আমাদের নেক্সট জেনারেশনের ঈদ
আমাদের পরের জেনারেশনও আর ছোট নেই। তারাও দিব্যি বড় হয়ে গেছে। বেশির ভাগই পিএচইডি করে ফেলেছে বা করছে। আমি বলি পিএইচডি জেনারেশন। বেশির ভাগই বিদেশে। এমন না যে আমরা ঠেলে ঠুলে তাদের বিদেশে পাঠিয়েছি। তারা নিজেরা নিজেরাই দিব্যি পড়াশুনা করতে এখন বিদেশে। আমার নিজের মেয়েটার কথাই বলি। একদিন সে এসে গম্ভীর মুখে জানালো ‘ বাবা আমি এমএস করতে সাউথ ক্যারোলিনা যাচ্ছি। ক্লেমসন ইউনিভার্সিটি আমাকে স্কলারশিপ দিয়েছে।’ আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ‘তুমি একাই যাবে?’
বিদেশে পড়তে কেউ আবার দোকা যায় নাকি?
তারপর সত্যি সত্যি সে একদিন চলে গেল। আট মাস পর এবার এলো ঈদ করতে। আমি আশ্চর্য হয়ে ভাবি আমার নিজের ছোট্ট মেয়েটা যাকে রাতে সাদা ভূত আর কালো ভূতের গল্প বানিয়ে বানিয়ে না বললে ঘুম হতো না। ভূতের ভয়ে একা একা ঘুমাতে পারত না, একদিকে বাবা একদিকে মাকে নিয়ে ঘুমাতে হতো, সে এখন একা একাই কই সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে দিব্যি ছুটে আসছে মা-বাবার সঙ্গে ঈদ করতে!
আমি নিজে যে দু একবার ইউরোপে গিয়েছি তাতেই আমার খবর হয়ে গেছে বিদেশি এয়ারপোর্টের নিয়ম কানুন মেনে নিজের প্লেন খুঁজে বের করে চেক ইন, চেক আউট, বোডিং কার্ড এসব হাবিজাবি পেরিয়ে অবশেষে নিজের সিট নিয়ে বসা সত্যিই দুরূহ কর্ম। সেই সবই আমার মেয়ে দিব্যি একা একা করছে।
কিংবা আমার এক ভাগ্নি হঠাৎ করে শুনি তার মাকে দেখতে এসেছে মাত্র পাঁচ দিনের জন্য সুদূর জার্মান থেকে। ঈদ করেই পরের দিন চলে যাবে। সেও দিব্যি একাই ছোটাছুটি করছে! এটাই বোধহয় নিয়ম, একটা সময় একাই ছোটাছুটি করতে হয়। আমি নিজে একা কখনো কোথাও যেতে পারি না। মনে আছে জীবনের প্রথম যখন কক্সবাজার গিয়েছিলাম ১৯ জনকে সঙ্গে নিয়ে।
বড় ভাই হূমায়ুন আহমেদ যখন জীবিত ছিল, তখন তার ঈদের নাটক সবাই আগ্রহ করে দেখত। নতুন পোশাক আশাক সেলামির পরই ঈদের অন্যতম বিনোদন। এখন তো টিভিই খোলা হয় না। তবে এবার নুহাশ কী একটা নাটক নাকি তৈরি করছে বলে শোনা যাচ্ছে। সে জন্য সবাই আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে, হয়তো টিভি খোলা হবে। আমাদের নেক্সট জেনারেশনের ঈদ যেন একটু গুরুগম্ভীর। আমাদের ফার্মেসিতে পড়া সবচে ছোট ভাগ্নি এখনো ঈদে একটু হৈটৈ করা টাইপ। সে বান্ধবীদের নিয়ে অনলাইনে আবার ক্রাফটের একটা দোকান খুলেছে! ঈদে নাকি বেশ চলছে তাদের ক্রাফট বিজনেস, বিদেশ থেকেও অর্ডার আসছে। এখন আর সেলাম করে ঈদের সেলামি পাওয়া দুষ্কর কারণ সেলামি দেওয়ার মানুষগুলো সবই এক-এক করে চলে যাচ্ছে। বরং নিজেদের টাকা নিজেরাই রোজগার করতে শুরু করেছে ওরা।
ঈদ আসলে বদলে যাচ্ছে। ঈদ চলে গেছে টিভি থেকে ইউটিউবে... ফেসবুকও যেন একটু একঘেয়ে হয়ে উঠেছে। সেলফিকে সামাজিক ব্যাধি বলা হচ্ছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সেলফি প্রতিযোগিতাও যেন একটু কম কম লাগে। ঈদের বানানও মনে হচ্ছে বদলে যাচ্ছে। কেউ কেউ ‘ঈদ’ না লিখে লিখছে ‘ইদ’ (আমার কাছে মনে হয় দই। আরেকজন জানিয়েছে ঈদের এই বানান (ইদ) তার কাছে লাগে ইঁদুর...! আগের বানানই ঠিক আছে, আমাদের রক্তের সঙ্গে মিশে আছে)।
নেক্সট জেনারেশনের ঈদ আসলে তাদের মতো করে তাদের কাছেই আসে, আমরা যেন ঠিক বুঝতে পারি না। আমাদের ঈদ এখনো ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশির ঈদ... ’ নজরুলের বিখ্যাত এই গানটিতেই স্থির হয়ে আছে। এখনো এই গানটি শুনলে চোখের কোনায় পানি জমে উঠে, কানের কাছে ফিস ফিস করে সময়— ‘মনে পড়ে? মনে পড়ে?? ’ ...সত্যিই কত কিছুই যে মনে পড়ে তার হিসাব কে রাখে!