে একটি ফ্রি দিয়ে ‘পোয়েমস পেনিইচ’ প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য এগুলোও প্রেমের কবিতা। ছোট্ট এই বইয়ের কবিতাগুলোতে ‘ভালোবাসা’ শব্দটি ১৩ বার আর হৃদয় শব্দটি বহুবার ব্যবহৃত হয়েছে। কবিতায় জেমস জয়েস অনেক সরল, চিত্রময়। পরবর্তীকালে জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসে যে জটিল নির্মাণ আর দূর্বোধ্যতা রয়েছে জয়েসের কবিতায় তা নেই।
জানালার বাইরে হেলান
জানালার বাইরে হেলান দিয়ে,
স্বর্ণ কেশী,
আমি শুনতে পাই তুমি গাইছ
আমুদে বাতাসে বেশ।
আমি আমার বই ছেড়ে এসেছি
এসেছি আমার ঘর ছেড়ে
কারণ শুনেছি তোমাকে গাইতে
এই বিষাদ প্রহরে।
গাইছ আর গাইছ
আমুদে বাতাসে বেশ
জানালার বাইরে হেলান দিয়ে
স্বর্ণ কেশী।
সারাদিন ধরে বৃষ্টি পড়েছিল
সারাদিন বৃষ্টি ঝরেছিল।
আহা, এসো ভারাক্রান্ত গাছেদের মাঝে:
পাতারা রয়ে যায় ঘন হয়ে
স্মৃতির সড়কের পর।
একটু থেকে স্মৃতির সড়কের ধারে
আমরা কি বিচ্ছিন্ন হবো।
এসো, প্রিয়তম আমার, যেখানে আমি হয়তো
তোমার হৃদয়ের সাথে কথা কব।
দিনভর আমি শুনি জলের কোলাহল
দিনভর আমি শুনি জলের কোলাহল
বিলাপ করছে
বিষণ্ণ সমুদ্র পাখিটির মতো যখন যাচ্ছে
সামনে একা।
সে শোনে বাতাসের কান্না জলের
একঘেয়ে সুরে
ধুসর বাতাস, শীতল বাতাস বইতে থাকে
যেখানে আমি যাই।
আমি শুনি বহু জলের কোলাহল
অনেক নিচে।
দিনভর, রাতভর, আমি শুনি তারা বয়ে যায়
এদিকে সেদিকে।
একা
দুপুরের ধূসর সোনালি জাল
রাত্রিভর একটি অবগুণ্ঠন দেয় টানি,
ঘুমন্ত হ্রদের সৈকতবাতি
লাবার্নাম বৃক্ষ আকড়ে লতাদের পথানুগামি।
চতুর উলুখাগড়া রাত্রিরে ফিসফিসরত
একটি নামে— তার নাম—
আর আমার পুরো আত্মাই পুলোকিত
সম্বিত হারায় লজ্জায়।
ঘুঘু আমার, সুন্দর আমার
ঘুঘু আমার, সুন্দর আমার,
জাগো, জাগো!
নিশার-শিশির শুয়ে আছে
আমার ওষ্ঠে ও চোখে।
সুগন্ধী হাওয়া বুনে যাচ্ছে
এক দীর্ঘশ্বাসের সুর :
জাগো, জাগো,
ঘুঘু আমার, সুন্দর আমার!
আমি অপেক্ষারত সিডার গাছের পাশে,
বোন আমার, ভালোবাসা আমার,
ঘুঘুর সাদা বক্ষ,
আমার বক্ষ হোক তোমার শয্যা।
পাণ্ডুর শিশির শুয়ে আছে
আমার মাথায় একটি আবরণের মতো।
সুন্দর আমার, সুন্দর ঘুঘু আমার,
জাগো, জাগো!
আমার কন্যাকে দেওয়া একটি ফুল
ক্ষণস্থায়ী সাদা গোলাপ আর ক্ষণস্থায়ী হলো
তার হাত যা দেয়
তার আত্মা যা শুষ্ক ও বিবর্ণ
সময়ের নিস্তেজ তরঙ্গের চেয়েও।
ক্ষণস্থায়ী গোলাপ এবং সুন্দর— তবু ক্ষণস্থায়ীতর তারা
এক আশ্চর্য বন্য
তোমার নরম চোখের অবগুণ্ঠনের চেয়েও
আমার নীলশিরা কন্যা।
কেন না তোমার কণ্ঠ আমার পাশে ছিল
কেননা তোমার কণ্ঠ আমার পাশে ছিল
আমি ওকে ব্যথা দিয়েছিলাম,
কেন না আমার হাতে ধরা ছিল
আবারও তোমার হাত।
ছিল না কোনো শব্দ কিংবা কোনো ইঙ্গিতমার
সংশোধন করার মতো...
ও এখন আমার কাছে অচেনা
যে ছিল বন্ধু আমার।